বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে তিনি প্রশ্ন করেছেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কোন সদকা সবার সেরা? রাসূলুল্লাহ (সা.) উত্তর দিয়েছেন : অর্থসম্পদ যার কম, যে অসচ্ছল, কষ্ট করে সে যা দান করে (সেটাই সর্বোত্তম সদকা)। আর তুমি তোমার অধীনস্তদের দিয়ে শুরু করো। (সুনানে আবু দাউদ : ১৬৭৯)। এ তো স্পষ্ট-একজন ধনী মানুষ নিজের প্রয়োজন মেটানোর পর বেশ পরিমাণ অর্থ সঞ্চিত রেখেও চাইলে অনেক টাকা দান করতে পারবে। এতে তাকে কোনো সঙ্কটের মুখে পড়তে হবে না। কিন্তু একজন অসচ্ছল মানুষ, নিজের আবশ্যকীয় প্রয়োজন মেটানোই যার জন্য কষ্টকর, অল্প পরিমাণে দান করাও তার জন্যে কষ্টকর। নিজের প্রয়োজনই যেখানে মেটে না, সেখানে অন্যের প্রয়োজন মেটানোয় এগিয়ে যাওয়ার বিষয়টি কল্পনা করা সহজ নয়। এর পরও যখন অসচ্ছল কোনো ব্যক্তি দান করে, পরিমাণে তা যত অল্পই হোক, ইখলাস ও আন্তরিকতার মিশেলে তা আল্লাহর দরবারে অনেক অনেক মূল্যবান বলে বিবেচিত হতে পারে।
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত আরেকটি হাদীস, এক ব্যক্তি এসে রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কোন সদকায় সবচেয়ে বেশি সওয়াব হবে? রাসূলুল্লাহ (সা.) উত্তর দিয়েছেন : যখন তুমি সুস্থ-সবল, তোমার উপার্জিত সম্পদ তুমি তোমার নিজের কাছে রেখে দিতে চাচ্ছ, অভাবে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও তোমার রয়েছে, তুমি সচ্ছলতার স্বপ্নও দেখ-এমন পরিস্থিতিতে তুমি যে দান করবে (সেটাই তোমার জন্যে অধিক প্রতিদান বয়ে আনবে)। (দান-সদকার ক্ষেত্রে) তুমি এতটা বিলম্ব করো না যে, তোমার প্রাণ ওষ্ঠাগত হলো আর তখন তুমি বলতে থাকলে-এটা অমুকের, এটা তমুকের। শোনো, এটা তো তখন অন্যদেরই হয়ে যায়। (সহীহ মুসলিম : ১০৩২)।
অনেকসময় দেখা যায়, মানুষ যখন কোনো বিপদে পড়ে তখন সে দান করতে চায়। একইভাবে যখন অসুস্থতা, বার্ধক্য কিংবা অন্য কোনো পরিস্থিতির মুখে পড়ে কেউ নিজের জীবন সম্পর্কে নিরাশ হয়ে পড়ে, জীবন কিংবা নিজের উপার্জিত সম্পদ উপভোগ করার কোনো আশা আর তার থাকে না, তখনও সে সম্পদ গরিবদের দান করে দিতে চায়। সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় কেউ নিজের সম্পদ ইচ্ছেমতো দান করতে পারে।
কিন্তু যদি মৃত্যুপরবর্তী সময়ের জন্যে ওসিয়ত করে যেতে চায়, তবে তা অবশ্যই রেখে যাওয়া সম্পদের এক তৃতীয়াংশের মধ্যে সীমিত থাকতে হবে। বাকিটা ওয়ারিশদের। এ হাদীসের মূল মর্ম এটাই-দান যা করতে চাও, সুস্থ-স্বাভাবিক অবস্থাতেই করে নাও। মৃত্যু যখন তোমার দুয়ারে কড়া নাড়বে, তখন এটা-ওটা দান করার ওসিয়ত করতে থাকবে-এমনটা করার খুব সুযোগ নেই।
মানুষ যতদিন সুস্থ-সবল থাকে, দুনিয়ার রঙিন স্বপ্ন তাকে হাতছানি দিতে থাকে। একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের আশায় সে বিভোর থাকে। অভাবের মুখে পড়ার আশঙ্কাও মনে উঁকি দেয়। আর শয়তান তো এ ভয় দেখানোতেই লিপ্ত। পবিত্র কোরআনের ঘোষণা : শয়তান তোমাদেরকে দরিদ্রতার ভয় দেখায় আর তোমাদেরকে মন্দ কাজের (কৃপণতার) আদেশ করে। (সূরা বাকারা : ২৬৮)।
অভাব ও দরিদ্রতার এ ভয় ও আশঙ্কাকে উপেক্ষা করে, সম্পদের প্রতি স্বভাবজাত লোভ ও কার্পণ্যকে জয় করে যারা সম্পদ দান করতে পারে, সন্দেহ নেই, এজন্যে নিজেদের মনের বিরুদ্ধে তাদের লড়াই করতে হয় অবিরাম। আর কষ্ট যেখানে বেশি, তা যদি সঠিক পন্থায় হয়, কেষ্টও সেখানে বেশি। সওয়াব ও প্রতিদানে সেটাই হবে সেরা।
এই তো ইসলাম। একটু সচেতন হলেই এখানে রয়েছে আঁচল ভরে নেয়ার সুযোগ। দান-সদকার ক্ষেত্রে আমাদেরকে ভারসাম্য মেনে চলার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। নফল দানের আগে ফরজ দায়িত্ব পালনে উৎসাহিত করা হয়েছে। আবার সীমিত আয়ের অসচ্ছল কেউ যখন কষ্ট করে সামান্যও দান করে, সেটাকে বলা হচ্ছে সেরা দান। বিপদাপদ দূর করার জন্যে দান করতে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই, কিন্তু উৎসাহিত করা হয়েছে সুস্থ কর্মক্ষম স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে বেশি পরিমাণে দান করার প্রতি। সে দান প্রকাশ্যে হতে পারে, হতে পারে গোপনেও। দানের এ শিক্ষা যদি ছড়িয়ে পড়ে, আমাদের জীবন ও সমাজ তবে আলোকিত হবেই।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।