বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে অনুগ্রহস্বরূপ প্রাপ্ত অর্থ-সম্পদ একজন আল্লাহবিশ্বাসী মুমিন ব্যক্তি তো আল্লাহর সন্তুষ্টির পথেই ব্যয় করবে। যে কাজে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন, যে কাজে তাঁর বিধান লঙ্ঘিত হয়, সে কাজে মুমিন কী করে আল্লাহর দেয়া নিআমত ও রিযিক নষ্ট করবে? তাই মুমিন ব্যক্তি তার প্রতিটি অর্থ ব্যয়ের জন্যেই পুরস্কৃত হবে মহান আল্লাহর দরবারে। হাদীসে স্পষ্ট করা হয়েছে-স্ত্রীর জন্যে সে যে খাবারের ব্যবস্থা করেছে, যা তার ওপর আরোপিত এক অপরিহার্য দায়িত্ব, সেটাও তার জন্য সদকা। আরেকটি হাদীস লক্ষ করুন, এর ভাষ্য আরো পরিষ্কার, আরো আলোছড়ানো।
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : একটি দিনার তুমি আল্লাহর রাস্তায় (জিহাদে) ব্যয় করেছ, একটি দিনার তুমি দাসমুক্তির জন্য ব্যয় করেছ, একটি দিনার তুমি কোনো মিসকীনকে সদকা করেছ, আরেকটি দিনার তুমি তোমার পরিবার-পরিজনের জন্য ব্যয় করেছ। এসবের মধ্যে সর্বাধিক প্রতিদান সেটাতেই পাওয়া যাবে, যা তুমি তোমার পরিবার-পরিজনের জন্য ব্যয় করেছ। (সহীহ মুসলিম : ৯৯৫)।
আমাদের আলোচ্য হাদীসটিতে সেরা দানের পরিচয়ে বলা হয়েছে-নিজের সচ্ছলতা ঠিক রেখে যে দান করা হয় সেটাই সেরা দান। প্রথম কথা হলো, নিজের পরিবার-পরিজনের প্রয়োজন পূরণে যে অর্থ ব্যয় করা হয় সেটার সওয়াবই সবচেয়ে বেশি। এটাও একপ্রকার সদকা, একপ্রকার দান। এটা যেহেতু শরীয়তের পক্ষ থেকেই আরোপিত এক দায়িত্ব, যা অবহেলা কিংবা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই, সঙ্গত কারণেই তাতে সওয়াব বেশি হওয়াটাও স্বাভাবিক। আর পরিবার ও অধীনস্তদের বাইরে যখন কাউকে দানের প্রসঙ্গ আসে, তখন ততটুকুই দান করো, যেন তোমার ওপর আরোপিত দায়িত্ব পালনে, তোমার অধীনস্তদের ভরণপোষণ ও অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন পূরণে তুমি আবার অপারগ হয়ে বসে না থাক।
কোনো অভাবী ব্যক্তির সহায়তায় নিজের সবটুকু বিলিয়ে দিয়ে যদি আবার নিজেই অভাবের শিকার হতে হয়, নিজের এবং পরিবার-পরিজনের প্রয়োজন পূরণের জন্য অন্য কারো কাছে হাত পাততে হয়, তবে এ দান ও সহযোগিতা শরীয়তের উদার দৃষ্টিতে কিছুতেই কাম্য হতে পারে না। হযরত জাবের রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদীস-একবার আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সঙ্গে ছিলাম। এক লোক তখন ডিমের মতো এক টুকরো স্বর্ণ নিয়ে এসে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! খনি থেকে আমি এটা পেয়েছি। এটি ছাড়া আমার আর কিছুই নেই। আপনি এটি গ্রহণ করুন। এটি সদকা।’
একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা.) মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। লোকটি তখন ডান দিক দিয়ে এসে একই কথা বলল। রাসূলুল্লাহ (সা.) আবার মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। এবার সে বাম দিক থেকে এলো। এবারও রাসূলুল্লাহ (সা.) মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। লোকটি এরপর পেছন দিক থেকে কথা বলল। রাসূলুল্লাহ (সা.) তখন তার হাত থেকে ওই টুকরোটা নিয়ে তার দিকেই ছুড়ে মারলেন। যদি তার গায়ে লাগত, তবে সে মারাত্মক ব্যথা পেত।
এরপর রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন : তামাদের কেউ কেউ নিজের মালিকানাধীন সবকিছু নিয়ে এসে বলে-এসব সদকা। এরপর সে মানুষের কাছে হাত পেতে বসে থাকে। সর্বোত্তম সদকা তো সেটাই, যা সচ্ছলতা বজায় রেখে করা হয়। (সুনানে আবু দাউদ : ১৬৭৫)।
কার্পণ্য করা যাবে না। দান করা থেকে সবসময় হাত গুটিয়ে রাখা যাবে না। কোনো উপলক্ষ যখন আসে, সাধ্যমতো সেখানে দান করতে হবে। পরিমাণে তা কম-বেশি যা-ই হোক। এটা মুমিনের গুণ, মুমিনের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু তাই বলে নিজেকে অভাবের মুখে ঠেলে দিয়ে সবকিছুই দান করে দেয়া-এটাও ইসলামের শিক্ষা নয়। অবশ্য কেউ যদি এতটাই সংযমী ও ধৈর্যশীল হয়, সবকিছু বিলিয়ে দিয়েও নিজের অভাবের কথা, প্রয়োজনের কথা অন্য কারো কাছে প্রকাশ করবে না, আল্লাহ তাআলার ওপর তার ভরসা যদি এতটাই প্রবল হয় এবং এ নিয়ে তার অধীনস্তদের কোনো প্রকার অনুযোগ না থাকে, তখন সে চাইলে পুরো সম্পদও দান করে দিতে পারে।
তাবুকের যুদ্ধের প্রাক্কালে হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. এমনটাই করেছিলেন। নবীজী (সা.) সে দান গ্রহণও করেছিলেন। আবার তিনিই অবস্থার ভিন্নতাকে আমলে নিয়ে কোনো কোনো সাহাবীর পুরো সম্পদ দান হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। দান-সদকার ক্ষেত্রে ভারসাম্যের এ শিক্ষাটি কোরআনে কারীমের আরেকটি স্থানেও আলোচিত হয়েছে। সেখানকার উপস্থাপন অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত, মাত্র একটি শব্দে, কিন্তু এতে নিহিত রয়েছে অর্থের ব্যাপকতা। সাহাবায়ে কেরাম নবীজী (সা.) কে জিজ্ঞেস করতেন-তারা কোন্ সম্পদ দান করবে? এ প্রশ্নটি উল্লেখ করে আল্লাহ তাআলা জানিয়ে দিয়েছেন : আপনি বলে দিন, যা (তোমাদের প্রয়োজনের) অতিরিক্ত। (সূরা বাকারা : ২১৯)।
কথা সহজ-প্রথমে নিজের এবং নিজের পরিবারস্থ প্রতিপাল্য যারা তাদের হক আদায় করো। এরপর যদি কিছু সম্পদ হাতে থেকে যায়, সেখান থেকে দান করো অভাবী-অসহায়দের, শরীক থাকো কল্যাণকর কাজে। মনে রাখতে হবে-নফল ও ঐচ্ছিক এ দানের জন্যে কিছুতেই ফরয ও অবধারিত হক লঙ্ঘন করা যাবে না। ভারসাম্যের এ পথে যে দান, সেটাই সেরা দান।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।