Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বহু প্রাণহানি শাস্তি নামমাত্র

নৌ-দুর্ঘটনার মামলা আইন যুগপোযোগী করার পরামর্শ আইনজ্ঞদের

সাঈদ আহমেদ | প্রকাশের সময় : ২৮ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০৪ এএম

৪৫ বছরের পুরনো ও দুর্বল আইনে চলছে নৌ-দুর্র্ঘটনা মামলার বিচার। স্বাধীনতার পরবর্তী ৫০ বছরে ২০ হাজারের বেশি নৌযাত্রীর প্রাণহানি হলেও দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি একটিও। আইনজ্ঞরা বলছেন, দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলেও এটি একটি ফৌজদারি অপরাধ। কিন্তু কঠোর শাস্তির ধারাসমৃদ্ধ হালনাগাদ আইন না থাকায় দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনা যাচ্ছে না। নৌ-আদালত (মেরিন কোর্ট) সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আসামিরা প্রভাবশালী হওয়ায় বিচার প্রক্রিয়া প্রলম্বিত হয়। এর ফলে বিচারের সময় সাক্ষী পাওয়া যায় না। এর সুফল লাভ করে নৌ-যান মালিকরা। নৌ-দুর্ঘটনায় বহু প্রাণহানি হলেও জড়িতদের শাস্তির বিধান নামমাত্র।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, দেশের নৌ-চলাচল এবং দুর্ঘটনা নিয়ে গ্রহণযোগ্য কোনো জরিপ নেই। সর্বজন গ্রাহ্য কোনো তথ্যও নেই এ বিষয়ে। অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)র কাছে এ বিষয়ে হালনাগাদ কোনো তথ্য নেই।

সর্বশেষ ২০১৬ সালে বিআইডবিøউটিএ কিছু তথ্য প্রকাশ করে। সে অনুযায়ী ১৯৬৭ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত নৌ দুর্ঘটনা, প্রাণহানি ও মোট সম্পদের ক্ষতির হিসাব তুলে ধরা হয়। তাতে দেখা যায়, ৫০ বছরে দেশে নৌ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ২০ হাজার ৫০৮ জন নৌযাত্রী।

নৌ-অপরাধের তদন্ত ও বিচার হয় ১৯৭৬ সালে প্রণীত ‘দ্য ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স’ অনুযায়ী। অধ্যাদেশের ৪৭ ধারা অনুযায়ী সরকার কর্তৃক নৌ-পরিবহন সংক্রান্ত অপরাধের বিচারের জন্য এক বা একাধিক মেরিন কোর্ট (নৌ-আদালত) প্রতিষ্ঠার কথা বলা আছে। কিন্তু সারা দেশে নৌ-আদালত এখনো একটি। মেরিন কোর্টের বিচারক প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতাপ্রাপ্ত। বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিসের যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ পদমর্যাদার কর্মকর্তা বর্তমানে এ পদে নিযুক্ত আছেন।

নৌ-আইনের ৭০ নম্বর ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি ৫ বছর কারাদন্ড। সেই সঙ্গে ১০ হাজার টাকা জরিমানা। এই রায় দিতে হলেও আদালতকে একেকটি মামলা টেনে নিতে হয় বছরের পর বছর। তদুপরি নৌ-অপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে কারাভোগ করছেন-এমন দৃষ্টান্ত বিরল।

তবে বিআইডব্লিউটিএ সূত্র দাবি করছে, নৌযান দুর্ঘটনায় ১৯৯০ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৩৯২টি তদন্ত হয়েছে। এর মধ্যে নৌ আদালতে ৩০৮টি মামলায় ২৬৫টিতে দন্ডাদেশ দেয়া হয়। এ ছাড়া পরিদর্শনকালে ত্রæটিজনিত কারণে ৫৭৫টি মামলা হয়। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ৩৭৫টি মামলা।

নামমাত্র শাস্তির দৃষ্টান্ত তুলে ধরে সূত্রটি আরো জানায়, ২০০২ সালের এপ্রিল ঢাকা-ভোলা নৌপথে এমভি সালাউদ্দিন-২ লঞ্চ মেঘনা নদীর ষাটনল এলাকায় ঝড়ের কবলে পড়ে ডুবে যায়। এতে সাড়ে ৩ শতাধিক লোকের প্রাণহানি হয়। এ ঘটনায় অধ্যাদেশ অনুযায়ী দন্ড হয়। দন্ড বলতে লঞ্চমালিকের পরিবারের পাঁচ সদস্যের ১ লাখ টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে তিন বছর করে কারাদন্ড। এ রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ আপিল করায় আসামিদের কারাগারেই যেতে হয়নি। গুণতেও হয়নি কোনো জরিমানা।

আলোচিত এমএল পিনাক-৬ লঞ্চডুবির ঘটনায় মুন্সিগঞ্জের লৌহজং থানায় ফৌজদারি আইনে মামলা হয়। নৌ-আইনে মামলা না হওয়ায় নৌ-আদালত এটির বিচার করতে পারেনি।
২০০৩ সালের ৮ জুলাই চাঁদপুরের মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মোহনায় এমবি নাসরিন-১ লঞ্চডুবিতে প্রাণহানি হয় ১১০ জনের। নিখোঁজ হন ১৯৯। এর মধ্যে লঞ্চটির মালিক এবং মাস্টারও ছিলেন। এই মামলায় লঞ্চটির নকশা তদারকি দলের (সুপারভাইজার প্যানেল) দুই সদস্যের ১ লাখ টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে ১ বছর করে কারাদন্ড হয়।

আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ১৯৭৬ সালে প্রণীত অভ্যন্তরীণ নৌ অধ্যাদেশের সংশোধনী আনা হয় ২০০৫ সালে। তা সত্তে¡ও আইনটিতে রয়েছে অনেক দুর্বলতা ও ফাঁক-ফোকর। আইনটির ৫৫ ধারা বলছে, ঝড়ের সংকেত থাকাবস্থায় নৌযাত্রা নিষিদ্ধ। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ধারার শর্ত ভঙ্গ হলে অভ্যন্তরীণ নৌযান মাস্টারের ৩ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড বা ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড দেয়ার বিধান রয়েছে।

আইনের ৭০ ধারায় অসদাচরণ ইত্যাদির কারণে জাহাজ বিপদাপন্ন করার শাস্তি বিষয়ে বর্ণনা রয়েছে। ধারাটির (২) অনুসারে যেখানে কোনো অভ্যন্তরীণ নৌযান দুর্ঘটনার ফলে প্রাণহানি বা কোনো ব্যক্তি আহত বা নৌযানের বা অন্য কোনো নৌযানের সম্পদ নষ্ট হয়ে থাকে এবং এ ধরনের কোনো নৌযানের ত্রুটি বা অভ্যন্তরীণ নৌ-যানের মালিক, মাস্টার বা কোনো কর্মকর্তা বা ক্রু সদস্যের অযোগ্যতা বা অসদাচরণ বা কোনো আইন ভঙ্গের দরুন ঘটে থাকে, তবে ওই নৌযানের মালিক বা অন্য কোনো কর্মকর্তা বা ক্রু সদস্য বা তাদের প্রত্যেকেই ৫ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড বা ১ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা কিংবা উভয় দন্ডেই দন্ডিত হতে পারেন।

আইনের ৫৮ ধারায় বলা হয়েছে, এই ধারা ভঙ্গ করলে নৌযানটির মালিক ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ডে দন্ডিত হবেন এবং মাস্টার ৩ মাস পর্যন্ত কারাদন্ড বা ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। অতিরিক্ত যাত্রী বহনে শাস্তির বিধান রয়েছে ৬৭ ধারায়। এ ধারা অনুসারে কোনো অভ্যন্তরীণ নৌ-যান বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কোনো নৌযাত্রায় নির্ধারিত সংখ্যার অতিরিক্ত যাত্রী বহন করলে মালিক বা তার প্রতিনিধি বা মাস্টারকে (যারা যাত্রার সময় মালামাল ওঠানো-নামানোর সময় উপস্থিত থাকবেন) প্রত্যেক যাত্রীর জন্য ৩০০ টাকা, তবে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা জরিমানা করা যাবে।

নৌ-আদালতের সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট পারভীন সুলতানার মতে, লঞ্চ মালিকরা অত্যন্ত প্রভাবশালী। তারা দুষ্টু প্রকৃতির। তাদের আইনের আওতায় আনা কঠিন। তাছাড়া নৌ-আদালতের আইনটা অনেক দুর্বল, সাজাও কম। এটাকে আরো যুগোপযোগী ও আধুনিক করা প্রয়োজন।

সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের মতে, লঞ্চডুবি কিংবা লঞ্চে অগ্নিকান্ডের ঘটনা স্পষ্টত ফৌজদারি অপরাধ। দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। প্রচলিত যে আইন রয়েছে সেটি অনেক দুর্বল। এটিকে আরো যুগোপযোগী ও শক্তিশালী করা উচিত।

এদিকে বুধবার রাতে ঝালকাঠিগামী লঞ্চ ‘এমভি অভিযান-১০’র অগ্নিকান্ডে ৪০ জনের মৃত্যুর ঘটনায় গতকাল রোববার বরগুনা আদালতে মামলা হয়েছে। মামলার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাইফুর রহমান সোহাগ বলেন, লঞ্চে আগুনের ঘটনায় মালিকসহ স্টাফদের গাফিলতি সুস্পষ্ট। আলোচিত এ ঘটনায় বাদী সংক্ষুদ্ধ হয়ে মামলার আবেদন করেছিলেন। আদালত আবেদন গ্রহণ করে মামলাটি এজাহার হিসেবে গ্রহণ করতে সংশ্লিষ্ট থানাকে নির্দেশ দিয়েছেন।

তবে নৌ দুর্ঘটনায় বড় ধরনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেও এতে শাস্তির বিধান নামমাত্র। অতীতে নৌ-দুর্ঘটনায় বহু প্রাণহানির ঘটনা ঘটলেও দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তি হয়নি। তাই এ মামলাটির পরিণতি নিয়ে সন্দিহান আইনজ্ঞরা।
আইনজ্ঞ ড. শাহদীন মালিকের মতে, এ মামলাটি ফৌজদারি মামলা হিসেবে দায়ের করা হয়েছে। এ ধরনের মামলায় প্রসিকিউশনকে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে হয়। যেকোনো দুর্ঘটনায় কেউ মারা গেলে ১৮৮৫ সালের ফ্যাটাল অ্যাক্সিডেন্ট অ্যাক্টের আওতায় আর্থিক ক্ষতিপূরণ চেয়ে প্রতিকার চাওয়া যায়। কিন্তু ফৌজদারি মামলায় ক্ষতিপূরণ আদায় করাটা কঠিন। ‘ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স’র প্রাণহানির ঘটনায় শাস্তি নামমাত্র।



 

Show all comments
  • জব্বার ২৭ ডিসেম্বর, ২০২১, ৩:০৮ এএম says : 0
    এই আইন সংশোধন করা জরুরী
    Total Reply(0) Reply
  • Jakir Hossain ২৭ ডিসেম্বর, ২০২১, ৩:৩৩ এএম says : 0
    এত বড় জাহাজ এত শত লোকের বাহন অথচ অগ্নিনির্বাপকের কোন ব্যবস্থা নেই! এমনটা বাংলাদেশ বলে সম্ভবত! যা দুক্ষজনক
    Total Reply(0) Reply
  • AHm Khorshed ২৭ ডিসেম্বর, ২০২১, ৩:৩৪ এএম says : 0
    ‌নৌ রে‌া‌ট পার‌মিট যারা দি‌য়ে‌ছে তা‌দের সবার অা‌গে ধরা হোক
    Total Reply(0) Reply
  • Hedayet ২৭ ডিসেম্বর, ২০২১, ৩:৩৪ এএম says : 0
    আমাদের দেশে চোর চলে গেলে বুদ্ধি হয় ' সকল ক্ষেত্রে অসাবধানতা ' আইনের ফাঁকফোকর।
    Total Reply(0) Reply
  • Ahsanul Islam ২৭ ডিসেম্বর, ২০২১, ৩:৪৩ এএম says : 0
    সঠিক বিচার চাই। মানুষের জীবন নিয়ে লঞ্চ মালিক খেলে
    Total Reply(0) Reply
  • Sohel Rana ২৭ ডিসেম্বর, ২০২১, ৩:৫৭ এএম says : 0
    আমাদের দেশের নৌপরিবহন গুলো খুবই জঘন্য!.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নৌ-দুর্ঘটনা
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ