Inqilab Logo

শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবন ১৪৩১, ২০ মুহাররম ১৪৪৬ হিজরী

গুম খুন লাশ : চট্টগ্রামে বছরজুড়ে আলোচনায়

রফিকুল ইসলাম সেলিম | প্রকাশের সময় : ১ জানুয়ারি, ২০২২, ১২:১০ এএম

নগরীর হালিশহর রহমানবাগ আবাসিক এলাকার একটি বাসা থেকে অজ্ঞাত এক মহিলার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তাকে হত্যা করে খালি বাসায় লাশ ফেলে যাওয়া হয়। ১৬ মাস পর হত্যাকারী স্বামী এবং তার আরেক স্ত্রীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। জানা যায়, খুনের শিকার ওই মহিলার নাম লাকী আক্তার। তার স্বামী সোহাইল তৃতীয় স্ত্রীর সহযোগিতায় তাকে খুন করে লাশ ফেলে পালিয়ে যান। বাসা ভাড়া নেয়ার সময় ভুয়া এনআইডি কার্ড জমা দেন তিনি। আর এ কারণে খুনের রহস্য উদঘাটনে ১৬ মাস লেগে যায় পুলিশের।

লাকী আক্তারের মত মহানগরী ও জেলার বিভিন্ন এলাকায় একের পর এক লাশ উদ্ধার হয়। পাহাড়, সাগর, নদী, পুকুর, নালা, নর্দমা, ধানক্ষেত এমনকি গাছে এবং বিদ্যুতের টাওয়ারে ঝুলন্ত অবস্থায়ও খুন, গুমের শিকার অনেকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। যেখানে সেখানে লাশের পর লাশ উদ্ধারের ঘটনাই ছিল ২০২১ সালের আলোচিত ঘটনা। রাজনৈতিক ও নির্বাচনী সংঘাত-সহিংসতা, ডাকাতি, দস্যুতার ঘটনায় খুন হয়েছেন অনেকে। পারিবারিক কলহ-বিরোধ, পূর্ব শত্রæতার জের ধরে খুনের ঘটনা ঘটছে। সন্তানকে নিজহাতে খুন করে মায়ের আত্মহত্যা, স্বজনের হাতে স্বজন খুনের মত ভয়ঙ্কর ঘটনাও ঘটেছে বিভিন্ন সময়ে। আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে উদ্বেগজনকহারে। বেসরকারি একটি সংস্থার হিসাবে, ছয় মাসেই মহানগর এবং জেলায় সাড়ে তিনশ জন আত্মহত্যা করে। বছরের শুরু থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত বেওয়ারিশ হয়েছে ২১৯ জন। যেখানে সেখানে উদ্ধারকৃত লাশের বেশিরভাগই গুপ্তহত্যার শিকার। তাদের পরিচয় পাওয়া না যাওয়ায় খুনের রহস্য উদঘাটন এবং খুনিচক্রের সদস্যদের গ্রেফতারে গলদঘর্ম হতে হয় পুলিশ বাহিনীকে। সড়ক দুর্ঘটনায়ও লাশের মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। প্রতিদিনই ঘটছে মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা। খাল, নালায় পড়ে অন্তত ছয় জন লাশ হয়েছে।

মহানগর ও জেলা পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, পারিবারিক কলহ-বিরোধ এবং স্বার্থের দ্ব›েদ্ব খুনের ঘটনা বাড়ছে। অনেকে গুপ্ত হত্যার শিকার হচ্ছেন। ডাকাত, ছিনতাইকারীদের হাতেও খুনের ঘটনা ঘটছে। খুনের পর লাশ ফেলে দেওয়া হচ্ছে খাল, নদী ও সাগরে। বছরের শুরুতে সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে ঘিরে ঘটে সহিংসতা। ২৭ জানুয়ারি ভোটের দিন দুইজনসহ নির্বাচনী সংঘাতে প্রাণ হারান পাঁচ জন। এরা সবাই আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর প্রার্থী ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের সমর্থক। ভোটের দিন নগরীর পাহাড়তলীতে দুই পক্ষের গোলাগুলিতে মারা যান আলাউদ্দিন নামে একজন। সরাইপাড়া এলাকায় খুন হন আরও একজন। ১২ জানুয়ারি ভোটের প্রচারে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে আরও একজনের প্রাণ যায়। গত ১১ নভেম্বর ইউপি নির্বাচনেও ফটিকছড়িতে খুন হন একজন। নির্বাচনী সহিংসতার পাশাপাশি মহানগরী এবং জেলায় সরকারি দলের সমর্থকদের মধ্যে কলহ-বিরোধে বেশ কয়েকজনের প্রাণ যায়। কিশোর গ্যাংয়ের বিরোধেও খুনের ঘটনা ঘটে।

স্বজনের হাত রঞ্জিত হয়েছে স্বজনের রক্তে। ১৬ অক্টোবর নগরীর মুরাদপুরে দুই সন্তানকে হত্যার পর আত্মহত্যা করেন এক মা। ১০ বছর আগে পরিবারের অমতে প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন সুমিতা বেগম ও সোহেল রানা। এ নিয়ে দুইজনের পরিবারের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ ছিল না। ১০ বছরে তাদের ঘরে আসে দুটি সন্তান। কিছুদিন আগে স্বামীর হাতে শুরু হয় কলহ। এতে অভিমান করে সাত বছরের মেয়ে জান্নাতুল তানজিনা মুন এবং তিন বছরের ছেলে শান বাবুকে গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করেন সুমিতা। এরপর গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। খবর পেয়ে পুলিশ তিন জনের লাশ উদ্ধার করে। আত্মহত্যা প্ররোচনার মামলায় গ্রেফতার হন সোহেল রানা। পারিবারিক কলহে বিরান হয়ে গেল একটি পরিবার। ১৯ অক্টোবর সাতকানিয়ায় শিশুপুত্র মো. সানিকে হত্যার পর বিষপানে আত্মহত্যা করেন প্রবাসফেরত নুরুল কবির। স্ত্রীর পরকীয়ার জেরে এমন কাÐ ঘটান তিনি। সীতাকুÐ পৌরসদরের প্রেমতলায় স্ত্রী জ্যোতি সূত্রধরকে ছুরিকাঘাতে খুন করেন স্বামী অভিধর। এরপর ছুরিকাঘাতে নিজেকে রক্তাক্ত করেন। এক সপ্তাহ পরে হাসপাতালে মারা যান ওই যুবক। প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন তারা। দুই পরিবার এ বিয়ে মেনে নেননি। এর জের ধরে দুজনের মধ্যে বিরোধে স্ত্রীকে খুন করে আত্মহত্যা করেন অভি।

ভাইয়ের হাতে ভাই, সন্তানের হাতে পিতা খুনের একাধিক ঘটনা ঘটেছে মহানগরী ও জেলায়। সম্পত্তি নিয়ে বিরোধের জেরে জন্মদাতা পিতা-মাতা ও ভাইকে খুন করেন এক যুবক। ১৪ অক্টোবর মীরসরাই উপজেলার জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের মধ্যম সোনাপাহাড় এলাকায় ঘটে এ তিন খুনের ঘটনা। পরিবারের বড় ছেলে সাদেক হোসেন সাদ্দাম প্রথমে ঘুমন্ত বাবা মো. মোস্তফা সওদাগর এরপর মা জোছনা আরা বেগমকে গলা কেটে হত্যা করেন। এ দৃশ্য দেখে ফেলায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় মেজ ভাই আহমদ হোসেনকে। তুচ্ছ কারণেও ঘটেছে খুনের ঘটনা। অটোরিকশা ছিনতাইয়ের জন্য রিকশাচালক খুন, টাকার লোভে বাড়ির মালিককে খুন করেন কেয়ারটেকার। খুনের ঘটনায় জড়িতদের অনেককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তবে কিছু লাশের পরিচয় পাওয়া না যাওয়ায় খুনের রহস্য উদঘাটন এবং খুনিদের গ্রেফতার করা যাচ্ছে না। গুপ্তহত্যার শিকার অনেকের লাশ দাফন হচ্ছে বেওয়ারিশ হিসাবে। আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম বছরজুড়ে ২১৯ জনের লাশ দাফন করেছে। যাদের বিরাট অংশ নির্মম খুনের শিকার।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন