প্রতিশ্রুত ট্যাঙ্কের মাত্র এক চতুর্থাংশ ইউক্রেনকে দিচ্ছে পশ্চিমারা
ব্রিটেনের সানডে টাইমস রোববার জানিয়েছে, এপ্রিলের শুরুর মধ্যে ইউক্রেন পশ্চিম-প্রতিশ্রুত ট্যাঙ্কগুলোর এক চতুর্থাংশের কম পাবে। এতে
অমরত্বের আকাক্সক্ষা মানুষের চিরন্তন। সে তার কাজের মধ্যে নিজেকে অমর করে রাখতে চায়। পৃথিবীতে নিজেকে এমনভাবে রেখে যেতে চায়, যেন তার মৃত্যুর পরও মানুষ তাকে স্মরণ করে। রবীন্দ্রনাথ বলেন- ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে/মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।’
রবিনসন ক্রুশোকে জলদস্যুরা সমুদ্রের মাঝখানে যে-দ্বীপে ফেলে রেখে এসেছিল, সেখানে তাকে অবস্থান করতে হয়েছিল প্রায় ২৮ বছর। জনমানবশূন্য সেই দ্বীপে ক্রুশো পৌঁছেছিল ৩০ সেপ্টেম্বর ১৬৫৯ সালে এবং সেখান থেকে ইংল্যান্ডের উদ্দেশে যাত্রা করেছিল ১৯ ডিসেম্বর ১৬৮৬ সালে। মাঝখানে এই যে ২৮ বছর, এটা সে একটা বড় ক্রুশ তৈরি করে তার গায়ে দাগ কেটে কেটে হিসাব করে রেখেছিল। প্রথমে সে এই দ্বীপে তার প্রথম আগমনের তারিখ ১৯ ডিসেম্বর ১৬৮৬ লিখেছিল; তারপর প্রতিদিন হিসাব করার জন্য একটা করে দাগ কাটতো, সপ্তম দিন হলে ছয়টা দাগের মাঝখানে একটা ক্রস চিহ্ন দিতো, এভাবে সে হিসাব করতো সপ্তাহ, মাস, বছর। এভাবে এই নির্জন দ্বীপে কাটানো ২৮ বছর সময়কালকে সে একটা ফ্রেমে বেঁধে ফেলেছিল।
সভ্যতার শুরুতেও মানুষের মধ্যে সময়কে একটা ফ্রেমের মধ্যে বেঁধে ফেলার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এর ফলে নানা দেশে গড়ে ওঠে নানা ধরনের ক্যালেন্ডার বা বর্ষপঞ্জি। একেক বর্ষপঞ্জির উৎপত্তির ইতিহাস একেক রকম। রোমের লোককাহিনী থেকে জানা যায়, রোমে তখনও সভ্যতার পরশ তেমন লাগেনি। পাথর কেটে মানুষ ঘরবাড়ি বানায়, শিকার করে খাবার-দাবার সংগ্রহ করে। এভাবেই চলছিল। হঠাৎ মোগাস নামে একজন মাতব্বর গোছের লোক সবাইকে ডেকে বললো, ‘সূর্য ওঠে, অস্ত যায়, আবার ওঠে। এ মাঝের সময়টুকুকে ধরো একদিন। আর পাথর দিয়ে পাথরের গায়ে একটা করে দাগ কেটে দিন বানাও।’ এভাবে রবিনসন ত্রæশোর মতো দিন যায়, দাগ বাড়ে। মোগাসের দিন-মাসের কাহিনী বাড়তে থাকে। আস্তে আস্তে তৈরি হয়ে যায় রোমান ক্যালেন্ডার। আরেক কিংবদন্তি অনুসারে, রোমের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম রাজা রোমুলুস খ্রিস্ট-পূর্ব ৭৩৮ অব্দে রোমান ক্যালেন্ডার তৈরি করেন। মূল রোমান ক্যালেন্ডারে ছিলো ১০ মাস এবং এর বছর ছিলো ৩০৪ দিনের। বাকি ৬১.২৫ দিনকে মুখ্যত অবজ্ঞা করা হতো। অর্থাৎ শীতের দুই মাস বাদ দিয়ে তারা বছর গণনা করতো। ১০ মাসের নাম ছিলো মার্টিয়াস (মার্চ), এপ্রিলিস (এপ্রিল), মেইয়াস (মে), জুনিয়াস (জুন), কুইন্টিলিস, সেক্সটিলিস, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর। রোমানরা ১ মার্চ উদযাপন করতো নববর্ষ। পরবর্তীতে রোমান সম্রাট নুমা পম্পিলিয়াস জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাস দুটিকে ক্যালেন্ডারের অন্তর্ভুক্ত করেন। এরপর থেকে বছর হয়ে যায় বারো মাস। খ্রিস্ট-পূর্ব ১৫৩ অব্দে রোমানরা ১ জানুয়ারি নববর্ষ হিসেবে প্রথম উদযাপন করা শুরু করে।
রোমান ক্যালেন্ডারের মধ্যে নানা অসঙ্গতি রয়ে যায়। এতে শাসনকাজে নানা বিঘœ সৃষ্টি হয়। জুলিয়াস সিজার খ্রিস্টপূর্ব ৪৬ অব্দে রোমান ক্যালেন্ডারের সমস্ত অসংগতি সংশোধন করে একটি নতুন ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করেন। তখন থেকে এর নাম হয়ে যায় জুলিয়ান ক্যালেন্ডার। রোমানদের আগের ক্যালেন্ডার ছিলো চন্দ্রবর্ষের, সম্রাট জুলিযাস সিজার প্রবর্তন করেন সৌরক্যালেন্ডার। এটা তিনি করেছিলেন মিশরীয় ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে। রোমানদের দরজা ও ফটকের দেবতা ছিলো জানুস। তার নামানুসারে জানুয়ারি মাসের নাম হওয়ায় জুলিয়াস সিজার ভাবলেন, নতুন বছরের ফটক হওয়া উচিত জানুয়ারি মাসই। ফলে তিনিও ১ জানুয়ারি নববর্ষ হিসেবে উদযাপন করেন। পরবর্তীতে ‘কুইন্টিলিস’ নাম পরিবর্তিত হয়ে জুলিয়াস সিজারের নামানুসারে হয়ে যায় ‘জুলাই’, আরেক রোমান সম্রাট অগাস্টাসের নামানুসারে ‘সেক্সটিলিস’ হয়ে যায় ‘অগাস্ট’ বা ‘আগস্ট’। এই ক্যালেন্ডার সমগ্র ইউরোপে ব্যবহৃত হয় প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে। ১৫৮২ সালের অক্টোবর মাসে রোমের ত্রয়োদশ পোপ গ্রেগরি যিশুখ্রিস্টের জন্ম-বছর থেকে গণনা করে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের সামান্য সংশোধন করে নতুন ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করেন, যা অনুসরণ করতে থাকে সমস্ত খ্রিস্টানবিশ্ব। এরপর থেকে এর নাম হয়ে যায় গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। বর্তমান বিশে^র প্রায় সমস্ত দেশেই অনুসৃত হচ্ছে এই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। আসলে ইংরেজি ক্যালেন্ডার বলে কিছু নেই। তবু ভাষার আধিপত্যের কারণে ১ জানুয়ারি হয়ে গেছে এখন সারা বিশে^ ইংরেজি নববর্ষ।
১৫৮২ সালে পোপ গ্রেগরি যখন জুলিয়ান ক্যালেন্ডার সংশোধন করে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করেন, তার দু বছর পর ১৫৮৪ সালে মোগলসম্রাট আকবর বাংলায় প্রবর্তন করেন বাংলা ক্যালেন্ডার। মোগল শাসনামলে সমগ্র ভারতবর্ষে অবশ্য অনুসৃত হতো হিজরি ক্যালেন্ডার। কিন্তু সম্রাট আকবর ঋতুর সাথে সম্পৃক্ত একটি সৌর ক্যালেন্ডারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। কারণ হিজরি সন ১০ দিন কম হওয়ায় কৃষকদের কাছ থেকে শস্যের খাজনা আদায় করতে সমস্যা হচ্ছিল। ফলে সম্রাট আকবর একটি অত্যাধুনিক ক্যালেন্ডার তৈরির নির্দেশ দেন, যাতে করে শস্যের ঋতু প্রতি বছর একই সময়ে পাওয়া যায়। সমগ্র বাংলায় এই বাংলা সন ব্যবহৃত হতে থাকে বছরের পর বছর ধরে। ১৭৫৭ সালে ধূর্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে বাংলার স্বাধীনতাসূর্য অস্ত যাওয়ার পরপরই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুপ্রবেশ করে ভারতবর্ষে। আবার কারো কারো মতে, ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুপ্রবেশ করে ১৭৫৩ সালে, ইংল্যান্ডে এই ক্যালেন্ডারকে গ্রহণ করে নেওয়া হয় যেদিন সেই একই দিনে। তবে এর ব্যবহার তখন ইংরেজদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। রাষ্ট্রীয়ভাবে এটি ব্যবহৃত হতে থাকে ইংরেজরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পাকাপোক্তভাবে আসীন হওয়ার পর।
বাংলায় অবশ্য ইংরেজি নববর্ষ উদযাপনকে বাঙালিরা মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেনি কখনো। ইংরেজদের আচার-সংস্কৃতিকে এদেশের জন্য অকল্যাণকর মনে করে ঈশ^রচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯) তাঁর ‘ইংরেজি নববর্ষ’ কবিতায় ইংরেজিয়ানাপ্রীতির ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপ করেছেন এভাবে:
খ্রীষ্টমতে নববর্ষ অতি মনোহর।
প্রেমানন্দে পরিপূর্ণ যত শ্বেত নর।।
গোরার দঙ্গলে গিয়া কথা কহ হেসে।
ঠেস মেরে বস গিয়া বিবিদের ঘেঁষে।।
রাঙ্গামুখ দেখে বাবা টেনে লও হ্যাম।
ডোন্ট ক্যার হিন্দুয়ানী ড্যাম ড্যাম ড্যাম।।
পিঁড়ি পেতে ঝুরো লুসে মিছে ধরি নেম।
মিসে নাহি মিস খায় কিসে হবে ফেম?
শাড়িপরা এলোচুল আমাদের মেম।
বেলাক নেটিভ লেডি শেম্ শেম্ শেম ।
গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারকে ইংরেজি ক্যালেন্ডার না বলে খ্রিস্টান-ক্যালেন্ডার বললেই বরং যথার্থ বলা হয়। কারণ, পোপ গ্রেগরি মূলত জুলিয়ান ক্যালেন্ডারকে যিশুখ্রিস্টের জন্মদিন অনুসারে সাজাতে গিয়ে একে পক্ষান্তরে খ্রিস্টান ক্যালেন্ডারই বানিয়ে ফেলেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও জাতির বর্ষপঞ্জি মূলত একেকটি ধর্ম ও সংস্কৃতিকে ধারণ করেই গড়ে উঠেছিল। স¤্রাট আকবর প্রবর্তিত বাংলা বর্ষপঞ্জি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত বাঙালিকে এক কাতারে শামিল করতে সক্ষম হয়েছিল। এখন পর্যন্ত পহেলা বৈশাখ যখন আসে, সমস্ত বাঙালি আবার এক হয়ে যায়। কিন্তু সত্যি বলতে কী, বাঙালি অত্যন্ত সংস্কৃতি সচেতন হলেও ইংরেজি বর্ষপঞ্জির আগ্রাসন থেকে নিজেদেরকে মুক্ত রাখতে সক্ষম হচ্ছে না কিছুতেই।
পৃথিবীর মানুষ এখন বাস করছে একটি গেøাবাল ভিলেজে। পৃথিবীর এক প্রান্তে একটি পাতা পড়লেও পৃথিবীর অন্য প্রান্তে বসে তা ঠিকঠিকই অবলোকন করা যায়। সারা পৃথিবীর মানুষ এখন পরস্পরের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। এক্ষেত্রে উন্নত প্রযুক্তি ও মিডিয়া যেমন কাজ করছে, তেমনি কাজ করছে একটি ভাষা, সে-ভাষাটি হলো ইংরেজি। ইংরেজরা পৃথিবীর সমস্ত দেশ থেকে বিতাড়িত হলেও ঠিকঠিকই আজও সর্বত্র রাজত্ব করে যাচ্ছে তাদের ইংরেজি ভাষা। এটা এখন এক অনিবার্য বাস্তবতা। পৃথিবীর মানুষও চায় একটি কমন ভাষা, যার মাধ্যমে সমস্ত ভাষার ভাব একই রূপে ব্যক্ত করা যায়। সে-স্থান দখল করে নিয়েছে ইংরেজি। নিজেদের প্রয়োজনেই পৃথিবীর সব দেশের মানুষ এখন শিখে নেওয়ার চেষ্টা করছে ইংরেজি ভাষা।
আধুনিক বিশে^ চালু হয়েছে মুক্তবাজার অর্থনীতি। কোনো দেশই এখন আর স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে অন্যের উপর নির্ভরশীল। ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে এক দেশ আরেক দেশের কাছে আসছে এবং বিনিময় করছে পরস্পরের চাহিদা। এসব কারণে একটি কমন ভাষার পাশাপাশি মানুষের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে একটি কমন বর্ষপঞ্জিও। তার স্থান দখল করে নিয়েছে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার। এটা একটা বাস্তবতা।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক, অধ্যাপকধ
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।