বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
বিখ্যাত মনীষী সাহাবী সা‘দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা. বলেন, আল্লাহর রাসূল (সা.) তাকে বলেছেন : তুমি আল্লাহকে রাজিখুশি করার জন্য যে খরচই করবে এর বিনিময় (আল্লাহর তরফ থেকে) পাবে। এমনকি যা কিছু স্ত্রীর মুখে তুলে দাও তারও। (সহীহ বুখারী, কিতাবুল ঈমান : ৫৬)। কারণ, সব কাজে আল্লাহর রেজামন্দির নিয়ত রাখা ঈমানের এক উঁচু বৈশিষ্ট্য। বিখ্যাত তাবেয়ী যুবাইদ ইবনুল হারিছ আলইয়ামী রাহ. বলেন : আমার কাক্সিক্ষত বিষয় এই যে, সব কিছুতেই আমার ‘নিয়ত’ থাকুক; এমনকি আহার-নিদ্রাতেও। (শুআবুল ঈমান ৫/৩৫০; সিফাতুস সফওয়াহ ৩/৯৯)। বলাবাহুল্য, এ যার জীবনাদর্শ তার সকল দৌড়ঝাঁপ হবে নেক আমল, হয়ে উঠবে সফল ও অর্থপূর্ণ। ইবাদত-বন্দেগিকে সপ্রাণ করুন ঈমানের পর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ইবাদত-বন্দেগি।
প্রতিদিনের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, যিকির-তিলাওয়াত, আদইয়ায়ে মাসনূনা, রমজানের ফরজ রোজা, অন্যান্য সময়ের নফল রোজা, যাকাত-সদাকা, হজ¦-কুরবানি, ইতিকাফ ইত্যাদি ইবাদত আমরা সাধারণত আদায় করি। এটি আমাদের কর্মের এক উল্লেখযোগ্য অংশ। এই ইবাদত-বন্দেগিকে যদি সপ্রাণ করা যায় তাহলে জীবনের এই উল্লেখযোগ্য অংশটি হয়ে উঠবে অর্থপূর্ণ, মহিমাপূর্ণ।
হযরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ. তাঁর মূল্যবান গ্রন্থ ‘দুস্তূরে হায়াত’-এ লেখেন- ‘আমরা অনেকেই সহীহ হাদীসে বর্ণিত অযুর দুআ, মসজিদে ঢোকা ও বের হওয়ার দুআ, হাম্মামে যাওয়া, হাম্মাম থেকে বের হওয়ার দুআ, ঘুমানো ও ঘুম থেকে ওঠার দুআ, সকাল-সন্ধ্যার যিকির, সফরে যাওয়ার ও সফর থেকে ফেরার দুআ নিয়মিত পড়ে থাকি; কিন্তু আশঙ্কা জাগে, এই আমলটিও হয়তো উদাসীনতা ও অমনোযোগিতার সাথে, আধুনিক উপমা দিয়ে বললে, অনেকটা টেপ রেকর্ডারের মতো উচ্চারিত হয়।
অর্থাৎ আল্লাহর রাসূল (সা.) এই আমলের যে সওয়াব ও ফযীলত বয়ান করেছেন, আল্লাহর কাছে এর যে গুরুত্ব ও মর্যাদা এবং আখেরাতে এর যে সুফল ও উপকারিতা তার স্মরণ ও আগ্রহ ছাড়াই শুধু মৌখিকভাবে উচ্চারিত হয়ে থাকে। অথচ শরীয়তে আছে ইবাদতের সাথে ইবাদতের সওয়াব ও ফযীলতের স্মরণ ও বিশ্বাসের কথাও। ইসলামের কিছু সর্বজনবিদিত ফরয-ওয়াজিব ইবাদতের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে এই শর্তের উল্লেখ হাদীস শরীফে আছে।
‘সহীহ হাদীসে এই বাণী বর্ণিত হয়েছে : যে আল্লাহর প্রতিশ্রুতিসমূহের উপর বিশ্বাস রেখে, সওয়াবের প্রত্যাশা নিয়ে রমজানের রোজা রাখে তার পেছনের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। (সহীহ বুখারী : ৩৮; সহীহ মুসলিম : ৭৬০)। যে (আল্লাহর প্রতিশ্রুতিসমূহের ওপর) বিশ্বাস রেখে এবং ছওয়াবের প্রত্যাশা নিয়ে শবে কদরে ইবাদত করবে তার পেছনের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে। (সহীহ বুখারী : ১৯০১)।
তো এখানে ‘ঈমান’ ও ‘ইহতিসাব’ অর্থাৎ আল্লাহর প্রতিশ্রুতিসমূহের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস ও ছওয়াবের প্রত্যাশা- এই দুটো বিষয় স্পষ্টভাবে আছে। কিন্তু আমাদের অনেকেই এই গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের দিকে খুব একটা খেয়াল করেন না। অথচ এর মাধ্যমেই কোনো কাজ অভ্যাসবশত করা আর ইবাদত হিসেবে করার মধ্যে পার্থক্য সূচিত হয়। এই বেখেয়ালির কারণে অনেক ইবাদত, এমনকি ইসলামের চার রোকন-সালাত, যাকাত, সওম ও হজ্ব পর্যন্ত পর্যবসিত হয় একটি গতানুগতিক ও প্রাণহীন কর্মে।
‘আম মুসলমানের সাথে সাহাবায়ে কেরাম ও নেককার মুমিনদের পার্থক্যের এক বড় দিক এই স্মরণ ও বিস্মৃতি। অর্থাৎ কুরআন-সুন্নাহয় বর্ণিত এই ফযিলতসমূহের প্রতি তাঁদের থাকে পূর্ণ বিশ্বাস আর হৃদয়ের গভীরে থাকে তা অর্জনের গভীর প্রত্যাশা। ফলে তাদের আমল-ইবাদত সম্পন্ন হয় এই বিশ্বাস ও প্রত্যাশা থেকে এবং এই প্রত্যাশা ও বিশ্বাসের সাথে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।