বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
আমাদের দেশে প্রতারণার ঘটনাবলি খুবই আলোচিত। সমাজের নানাস্তরে নানা অভিনব উপায় ও কলা-কৌশলে প্রতারণার বিস্তার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে অসংখ্য মানুষ প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে নানাভাবে হয়রানির সম্মুখীন হওয়া ছাড়াও আর্থিকভাবে (ক্ষতিগ্রস্ত) হয়, সর্বস্ব হারায়, এমনকি প্রাণ হারানোর মতো মর্মান্তিক ঘটনারও শিকার হয়। প্রতারণা, ধোঁকাবাজি, শয়তানি কর্ম-কান্ডেরই অংশ। মানুষ লোভ-লালসার বশবর্তী হয়ে এ অপকর্মে লিপ্ত হয়ে বস্তুত তারা (ইবলিশ) শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে থাকে। শয়তান মানুষকে বিপদগামী ও বিভ্রান্ত করার জন্য সকল অস্ত্র-উপকরণের যোগান দিতে সিদ্ধহস্ত। ঠকবাজি-প্রতারণা, জালিয়াতি, মিথ্যাচার প্রভৃতি কার্য-কলাপের দিকে মানুষকে ধাবিত করা, উৎসাহিত করা এসবই শয়তানি কাজের অন্তর্ভুক্ত। একশ্রেণির মানুষ অজ্ঞতা, মুর্খতা, অসতর্কতা, অন্যদিকে সততা, নৈতিকতা ইত্যাদি সৎগুণের অভাবে শয়তানের প্ররোচনায় আকৃষ্ট হয়ে নিজেদের সর্বনাশ করে।
দুনিয়াতে ‘হিজবুল্লাহ’ ও ‘হিজবুশ শয়তান’ নামের দুইটি দল আছে বলে আল্লাহ’তালা কোরআনে ঘোষণা করেছেন এবং দুইটি দলের পরিচয়ও তুলে ধরেছেন। হিজবুল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর দলের লোকদের শয়তানের দল কোনো ক্ষতি করতে পারবে না এবং শয়তানের দলের সাথে দ্ব›দ্ব-সংঘর্ষে আল্লাহর দলই সর্বদা জয়ী থাকবে বলেও আল্লাহর ঘোষণা রয়েছে। কারা আল্লাহর দলের অন্তর্ভুক্ত, সে বিবরণও কোরআনে বিদ্যমান। আম্বিয়ায়ে কেরাম থেকে আরম্ভ করে হক্কানী উলামা, আওলিয়া, পীর-মাশায়েখ, সাধক-বুর্জুগানে দ্বীন আল্লাহর দলভুক্ত। শয়তান তাদেরকে প্ররোচিত করতে কখনো সক্ষম নয়। কিন্তু তাদের পেছনে অভিশপ্ত শয়তান সর্বদা লেগেই থাকে এবং তাদেরকে বিভ্রান্ত করতে সর্বদা সচেষ্ট থাকে। সকল নবীর যুগে তাদেরকে বিভ্রান্ত করতে চরমভাবে ব্যর্থ হলেও সে তার দলের শাদ্দাদ, নমরুদ, কারুন, ফেরাউন প্রভৃতি কুখ্যাতদের ধ্বংসের কারণও হয়েছিল।
নবুওয়াত যুগ সমাপ্তির পর থেকে অভিশপ্ত শয়তানের পথের প্রধান বাধা না থাকলেও ‘ওয়ারাছাতুল আম্বিয়া’ তথা নবীগণের উত্তরসূরি মাশায়েখ-উলামা শয়তানের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ান। কিন্তু শয়তান তার চিরাচরিত কর্মকৌশল ও প্রতারণার অপতৎপরতা বাস্তবায়নের ধারাবহিকতাকে অধিক সক্রিয়কারে এবং আওলিয়া-উলামাকে তার শিকারের লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত করে, যা চলমান। শয়তান কিভাবে তাদের পিছনে লেগে থাকে সে সর্ম্পকে বিশেষজ্ঞগণের বিভিন্ন মত রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ প্রখ্যাত ইমাম শায়খ আবু মোহাম্মদ আব্দুল মোতীর অভিমতটি এখানে তুলে ধরা হলো। শয়তান আওলিয়াকে কিভাবে বিভ্রান্ত করে তার পরিচয় দিয়েছেন তিনি এইভাবে-
‘বাযা’ নামক এক শয়তান ‘আওলিয়ায়ে ওয়াছীলিন’কে গোমরাহ করে। তা এইভাবে, যখন ক্ষুধার তাড়নায় তাদের আত্মা শুকিয়ে যায়, তখন এ শয়তান নূর ও রোশনির আকার ধারণ করে গৃহের সর্বত্র আলোকিত করে। এ আলোক দেখে ধোঁকায় তাকে আল্লাহর নূর মনে করতে থাকে, যা বাস্তবে শয়তানি নূর। সুতরাং শয়তানি প্রতারণা ধোকার কোনো সীমা নেই, হাজারো প্রকারের প্রতারণার সে অদ্বিতীয়। তার এ সর্বনাশা উৎপাত ও অপতৎপরতার যে কেউ, যে কোনো সময় শিকার হতে পারে। এ অভিশপ্ত শয়তান পীরানে পীর, গওসূল আজম হজরত আব্দুল কাদের জীলানী (রা.)-কে পর্যন্ত প্রতারিত করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল। তিনি খোদ ঘটনাটি এইভাবে বর্ণনা করেছেন :
‘একটি সফরে তীব্র গরমে আমার ভীষণ পিয়াস অনুভ‚ত হয়। এ সময় দেখতে পাই আকাশে কালো মেঘ ছেয়ে গেছে, শীতল বাতাস বইতে থাকে। এ সময় একটি গায়েবী আওয়াজ শুনতে পাই, ‘হে আব্দুল কাদের! আমি তোমার প্রভু! আমি জবাব দিলাম, তুমি আল্লাহ যে ‘লা ইলাহা ইল্লাহু, অর্থাৎ সে ব্যতীত কোনো মাবুদ নেই ! অতঃপর আওয়াজ আসে হে আব্দুল কাদের! আমি তোমার প্রভু এবং আমি তোমার জন্য হালাল করে দিয়েছি, যা তোমার জন্য হারাম করেছিলাম। আমি জবাব দিলাম, তুই মিথ্যাবাদী, বরং তুই শয়তান। একথা শ্রবণ করা মাত্র ওই কালো মেঘ বিলীন হয়ে যায়। তখন আমার পেছনে হতে আওয়াজ আসে, হে আব্দুল কাদের! আজ তুমি খোদা প্রদত্ত বোধশক্তি দ্বারা নাজাত পেয়ে গেলে, তোমার পূর্বে আমি সত্তর ব্যক্তিকে এভাবে গোমরাহ করেছি।
এ ঘটনা প্রমাণ করে যে, শয়তান যে অভনব কৌশল-প্রতারণার মাধ্যমে পীরানে পীরকে বিভ্রান্ত করতে চেয়েছিল। তার উপস্থিত খোদা প্রদত্ত বোধশক্তি তাকে রক্ষা করে। দুনিয়াতে এরূপ খাঁটি ওলিগণের বদৌলতে দুনিয়া টিকে আছে, নতুবা শয়তানী রাজত্বে মানুষকে বাস করতে হতো। শয়তানি কার্য-কলাপ ও অপকর্ম ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকতো না। খাঁটি হাক্কানী মাশায়েখ-উলামার অস্তিত্ব তাগুতী শক্তি তথা শয়তানের বড় প্রতিবন্ধক, তথাপি শয়তানের খপ্পরে পড়ে যারা পাপাচারে লিপ্ত হয়, শয়তান তাদেরকে নিয়ে গর্ববোধ করবে, তাই স্বাভাবিক।
কেবল অদৃশ্য বা অশরীরি শক্তি শয়তানের দলরূপে সীমবদ্ধ নয়, এ দলে দুষ্ট দানব-মানবও রয়েছে। ‘খান্নাস’ শয়তান জ্বীন ও মানুষকে সর্বদা মন্দ কাজে প্ররোচিত ও উৎসাহিত করে এবং মন্দ কাজকে সৌন্দর্যমন্ডিত ও সুশোভিত করে বলে কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।