Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

এয়ারগান নিষিদ্ধকরণ: বন্য পাখিদের রক্ষায় এই সিদ্ধান্ত কতটা প্রভাব ফেলবে?

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২০ ডিসেম্বর, ২০২১, ৫:৫২ পিএম

বাংলাদেশে এয়ারগানের ব্যবহার ও বহন নিষিদ্ধ করার কারণে কমে আসবে নির্বিচারে পাখি ও বন্যপ্রাণী হত্যা। পরিবেশবাদী এবং পাখি ও বন্যপ্রাণী গবেষকরা সরকারের এমন পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন।

গত ১৪ই ডিসেম্বর একটি প্রজ্ঞাপনে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় জানায়, দেশের জীব-বৈচিত্র্য, পাখি ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ নিশ্চিত করতেই এয়ারগান ব্যবহার ও বহন নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়, পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত কার্যকর থাকবে।

তবে এখানে শর্ত হিসেবে বলা হয়েছে যে, শুটিং-ক্লাব ও বনাঞ্চল-সংলগ্ন এলাকায় বাসকারী জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে না। এসব জনগোষ্ঠীর সদস্যরা তাদের নিরাপত্তা, দৈনন্দিন প্রয়োজন ও সামাজিক প্রথার কারণে এয়ারগান ব্যবহার করতে পারবে।

এ বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব দীপক কুমার চক্রবর্তী জানান, ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইনেই এয়ারগান ব্যবহার ও বহন নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে। সেটিই এখন প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করা হলো।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক মনিরুল খান এই নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। তার মতে, এই নিষেধাজ্ঞা যথাযথভাবে কার্যকর করা হলে পাখিসহ বন্যপ্রাণী নিধন কিছুটা হলেও কমবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে আগ্নেয়াস্ত্র ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে লাইসেন্স দরকার হলেও এয়ারগান কিনতে কোন ধরণের লাইসেন্স দরকার হয় না।

আর এ কারণেই বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মানুষ তেমন কোন বাধা ছাড়াই এয়ারগান কিনে নানা ধরণের পাখি ও বন্যপ্রাণী শিকার করতো। এই ধারা চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে। তিনি বলেন, "বন্যপ্রাণী অবৈধ শিকারের ক্ষেত্রে এয়ারগানের একটা ভূমিকা ছিল। গ্রামে-গঞ্জে যত্রতত্র পাখি শিকারের জন্য এটি ব্যবহার হতো। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এটা সঠিক সিদ্ধান্ত।"

এয়ারগানের ব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব হলে এর মাধ্যমে পাখির শিকার নিয়ন্ত্রণে আসবে বলেও মনে করেন তিনি। তবে পাখি এবং বন্যপ্রাণী রক্ষা করতে হলে এ ধরণের পদক্ষেপ ছাড়াও বন্যপ্রাণীদের প্রাকৃতিক আবাস্থলও সংরক্ষণ করাটা জরুরী বলে মনে করেন প্রাণীবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক মনিরুল খান।

পাখি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করেন লেখক শরীফ খান। এয়ারগানের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার বিষয়ে নানা সময়ে লেখালেখি ছাড়াও এ নিয়ে নানা কাজ করেছেন তিনি। মি. খান বলেন, শুধু এয়ারগানের ব্যবহার নিষিদ্ধ নয়, বরং এগুলো জব্দ করে সরকারি হেফাজতে রাখা উচিত। তার মতে, পাখি এবং ছোটখাটো বন্যপ্রাণী নিধনের ক্ষেত্রে এয়ারগান অন্যতম একটি হাতিয়ার।

শরীফ খান বলেন, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা যেমন কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ফরিদপুর এলাকায় এয়ারগান ব্যবহারের হার অনেক বেশি। তার মতে, এক সময় গ্রামাঞ্চলে খাদ্য হিসেবে মাংসের একটি উৎস ছিল পাখি। কিছু কিছু পাখি খাওয়ার জন্যই শিকার করা হতো।

তবে এয়ারগানের ব্যবহার বাড়ার কারণে যেসব পাখি খাওয়া যায় না সেসব পাখি যেমন, শালিক, দোয়েল, কাঠ-ঠোকরা, এগুলোও শিকার করা হয়। "প্রয়োজন নয়, বরং এয়ারগান হাতে আছে, খেলার ছলেই উঠানে আসা শালিকটাকে গুলি করে মেরে ফেললো, এমন ঘটনা অহরহ," বলেন তিনি।

এয়ারগান সহজলভ্য হওয়ায় এবং এর গুলির দাম কম হওয়ার কারণে যে কেউ এটি কিনে ব্যবহার করে থাকেন। এছাড়া এয়ারগান দিয়ে গুলি করাও অনেক সহজ। মি. খান বলেন, ১০ বছরের বেশি বয়সী যে কেউ এয়ারগান চালাতে পারেন। আর নিশানা সঠিক করতে দু-তিন দিনের প্রশিক্ষণই যথেষ্ট।

তবে এর রেঞ্জ কম। ১৫-২০ ফুট দূরত্বে থাকা পাখি বা প্রাণী মারা যায় এর মাধ্যমে। শরীফ খান জানান, এয়ারগানের পাশাপাশি আরেকটি অস্ত্র রয়েছে যেটি পয়েন্ট ২২ বোর রাইফেল নামে পরিচিত - সেটিও পাখি মারার কাজে ব্যবহৃত হয়। এটি দিয়ে নিশানা নিখুঁত হয়, মাটিতে বসিয়ে বেশ দূর থেকে গুলি করা যায়। তবে এ রাইফেলের গুলির দাম তুলনামূলক বেশি হওয়ার কারণে এর ব্যবহার এয়ারগানের মতো এতো প্রকট নয়।

বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৬শতাধিক প্রজাতির পাখি রয়েছে। তবে এদের মধ্যে অন্তত ২০০ প্রজাতির পাখি পরিযায়ী। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজার্ভেশন অব নেচার এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সম্প্রতি বছরগুলোতে ১৯ প্রজাতির পাখি বিলুপ্ত হয়েছে।

পাখি গবেষক শরীফ খান বলেন, এয়ারগানের যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণেই আশেপাশের পরিবেশের পরিচিত পাখি নির্বিচারে মেরে ফেলা হচ্ছে। শীতকালে যেসব কাদাখোঁচা জাতীয় পাখি আসে - সেগুলো সবই এয়ারগান দিয়েই শিকার করা হয়। তবে যেসব পাখির মাংস খাওয়া যায় সেগুলোই সবচেয়ে বেশি মারা হয় । যেমন, তিন প্রজাতির ঘুঘু, ডাহুক, বক, বুনো বা জালালী কবুতর, পরিযায়ী বিভিন্ন ধরণের পাখি, কয়েক প্রজাতির কেরেক বা খেনি, গাঙচিল ইত্যাদি পাখি।

তবে যেসব পাখি খাওয়া যায় না যেমন, মাছরাঙা, চড়ুই, বাবুই বা বসন্তবৌরির মতো পাখিও মেরে ফেলা হয় এয়ারগান ব্যবহার করে। "শুধু কাক হয়তো বাদ দেয়, এছাড়া সামনে যা পায় তার সবই মেরে ফেলে," বলেন তিনি। শুধু পাখিই নয়, প্রতিবেশে থাকা ছোট প্রাণী যেমন বেজি, গুঁইসাপ, গাছ-খাটাইশ নামে প্রাণী মারতেও এয়ারগান ব্যবহার করা হয়।

শরীফ খান বলেন, "এসব প্রাণী গর্তে বা গাছের কোটরে বাস করে এবং বাচ্চা দেয়। একটা মা-প্রাণীকে মারলে তার বাচ্চাগুলোও মরে যায়। সেগুলো কেউ খেয়াল করে না।" বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, পাখি ধরা, মারা এবং পোষা নিষেধ। তবে এটির ব্যবহার তেমন নেই বলেই মনে করেন মি. খান। তিনি বলেন, সিলেট, মৌলভীবাজারসহ হাওর অঞ্চলগুলোতে নানা ভাবে পাখি শিকার করা হয়। যেগুলোর মধ্যে এয়ারগানের ব্যবহার ছাড়াও আরো রয়েছে জাল বা ফাঁদ পাতা।

হাওর এলাকায় বিভিন্নভাবে পাখি ধরে সেগুলো অবৈধভাবে কেনা-বেচা করার অভিযোগও রয়েছে। এই পাখি গবেষক মনে করেন, পাখিদের রক্ষা করতে হলে এয়ারগান নিষিদ্ধ এবং জব্দ করা, হাওর পুলিশ গঠন এবং সামাজিক পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। সূত্র: বিবিসি বাংলা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ