বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
গত আলোচনায় উল্লেখিত সূরা মায়েদাহ’র আয়াতটি নাজিল হওয়ার পূর্বেই সূরা বাকারা এর ২১৯ নং আয়াত নাজিল হয়, যাতে বলা হয়: ‘লোকে তোমাকে মদ ও জুয়া সর্ম্পকে জিজ্ঞাসা করে, বল, উভয়ের মধ্যে আছে মহাপাপ এবং মানুষের জন্য উপকারও ,কিন্তু উহাদের পাপ উপকার অপেক্ষা অধিক।’ এ আয়াতে মদ ও জুয়া হারাম করা হয়নি এগুলো পরিত্যাগ করার উপদেশ দেয়া হয়েছে মাত্র। কিন্তু সূরা মায়েদাহ এর আয়াতে সরাসরি হারাম করা হয়েছে।
মদ, জুয়া, অশ্লীলতা তথা ইসলামবিরোধী এবং এ ধরনের নানা অপরাধপ্রবণতা মানুষের উত্তম ও সৎ গুণগুলোকে ধ্বংস করে দেয়ার কারণ হয়ে থাকে। আর যখন সৎগুণগুলো লোপ পেয়ে যায় তখন মানুষ নৈতিক অবক্ষয়ের শিকার হয় এবং শয়তানের প্ররোচনায় প্রলুব্ধ হয়ে যে কোনো অন্যায় কাজ করতে দ্বিধাবোধ করে না।
অর্থাৎ পাপাচারে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এ কারণেই ইসলাম ঘোষণা করেছে, প্রত্যেক শিশু স্বভাবধর্ম (ইসলামের ওপর) জন্মগ্রহণ করে অতঃপর তার পিতা-মাতা (অভিভাবক) তাকে ইহুদী, খৃষ্টান, মজুসি (অগ্নি উপাসক) বানায়। কোনো কোনো বর্ণনায় ‘মোশরেক’ বানায় বলেও উল্লেখ আছে।
সুতরাং সন্তানের শৈশব-কৈশোর (অসহায়, এতীম) যদি পিতা-মাতা, অভিভাবক , শিক্ষক-গুরুর তত্ত্বাবধানে থেকে লালিত-পালিত হওয়ার সুযোগ লাভ করতে সমর্থ হয় এবং সৎ, সঠিক পথে থেকে বড় হতে পারে তবে পরবর্তী জীবন পর্যায়গুলো ধাপে ধাপে সঠিক পথে থেকে সৎজীবন গড়ে তুলতে পারে এবং উঠতি তারুণ্য জীবন কলুষিত কলংকৃত হতে পারে না।
হাদীসে আছে, ‘আছছোহবাতু মোতাআস্সেরাতুন’ অর্থাৎ সান্নিধ্য-সংস্রব প্রভাব বিস্তারকারী। এ ক্ষুদ্র বাক্যটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এ সান্নিধ্য-সংস্রব কেবল শিশু-কিশোর, তরুণ-যুবকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় বরং আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বিশেষভাবে কিশোর-তরুণ-যুবক শ্রেণির এ উঠতি জীবনে তাদের বেশি সময় যাদের সাথে ব্যয় করতে হয়, তাদের মধ্যে নানা শ্রেণির লোকের সাথে মেলামেশা করার সময় ও সুযোগ যথেষ্ট থাকে।
সমবয়সী সঙ্গী-সাথী, সহপাঠী, শিক্ষক এবং সমাজের নানা বয়সী, নানা শ্রেণির তাদের সান্নিধ্য-সংস্রবের যেমন সুফলও আছে তেমনি কুফলও আছে। এ ব্যাপারে পিতা-মাতা, অভিভাবক মহল অসতর্ক-উদাসীন থাকলে সৎ ও চারিত্রিক গুণাবলি অর্জনে সন্তানদের ভবিষ্যৎও হুমকির মুখে পতিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কেননা কমবয়সী, কোমলমতি ছেলে-মেয়েরা বিশেষভাবে তাতে প্রভাবিত হয়ে থাকে। এ কারণে বিশেষভাবে সকল শ্রেণির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্তৃপক্ষগুলোর দায়িত্ব পিতা-মাতা, অভিভাবকদের চেয়ে বহুগুণ বেশি।
কেননা তাদের দায়িত্ব এবং গুণাবলি তাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে অধিক প্রভাব বিস্তার করে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর প্রতি শিক্ষকের দায়িত্ব অতি গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূর প্রসারী। কেবল পাঠ্যসূচিভুক্ত পুঁথিগত শিক্ষা শেখানোই যথেষ্ট নয়, শিক্ষক তার ছাত্রদের আদব-কায়দা, চাল-চলন, আচার-ব্যবহার প্রভৃতির প্রতি সজাগ সতর্ক না থাকলেই বিপদ। এ প্রসঙ্গে ফারসি বিখ্যাত সাধক কবির এই উক্তি স্মরণযোগ্য: ‘ছোহবতে ছালেহ তোরা ছালেহ কুনাদ/ছোহবতে তালেহ তোরা তালেহ কুনাদ’।
অর্থাৎ নেক (সৎ) লোকের সংস্রবে থাকলে তুমি নেক (সৎ ) হতে পারবে আর মন্দ (অসৎ) লোকের সান্নিধ্য-সংস্রবে থাকলে, মন্দ-অসৎ হবে। তবে একথা সত্য যে, সৎ লোক বাছাই করতে ও সতর্কতার প্রয়োজন, শয়তান সকলের পেছনে লেগেই থাকে, তার কুপরামর্শ, কুমন্ত্রণা ও প্ররোচনা, প্রতারণার শিকার হয়ে বিভ্রান্ত হওয়ার হাজারো পথ খোলা রয়েছে। মানুষকে পাপাচারে লিপ্ত করে অপরাধকে সুসজ্জিত করে দেখানো শয়তানের কর্ম।
আগেকার দিনে দেখা যেতো মসজিদ, মক্তব ও ঘরোয়া পরিবেশে মুসলিম ঘরোনাগুলোতে প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল। এখন সে ব্যবস্থা একেবারে বদলে গেছে বা পরিবর্তিত হয়ে গেছে বলে দাবি করা যাবে না, তবে সকাল বেলায় কায়দাহ-কোরআন সাথে করে মক্তব গমনের ঐতিহ্যবাহী রেওয়াজের আমুল পরিবর্তন ঘটেছে, এ দাবি জোরের সাথে করা যায়।
কারণ পরিবর্তীত আধুনিক যুগে মুসলিম পরিবারের কচি বয়সী ছেলে-মেয়েরা একগাদা বই-খাতা ব্যাগ ভর্তি করে পিঠে ঝুলিয়ে কিন্ডার গার্টেন ও কোচিং সেন্টারগুলোর দিকে ছোটে। বিশেষত: রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় এরূপ দৃশ্য কারো দৃষ্টির আড়ালে নয় এবং দিনের বাকি সময় ও রাত পর্যন্ত কোচিং পরিবেশ ও অবশিষ্ট সময় হাতে মুখে দেখা যায় মোবাইল ।
সমাজ অপরাধ অসংখ্য শাখা-প্রশাখা নিয়ে বিরাজমান। ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার তীব্র অভাবের কারণে অপরাধপ্রবণতা প্রবল আকার ধারণ করে চলছে। শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীদের শুরু থেকে প্রয়োজনীয় ধর্মীয় শিক্ষা দেয়া যেমন বাবা-মা ও মুরব্বীদের প্রধান কর্তব্য, তেমনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠ্যসূচির সাথে নৈতিক শিক্ষা প্রদান ও অভ্যস্ত করানোর দায়িত্ব শিক্ষকগণ এড়িয়ে যেতে পারেন না। অপরাধপ্রবণতা রোধ করতে হলে উপরোক্ত বিষয়গুলো অবশ্যই সকলের বিবেচনায় রাখা উচিত। কোরআনী শিক্ষার অনুসরণই অপরাধপ্রবণতা রোধ করতে পারে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।