বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
জীবনকে সফল ও অর্থপূর্ণ করার প্রথম উপায় হচ্ছে, প্রতিটি কাজের নিয়ত ও উদ্দেশ্য ঠিক করা। আর এটাই হচ্ছে মুমিন-জীবনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। কোরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে : বলে দাও, নিশ্চয়ই আমার নামাজ, আমার ইবাদত ও আমার জীবন-মরণ সবই আল্লাহর জন্য, যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক। তাঁর কোনো শরীক নেই আমাকে এরই হুকুম দেয়া হয়েছে এবং আনুগত্য স্বীকারকারীদের মধ্যে আমিই প্রথম। (সূরা আনআম : ১৬২)।
এই যে কোরআনী শিক্ষা- ‘আমার জীবন ও মরণ আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য’, এতেই আছে জীবনের সকল কর্মের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের বর্ণনা। হযরত মাওলানা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ. এক জায়গায় এই আয়াতের ভাব ও মর্ম এভাবে বয়ান করেছেন- ‘মুমিন-জীবনের বিভিন্ন অংশ পরস্পর সাংঘর্ষিক নয়; বরং তা একটি একক, যার সকল অঙ্গে বিরাজমান ইবাদতেও ছওয়াব প্রত্যাশার অভিন্ন প্রাণসত্তা। ঈমান ও ইয়াকীন এবং আল্লাহর হুকুমের তাবেদারিই হচ্ছে সকল কর্মের পথপ্রদর্শক। ইখলাস, সহীহ নিয়ত, আল্লাহ তাআলার রেজামন্দির সত্যিকারের প্রত্যাশা ও আম্বিয়ায়ে কেরামের নির্দেশিত নিয়মে সম্পন্ন হওয়ার দ্বারা জীবনের সকল অঙ্গন এবং কর্ম ও তৎপরতার সকল ক্ষেত্রই ‘ঈমানী যিন্দেগী’র অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। (দুস্তূরে হায়াত)।
সূরাতুল আনআমের এই আয়াত হচ্ছে মুমিন-জীবনের কম্পাস। এরই আলোকে স্থির করুন কর্মের লক্ষ্য ও জীবনের উদ্দেশ্য। অতপর সকল কাজে এই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য স্মরণ ও সজীব রাখুন। কীভাবে স্মরণ করবেন? ব্যক্তিগত ইচ্ছা ও প্রয়োজন পূরণের সাথে আল্লাহর সন্তুষ্টির প্রত্যাশাকে কীভাবে মেলাবেন?
নিছক নীতিগত আলোচনার চেয়ে আমরা বিষয়টি দেখি আমাদের পূর্বসূরিদের বাস্তব জীবন থেকে। আমাদের কাছে তো আছে সর্বোত্তম জীবনাদর্শের জ্যোতির্ময় দৃষ্টান্তরাজি। ঘুম ও বিশ্রামকেও ‘নিয়ত’-এর দ্বারা মহিমান্বিত করার এক চমৎকার দৃষ্টান্ত রয়েছে আল্লাহর রাসূল (সা.) এর বিখ্যাত দুই সাহাবী মুআয ইবনে জাবাল রা. ও আবু মূসা আশআরী রা.-এর একটি কথোপকথনে, যা ইমাম বুখারী রাহ. ‘কিতাবুস সহীহ’-এ বর্ণনা করেছেন।
মুআয ইবনে জাবাল রা. হযরত আবু মূসা আশআরীকে জিজ্ঞাসা করলেন : হে আল্লাহর বান্দা! আপনি কোরআন কীভাবে পড়েন? আবু মূসা আশআরী রা. বললেন : দাঁড়িয়ে, বসে ও শায়িত অবস্থায়। এরপর তিনিও প্রশ্ন করলেন : আচ্ছা আপনি কীভাবে পড়েন হে মুআয! মুআয রা. বললেন : আমি রাতের প্রথম অংশে ঘুমাই। নির্ধারিত সময়ের ঘুম পুরা হবার পর উঠে নামাজে দাঁড়াই এবং কোরআন পড়ি, যে পরিমাণ আল্লাহ আমার জন্য লিখে রেখেছেন। তো আমি আমার ঘুমেও ছওয়াবের আশা রাখি যেমন আশা রাখি আমার নামাজের কারণে। (সহীহ বুখারী : ৪০৮৬, ৪০৮৮)।
আল্লাহর রাসূল (সা.) এর মনীষী সাহাবী মুআয ইবনে জাবাল রা.-এর জীবনাদর্শে পাওয়া গেল ঘুমের মতো প্রাত্যহিক বিষয়কেও উত্তম নিয়তের দ্বারা ছওয়াবের কাজে পরিণত করার নমুনা। পৃথিবীতে আমরা যা কিছু ব্যবহার করি ও উপভোগ করি তার সবই আল্লাহর নিআমত। খাদ্য-পানীয়, আলো-বাতাস ও জীবন যাপনের সকল উপকরণ তাঁরই সৃষ্টি। আমাদের কর্ম-শক্তি ও চিন্তা-শক্তিও তাঁরই দান।
কাজেই এইসকল নিআমতের ব্যবহারে আল্লাহর স্মরণ ও শোকরগোযারি আবশ্যক। আর জীবন জুড়ে সকল কর্মে রয়েছে আল্লাহর বিধান ও তাঁর পছন্দনীয় পন্থা। সেই বিধান ও পন্থার অনুসরণের দ্বারা আমাদের গোটা কর্মজীবনই হয়ে উঠতে পারে মহিমাপূর্ণ। যদ্দুর সম্ভব শুরু করুন খাওয়া-দাওয়া, ঘুমানো; ঘুম থেকে ওঠা, হাম্মামে যাওয়া, বের হওয়া; ঘরে ঢোকা, ঘর থেকে বের হওয়া ইত্যাদি ছোট ছোট প্রাত্যহিক কাজে রয়েছে আল্লাহর রাসূলের সুন্নাহ। তা জেনে আমল করা কঠিন নয়। তবে গুরুত্ব ও আগ্রহ থাকতে হবে।
এছাড়া জীবনজুড়ে অসংখ্য বিষয় আছে, যেখানে শুধু নিয়তের প্রয়োজন। যেমন পরিবার-পরিজনকে সময় দেওয়া, সাক্ষাৎপ্রার্থীর কথা শোনা, মেহমানের সমাদর করা, যা আমরা সাধারণত করে থাকি। এইসব ক্ষেত্রে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির, তাঁর বান্দাদের আনন্দদান ও তাদের হক আদায়ের নিয়তের দ্বারাই এ সকল কাজ নেক আমলে পরিণত হয়। এভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে, জীবনের এক বিরাট অংশই এমন, যেখানে সঠিক নিয়ত ও সুন্নতের ইত্তিবা এখন থেকেই শুরু করা সম্ভব। এই সকল ক্ষেত্রে এই চর্চা এখনই শুরু করুন।
আর যে বিষয়গুলো শরীয়ত ও সুন্নাহর অধীনে নিয়ে আসা অপেক্ষাকৃত কঠিন, যেমন কারো কারো ক্ষেত্রে আয়-উপার্জন, পর্দা-পুশিদা ইত্যাদি; ঐসব ক্ষেত্রে করণীয় হচ্ছে, আল্লাহর বিধানে যা হারাম তাকে হারাম জানুন এবং অবশ্যই তা থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করুন। সদিচ্ছা ও সঠিক চেষ্টা থাকলে উপায়ও অবশ্যই বের হয়ে আসবে। আর তখন সঠিক নিয়তের দ্বারা আয়-উপার্জনের সকল প্রয়াসই আমলে সালেহে পরিণত হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।