Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সঙ্কুচিত হচ্ছে সড়ক

রাজধানীর প্রধান সড়ক-শপিং মল-সুপার মার্কেটের সামনে অবৈধ পার্কিং

কামাল আতাতুর্ক মিসেল | প্রকাশের সময় : ২৭ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০১ এএম

অবৈধ পার্কিং বন্ধ না হওয়ায় ক্রমেই সঙ্কুচিত হচ্ছে রাজধানীর রাজপথ। রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়ক, শপিং মল ও সুপার মার্কেটের সামনে গড়ে উঠেছে অবৈধ গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা। বাড়ছে যানজট ও জনদুর্ভোগ। চলাচলে সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিবন্ধকতা। অনুপযোগী হয়ে উঠছে শহরের অলিগলি। এতে নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে নগরবাসীকে। ফলে একদিকে যেমন নষ্ট হচ্ছে নগরবাসীর কর্মঘণ্টা, তেমনি পোহাতে হচ্ছে অসহনীয় ভোগান্তি।
যানজট নিরসনে একের পর এক ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হলেও পরিস্থিতির ইতিবাচক উন্নতি ঘটেনি সড়ক ব্যবস্থাপনার যাচ্ছেতাই অবস্থার কারণে। রাজধানীর যেখানে-সেখানে গাড়ি পার্কিং চলার পথকে সঙ্কুচিত করে ফেলছে এবং তা যানজটের অন্যতম কারণ বলে বিবেচিত। পরিকল্পিত পার্কিং ব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় ব্যস্ত সময়েও রাস্তা দখল করে গাড়ি পার্কিংয়ের ঘটনা অহরহ ঘটছে। এতে নগরীর অসহনীয় যানজট আরো তীব্র হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মহাপরিকল্পনার বিকল্প কিছু নেই। পার্কিং ব্যবস্থা নিয়ে এখনই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা না হলে, রাজধানীর বাসযোগ্যতা বিনষ্ট হবে। ফুটপাথ থেকে শুরু করে সড়কের কোথাও চলাচলের পথ থাকবে না। ঢাকায় প্রতিটি ভবন নির্মাণকালে গাড়ি পার্কিংয়ের পর্যাপ্ত জায়গা রাখা হচ্ছে কি-না সিটি করপোরেশন ও রাজউকসহ সংশ্লিষ্টদের নজরদারি বাড়াতে হবে। পাশাপাশি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে গড়ে তুলতে হবে পরিকল্পিত পার্কিং ব্যবস্থা। পার্কিং নৈরাজ্যের সঙ্গে জড়িত সুবিধাভোগীদের লাগাম টানতে হবে। সড়কে কিংবা ফুটপাথে গাড়ি রাখলে তার মালিক ও চালকদের আইনের আওতায় আনতে হবে। তাহলেই পার্কিং নৈরাজ্য কমে আসবে।
জানা যায়, রাজধানীর অধিকাংশ ভবনের নেই পার্কিং-এর ব্যবস্থা। বড় বিপণিবিতানগুলোতে পার্কিং ব্যবস্থা থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। এ ছাড়া সড়কের পাশেই গড়ে ওঠা মার্কেটগুলোতে রাখা হয় না পার্কিংয়ের সুবিধা। ফলে গাড়ির মালিকের ইচ্ছা ও চালকদের সুবিধার জন্য সড়কেই বেছে নেন। রাজধানীর মতিঝিল-দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকার অধিকাংশ বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে কোনো রকম পার্কিং সুবিধা ছাড়াই। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলোর তৈরি ফ্ল্যাটগুলোয় পার্কিং সুবিধা থাকলেও সেগুলোর উল্লেখযোগ্য অংশ বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশেষ করে সুপার মার্কেট, শপিং মলসহ বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলোয় পর্যাপ্ত পার্কিংব্যবস্থা না থাকায় সেখানে আসা গাড়ি রাস্তার বেশির ভাগ জায়গা দখল করে যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। ফলে যানজট সংশ্লিষ্ট এলাকায় অনিবার্য হয়ে উঠছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজধানীর যানজট নিরসনে ফ্লাইওভার নির্মাণের চেয়েও বেশি জরুরি ট্রাফিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা। যেখানে-সেখানে গাড়ি পার্কিং বন্ধের পাশাপাশি বাস-মিনিবাস চলাচলে যে যথেচ্ছতা রয়েছে, তার লাগাম টানতে হবে। এ ক্ষেত্রে লাগাম পরাতে পারলে রাজধানীর যানজট পরিস্থিতি অনেকটাই সহনীয় হয়ে উঠবে। এ ব্যাপারে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্বশীল ভ‚মিকা খুবই জরুরি।
ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিন ঢাকার রাস্তায় নতুন করে শতাধিক যানবাহন রাস্তায় নামে। যার ফলে সড়কে গাড়ি পার্কিং বেড়েই চলছে। এতে যানবাহন চলাচলের গতি কমে যাচ্ছে। নগরীর প্রধান সড়কগুলোতেও অবৈধভাবে পার্কিং হচ্ছে। রাজধানীর বাণিজ্যিক এলাকা মতিঝিলের দিলকুশা। ব্যাংক পাড়া হিসেবেও বেশি পরিচিত স্থানটি।
সরজমিন দেখা গেছে, এখানে প্রতিটি সড়কের অলিগলিতে রাখা হয়েছে ছোট বড় গাড়ি। গোটা বাণিজ্যিক এলাকায় যানজট লেগে থাকছে। পল্টন-মতিঝিল রুটে চলছে মেট্রোরেল নির্মাণ কাজ। এতে দুইদিকে সরু হয়ে গেছে সড়ক। সরু সড়কের ওপর রাখা হয়েছে ব্যক্তিগত গাড়ি। এতে গণপরিবহন চলাচলে ব্যাঘাত ঘটছে। তৈরি হচ্ছে যানজট। শাপলা চত্বর থেকে নটরডেম কলেজ পর্যন্ত সড়কেরও একই চিত্র। সড়কের কোথাও নেই তিল পরিমাণ খালি জায়গা। গাড়ি সড়কের ওপর রেখেই এসব স্থানে খোশগল্পে মেতে উঠেছেন চালকরা। সেগুনবাগিচা, কাকরাইল, নয়াপল্টন, ফকিরাপুল, ফুলবাড়িয়া, গুলিস্তান, মগবাজার, ফার্মগেট, তেজগাঁও, সাতরাস্তা, মেয়র আনিসুল হক সড়ক, বনানী, গাবতলী, টেকনিক্যাল, মিরপুর ১ ও ১০ নম্বর, ধানমন্ডি, গুলশান, বাড্ডা, নতুনবাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় রাস্তার ওপর বাস রাখার কারণে নগরবাসীর অশান্তির যেন শেষ নেই।
সূত্রে জানা যায়, পার্কিং নৈরাজ্য কমাতে ২০০৭ সালে মহাপরিকল্পনা হাতে নেয় সিটি করপোরেশন। সেটিকে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ওই সময়ে ডিএসসিসির আরবান প্ল্যানিং বিভাগ একটি খসড়াও তৈরি করে। রাজধানীর পার্কিং স্পটগুলোতে কত সংখ্যক গাড়ি পার্কিং করা যায় তাও নির্ধারণ করা হয়। তখন সিদ্ধান্ত হয় নির্ধারিত স্থানে পার্কিং করবে গাড়ি। দিতে হবে টোল। টোল আদায় কর্মীদের অনুমতি ছাড়া রাস্তার পাশে কেউ গাড়ি পার্কিং করতে পারবে না।
তখন আশা করা হয়, এতে গাড়ি পার্কিংয়ের ক্ষেত্রে ফিরে আসবে শৃঙ্খলা, কমে যাবে যানজট। তবে নানা জটিলতায় পার্কিং নিয়ে মহাপরিকল্পনা আটকে যায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সিটি করপোরেশন, রাজউক, ঢাকা ওয়াসা, সওজ, রেলওয়েসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো পার্কিং স্পেস বাড়াতে উচ্ছেদে নামে। সড়ক সংলগ্ন অবৈধ স্থাপনা এবং বহুতল ভবনের কার পার্কিং স্পেস অবমুক্ত করা হয়। তখন বিভিন্ন মার্কেট ও শপিং মলে পার্কিং স্পেস ছেড়ে দেন ভবন মালিকরা। অনেক মার্কেটের আন্ডারগাউন্ডে বাণিজ্যিক কাজে ভাড়া দেয়া স্থাপনা ভেঙে ফেলেন। পরে সরকার পরিবর্তন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যায় সব চিত্র। ফের পার্কিং স্পেস ও আন্ডারগ্রাউন্ড বাণিজ্যিকিকরণ করা হয়।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিবকুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, ঢাকা সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। ট্রাক টার্মিনাল নেই, শহরের ভেতরে আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল গড়ে তোলা হয়েছে। এসব চিত্র পৃথিবীর কোথাও নেই। নগরীর ভেতরে তো পার্কিংয়ের পর্যাপ্ত স্থান নেই। এ ছাড়া বাসের রুট পারমিটেও চরম নৈরাজ্য চলছে। আমরা দুই মেয়র এ বিশৃঙ্খলা বন্ধে উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। অবৈধ পার্কিং ঠেকাতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার মুনিবুর রহমান চৌধুরী বলেন, রাজধানীতে পার্কিংয়ের যথেষ্ট জায়গা নেই। অপর্যাপ্ত পার্কিং স্থানের চাইতে গাড়ির সংখ্যা দ্বিগুণ। সড়কে প্রতিদিনই নতুন নতুন গাড়ি নামে। অথচ পার্কিংয়ের কোনো জায়গা নেই। পরিবহন মালিকদেরও বাস পার্কিং করার নির্দিষ্ট জায়গা নাই। রাজধানীতে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য জায়গা প্রয়োজন ২৫ ভাগ। আছে মাত্র ১০ ভাগ। তাহলে অতিরিক্ত গাড়িগুলো রাখা হবে কোথায়? আমরা নিয়মিত তদারকি করছি। অবৈধ স্থানে পার্কিং করলে জরিমানা করি। এটা সমাধান না।
গাড়ি সড়কে নামানোর আগে পার্কিংয়ের জায়গা আছে কি না সেটা দেখা প্রয়োজন বলে মনে করছেন তিনি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বলছে, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি পার্কিং ব্যবস্থাপনার নীতিমালা দেয়ার কথা। তারা যখন যে নির্দেশনা দিবে সিটি করপোরেশন তা বাস্তবায়ন করবে। পার্কিংয়ের বিষয়ে এখনো সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন পায়নি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএসসিসি’র আরবান প্ল্যানিং বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, অর্থ বরাদ্দ না থাকায় পার্কিং নীতিমালা নিয়ে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না। আমরা একাধিকবার বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছি। সরকার পার্কিং নিয়ে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলে প্রতিবছর এখান থেকে শত শত কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হবে।
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি বলছে, যারা সড়কে গাড়ি নামান, তারা অনুমোদন নেয়ার সময় নিজস্ব পার্কিং জোন দেখান। যদিও পরে সেসব স্থানে গাড়ি পার্কিং করা হয় না। ফলে সড়কের ওপর অবৈধভাবে পার্কিং করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করেন। গাড়ি রেখে যারা সড়ক দখল করবে বিআরটিএ আইন অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সড়ক


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ