বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
বাস্তবতার জ্ঞান না থাকায় বর্তমানে আমাদের সমাজে ধার্মিকতাকে কিছু মুসলমান নিছক আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে ফেলেছেন। দুনিয়া উল্টে গেলেও তিনি তার ঐচ্ছিক ইবাদত ছেড়ে নড়বেন না। তার মা ওষুধ আনতে বলেছেন। বাবাকে ডাক্তারখানায় নিতে হবে। স্ত্রীকে বাজার সওদা দিতে হবে। পুত্রকন্যাদের লেখাপড়ায় সহায়তা করতে হবে। তার বোন-ভাগ্নিরা তাকে দেখতে এসেছে, ভাই-ভাতিজারা সাক্ষাৎ করতে এসেছে, কিন্তু তার সময় হচ্ছে না। তিনি তার ধারণা অনুযায়ী দ্বীনের কাজে, জিকির ওজিফা তিলাওয়াতে বা মোরাকাবায় বসে আছেন। অথচ মাতা-পিতার চাহিদা পূরণ ও আত্মীয়দের হক আদায় করা ছিল তার ওপর ওয়াজিব।
তাদের দেখা দেয়া, হাল অবস্থা জানতে চাওয়া, সুখ-দুঃখের খবর নেয়া জরুরি ছিল। তারা ভাই, চাচা বা মামার দেখা ও সান্নিধ্য পেয়ে যে মানসিক শান্তিটুকু লাভ করত, সেটি তাদের পাওনা। অনেক ক্ষেত্রে তো দেখা যায় এই ধার্মিক ভাই, চাচা বা মামাটি এসব আত্মীয়ের পাওনা উত্তরাধিকার না দিয়ে আটকে রেখেছেন। এমন হলে তো তার ষোলআনাই মিছে।
ওয়ারিশানদের পাওনা আদায় না করে তিনি যে অপরাধ করেছেন এর ফলে তার কোনো ইবাদত-বন্দেগিই কবুল হচ্ছে না। আর যদি পাওনা দিয়েও থাকেন তারপরও তাদের মন খুশি করা তার দ্বীনি দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। হাশরের দিন বহু লোক ক্ষমা লাভ করে জান্নাতে যাওয়ার জন্য রওনা হবে, কিন্তু আত্মীয়তার হক আদায় না করার ফলে তাদের আটকে দেয়া হবে। আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করা কবিরা গোনাহের অন্তর্ভুক্ত। হাশরের দিন এই বন্ধন আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে এই বন্ধন ছিন্নকারীর বিচার চাইবে এবং তাকে জাহান্নামে নিয়ে ছাড়বে।
পিতা-মাতা, ভাই-বোন, চাচা-ফুফু, মা-খালা ও তাদের দ্বারা অর্জিত ভাই-বোন ও তৎনিম্নবর্তী আত্মীয়তা রক্ষা করা, পরিচর্যা করা ইসলামের অপরিহার্য বিধান। অন্যপক্ষের আচরণে অনেক সময় এ বন্ধন ছিন্ন ও নষ্ট হয়ে যায়। তাই নিজ দায়িত্বে ক্ষমা উদারতা দয়া ও বহু ছাড়ের মাধ্যমে এসব আত্মীয়কে জড়িয়ে রাখা সীমাহীন সওয়াবের কাজ। এসব বন্ধন নষ্ট করা হারাম ও কবিরা গোনাহ। জাহান্নামে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
অনেক মানুষ না জানার কারণে এসব বন্ধন ছিন্ন করে। কিছু মুসলমান অজ্ঞতা ও অসচেতনতার জন্য এ মহা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে অবহেলা করা সত্তে¡ও নিজেকে ধার্মিক ও আল্লাহর প্রিয় ব্যক্তি বলে মনে করছে। সে তার মনগড়া দ্বীনি কাজ ও ঐচ্ছিক ইবাদতের তুলনায় এসব জরুরি কাজকে কিছুই মনে করছে না।
বৃদ্ধ পিতা-মাতা, ছোট শিশু, অন্তঃসত্ত্বা রুগ্ন স্ত্রীকে ফেলে রেখে ধর্মকর্মে ডুবে থাকে। শরিয়তের বাইরে গিয়ে এরা ধার্মিক হওয়ার দোহাই দিয়ে অসামাজিক হয়ে যাচ্ছে। রোগী দেখতে যায় না। কেউ অসুবিধায় পড়লে তার খোঁজখবর নেয় না। মানুষের কষ্ট দূর করার কোনো স্পৃহা তাদের থাকে না। কঠিন কাজকর্ম অন্যদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে সে ওজিফায় মগ্ন থাকে। ফাঁকিবাজ বা ধূর্ত প্রকৃতির এসব লোক অন্যদের দ্বারা প্রাপ্ত ও অর্জিত সুবিধাগুলো আবার ঠিকই ভোগ করে। মৃতের জানাজায় যায় না। দাফন-কাফনে অংশ নেয় না। প্রতিবেশীর বিপদে এগিয়ে যায় না। তাদের হক আদায় করে না। পরিবার ও সমাজের কোনো কাজেকর্মেও তারা আগ্রহী নয়। সামাজিক অনুষ্ঠানাদি এড়িয়ে চলে।
অঘোষিত এক বৈরাগ্যবাদ তাদের ঘিরে ধরে থাকে, যা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ মহানবী সা. বলেছেন, উত্তম মানুষ সে-ই, যে অন্য মানুষের উপকারে আসে। অন্য হাদিসে আছে, আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি সে-ই, যে তার সৃষ্টিকুলের জন্য বেশি উপকারী। অপর এক হাদিসে মহানবী সা. বলেছেন, যে মুমিন ব্যক্তি মানুষের সাথে মিশে এবং তাদের দেয়া দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে সে আল্লাহর নিকট ভালো এবং অধিক প্রিয়, সেই ব্যক্তির চেয়ে যে মানুষের সাথে মিশে না এবং তাদের দেয়া দুঃখ-কষ্টও সহ্য করে না (আল হাদিস)।
জীবনকে বাদ দিয়ে ধার্মিক হওয়া যায় না। দায়িত্ব এড়িয়ে আল্লাহকে খুশি করার কোনো শর্টকার্ট রাস্তা নেই। অজ্ঞতা থেকে বেরিয়ে এসে সচেতন হয়ে সব মুসলমানকে প্রকৃত ধার্মিক হতে হবে। নিজের ইচ্ছামতো ধার্মিকতার নতুন সংজ্ঞা তৈরি করে আল্লাহকে রাজি করা যাবে না। মহানবী সা.-এর সুন্নতের বাইরে কোনো ধার্মিকতা নেই।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।