Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে ব্যর্থ ইসি

চলতি ইউপি নির্বাচনে সহিংসতায় প্রাণহানি ১০০

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ১ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:০৯ এএম

চলতি বছর যে বিষয়টি ইসির অস্তিত্ব ধরে টান দেয়, সেটি হল এনআইডি অনুবিভাগ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে স্থানান্তর প্রক্রিয়া। অনেকটা নির্বাচন কমিশনকে পাস কাটিয়ে কোনো আলোচনা ছাড়াই এনআইডি বিভাগ ও লোকবল হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত নেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। যুক্তি দেখায় ইসির প্রশাসনিক ক্ষমতা না থাকায় সেবা ঠিকমতো দিতে পারছে না। বছরে রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য পৃথক আইন করার উদ্যোগ নেয় কে এম নুরুল হুদা নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি)। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বাংলায় রূপান্তর, মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ এনআইডি সরবরাহ, প্রবীণ ও অক্ষমদের ঘরে বসে ভোট দেয়ার সুযোগ সৃষ্টির মতো ইতিবাচক কার্যক্রমও হাতে নেয় ইসি। কিন্তু মেয়াদের শেষ বছরের সব অর্জন ম্নান হয়ে গিয়েছে চলমান ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে সহিংসতায় বহু মানুষের প্রাণহানির ঘটনায়। এছাড়া পুরনো ভোটারদের এখনো স্মার্টকার্ড দিতে না পারা, এনআইডি অনুবিভাগ নিজেদের কাছে রাখতে জোরালো ভূমিকার অভাব, ইভিএম সংরক্ষণের যথাযথ ব্যবস্থা করতে না পারা এবং ইউপি ভোটের সহিংসতায় ব্যাপক প্রাণনাশের ঘটনা রুখতে না পারায় সমালোচনার মুখে পড়ে কমিশন।

স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশন গঠিত হওয়া উচিত, তার বিধান আমাদের সংবিধানের ১১৮ ধারায় উপধারা (১) এতে উল্লেখ রয়েছে। সেখানে বলা আছে, আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে প্রধান ও অন্য নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দেবেন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু গত ৫০ বছরে কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় গিয়ে এ আইন তৈরির উদ্যোগ নেয়নি। এ কারণে ক্ষমতাসীন দলের গঠিত নির্বাচন কমিশন দ্বারা ও ক্ষমতাসীন দলের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত কোনো নির্বাচনই গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম হয়েছিল, সেটি রাজনৈতিক কারণে বাতিল হওয়ার পর যা হওয়ার তাই হয়েছে। এখন আবার (অন্তত নাগরিক সমাজ থেকে) সংবিধান মোতাবেক অর্থাৎ আইন করে নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবি উঠছে। বর্তমান নুরুল হুদা কমিশন নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে ব্যর্থ হয়েছে ইসি।

বরাবরের মতো এবারো নানা মন্তব্যের মাধ্যমে আলোচনার জন্ম দেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। তবে সবকিছু ছাপিয়ে যে বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনার মুখে পড়ে ইসি, সেটি হলো চলমান ইউপি নির্বাচনে ব্যাপক হারে প্রাণহানি। চার ধাপের ইউপি ভোটে প্রাণহানি পৌঁছেছে শতকের কোঠায়। আহত হয়েছেন প্রায় পাঁচ শতাধিক। এত সহিংসতা ঘটলেও ইসি বরাবরের মতোই নিজেদের দায় এড়িয়ে গেছে। গ্রহণ করতে পারেনি কোনো কার্যকর ভ‚মিকাও। সহিংস ঘটনা হ্রাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জড়িতদের প্রার্থিতা বাতিলের সুপারিশ করলেও কমিশন সেটি আমলে নেয়নি। চারটি ধাপের ভোট পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র বা বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যেই এ সহিংস ঘটনা ঘটেছে। এনিয়ে মেয়াদ ফুরিয়ে আসা নির্বাচন কমিশন কোনো দায় না নিয়ে পাহারা দিয়ে সহিংসতা ঠেকানো যায় না বলে অনেকটা নিজেদের অসহায়ত্বই প্রকাশ করেছে।

প্রাণহানির ঘটনার বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদা বলেন, ঘরে ঘরে, মহল্লায় মহল্লায় পুলিশ দিয়ে পাহারা দিয়ে এ জাতীয় অপ্রীতিকর ঘটনা থামানো যায় না। এটা থামানোর একমাত্র উপায় হলো নির্বাচনের সঙ্গে যারা আছে, তাদের সহনশীলতা ও নির্বাচনসুলভ আচরণ করা। সম্প্রতি নির্বাচন ভবনে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত এক সভায় তিনি বলেন, সংঘাতের দায়দায়িত্ব প্রশাসন, পুলিশ বা নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে দিলে হবে না। তারাই যে দায়ী এটা বলার সুযোগ নেই।

নির্বাচনে তাৎক্ষণিক উত্তেজনাকর পরিস্থিতির কারণে এ জাতীয় ঘটনা ঘটে উল্লেখ করে সিইসি বলেন, আমরা কোথাও কোনো ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে চলে যাই। ঘটনা প্রত্যক্ষ করি ও নির্দেশনা দেই। যথাযথ পরামর্শ দেই। যখনই সুযোগ পাই, সেখানে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে উদ্বুদ্ধ করি। এদিকে ভোটের সহিংসতায় সমালোচনার আগুনে যখন জ্বলছে ইসি, তখন সে আগুনে যেন ঘি ঢেলে দেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার।

প্রতি ধাপের ভোট শেষ হওয়ার নির্বাচন আইসিইউতে, ‘গণতন্ত্র লাইফ সাপোর্টে এমন সব তীর্যক মন্তব্য করে দেশবাসীর কাছে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। তবে তার এসব বক্তব্যকে অবশ্য উড়িয়ে দেন সিইসি কে এম নুরুল হুদা। পাল্টা সমালোচনা করে মাহবুব তালুকদার শালীনতাবহির্ভূত কথা বলছেন বলে জানান তিনি। সুশীল সমাজ থেকে সাধারণ নাগরিক, এমনকি সাবেক নির্বাচন কমিশনাররাও ইসির হাতেই এনআইডি রাখার পক্ষে বিভিন্ন প্লাটফর্মে আওয়াজ তুললেও নুরুল হুদা কমিশন বলতে গেলে জোরালো কিছু বলছে না। এ নিয়ে নানা মহলের সমালোচনাও কম হয়নি।

বর্তমান কমিশনের একেবারে শেষ বেলায় যে উদ্যোগ, সেটি হলো মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ এনআইডি সরবরাহ। বিষয়টি এখনো আলোচনাধীন হলেও এটির বাস্তবায়ন হয়নি। এছাড়া ভোটের দায়িত্বে নিয়োজিত এবং প্রবাসীদের পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেয়ার যে সুযোগ, তা আরো বিস্তৃত করতে চায় কমিশন। এক্ষেত্রে প্রবীণ ও প্রতিবন্ধীদেরও কার্যক্রমটির আওতায় আনার কথা ভাবছে ইসি। পাশাপাশি অনলাইনে বা ই-ভোটের প্রচলন করার পরিরিকল্পনাও হাতে নিয়েছে সংস্থাটি।

ইসি সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার জানিয়েছেন, কমিশনের সিদ্ধান্ত হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর ইতিবাচক মতামত পেলে বিষয়গুলো বাস্তবায়ন করা হবে। এরইমধ্যে পোস্টাল ব্যালটে প্রবীণ ও প্রতিবন্ধীদের ভোট দেয়ার সুযোগ সৃষ্টিতে আরপিও সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য এখনো কোনো আইন নেই।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) একটি অনুচ্ছেদের অধীনে কাজটি করা হয় ২০০৮ সাল থেকে। তার আগে এটাও ছিল না। বর্তমান কমিশন এই উদ্যোগ নেয়। তবে সেটি এখনো আইন মন্ত্রণালয় থেকে মতামত নিয়ে চ‚ড়ান্ত করতে পারেনি। যে কাজটির বর্তমান কমিশন সাধুবাদ পেয়েছেন তা হলো আরপিও বাংলায় রূপান্তর করা। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর আমলে সংসদ নির্বাচনের জন্য আরপিও প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু সেটা বেশ কয়েকবার সংশোধন করা হলেও নতুন আইন করা হয়নি। বর্তমান কমিশন সেটি করার উদ্যোগ নিলে আইন মন্ত্রণালয়ের সায় পায়নি। তাই পরবর্তী সময়ে এটিকে বাংলায় রূপান্তরের উদ্যোগ নেয় ইসি। আর সেটি রূপান্তর করতে সক্ষম হন তারা। স্মার্টকার্ড তৈরি ও সরবরাহের জন্য গ্রহণ করা নতুন প্রকল্পটিও বর্তমান ইসির একটি ভালো উদ্যোগ।

বিশ্বব্যাংক স্মার্টকার্ড প্রকল্প থেকে সরে গেছে তিন বছর হলো। প্রকল্প শেষ হওয়ার আগেই তারা ২০১৮ সালে জানিয়ে দিয়েছিল আর টাকা দেবে না। ফলে স্মার্টকার্ডের জন্য সরকারি তহবিল থেকে এ বছরই নতুন প্রকল্প হাতে নিয়েছে ইসি। যার আওতায় প্রায় পাঁচ কোটি নাগরিককে স্মার্টকার্ড সরবরাহের কথা রয়েছে। ফলে যারা এখনো স্মার্টকার্ড পাননি। তবে ফরাসি কোম্পানি অবার্থার টেকনোলজিসের কাছ থেকে এখনো দেড় কোটি বø্যাংক স্মার্টকার্ড আদায় করতে পারেনি ইসি। ফলে বিঘিœত হচ্ছে স্মার্টকার্ড বিতরণ কার্যক্রম।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন