হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
কামরুল হাসান দর্পণ
বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির একাংশের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একজন বিচিত্র চরিত্রের রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত। তবে তিনি রাজনীতিবিদ হিসেবে যতটা না পরিচিত, তার চেয়ে বেশি পরিচিত একজন ‘স্বৈর শাসক’ হিসেবে। যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন তার বিরুদ্ধে সুদীর্ঘ নয় বছর সব বিরোধী দল এক হয়ে আন্দোলন করে তাকে হটিয়েছিল। বলা হয়, তার পতনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের নব সূচনা হয়। এরশাদের বিরুদ্ধে শুধু রাজনৈতিক দলগুলোই নয়, গণতন্ত্রকামী পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে শিল্পী-সাহিত্যিকসহ প্রত্যেকেই স্ব স্ব ক্ষেত্র থেকে বিরোধিতা করেছিলেন। তাদের বক্তব্য-বিবৃতির মূল সুরই ছিল এরশাদ একজন স্বৈরাচার। গণতন্ত্রকে বুটের নিচে রেখে বন্দুকের নলের জোরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে আছেন। প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান মৃত্যুবরণের কিছু দিন আগে এরশাদকে নিয়ে একটি ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছিলেন। চিত্রের নামকরণ করেছিলেন ‘বিশ্ব বেহায়া’। তার এই চিত্রকর্ম এরশাদীয় স্বৈরশাসনের প্রতীক হয়ে আছে। শুধু তার এই একটি চিত্রকর্মই নয়, সে সময় মঞ্চ থেকে শুরু করে পাড়া-মহল্লায় কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলে এরশাদকে ব্যঙ্গ করে হরদম নাটক, কবিতা, গান পরিবেশিত হতো। মনে আছে, আমার এক বন্ধু যে কিনা কোনো কিছুতেই তেমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে না। চুপচাপ, নীরব স্বভাবের। সবসময়ই নিচু স্বরে কথা বলে। কামান দাগালেও রাগ-ক্ষোভ প্রকাশ করে না। কেবল মিটিমিটি হাসে। এমন শান্ত, শিষ্ট বন্ধুটিও এরশাদের ওপর এমনই চটেছিল যে, জীবনে প্রথমবারের মতো একটি দীর্ঘ কবিতা লিখে ফেলে। কবিতার শিরোনাম ছিল, ‘এরশাদ তুই আত্মহত্যা কর’। শুধু কবিতা লিখেই সে ক্ষান্ত হয়নি। নিজের শান্ত চরিত্রের খোলস থেকে বের হয়ে মহল্লার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও কবিতাটি আবৃত্তি শুরু করে। তার দীর্ঘ কবিতায় এরশাদের বিরুদ্ধে যত রকমের ক্ষোভ প্রকাশ করা যায়, তার সবই ছিল। কবিদের অনেক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি বৈশিষ্ট্য হলো কল্পনায় ভবিষ্যৎ দেখা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার বাস্তব রূপও দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ শতবর্ষ পরের প্রেক্ষাপট নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন। এখনো এই কবিতা পাঠক আগ্রহ ও আবেগ নিয়ে পড়েন। এক সময় পল্টন ময়দানে জনসভা নিষিদ্ধ ছিল। সত্তর-আশি দশকের কবি আবু করিম সে সময় তার এক কবিতায় লিখেছিলেন, পল্টনে জনসভা হবে। কবিতায় তার ভবিষ্যদ্বাণী বৃথা যায়নি। পল্টনে জনসভা হয়েছে। আমার বন্ধুটি তার জীবনের প্রথম কবিতায় ক্ষুব্ধ হয়ে এরশাদের আত্মহত্যা কামনা করেছিল। দেখা গেল, বন্ধুর কামনা এরশাদ ক্ষমতায় থাকতে সত্যে পরিণত না হলেও ২০১৪ সালে তার উপক্রম হয়েছিল। উপলক্ষ ছিল, জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা নিয়ে। ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে তিনি অংশগ্রহণ করবেন না বলে গোঁ ধরে বসেছিলেন। তাকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করানোর জন্য তার ওপর নিজ দলের ভিতর এবং বাইরে থেকে বিভিন্ন প্রেসার গ্রুপের প্রচ- চাপ ছিল। এই চাপ যখন সহ্য করতে পারছিলেন না, তখন পিস্তল নিয়ে হুমকি দিয়েছিলেন, প্রয়োজনে আত্মহত্যা করব, তবু নির্বাচনে যাব না। কেউ তাকে জোর করে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাতে চাইলে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করবেন বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন। বেশ কয়েক দিন পিস্তল নিয়েও বসেছিলেন। টেলিভিশন ও পত্র-পত্রিকার কল্যাণে দেশের মানুষ তার এই আত্মহত্যার হুমকি সংক্রান্ত ঘটনায় বিচলিত হওয়ার পরিবর্তে তা বেশ উপভোগ করে। কারণ তারা জানত এটা এক ধরনের নাটকীয় ঘটনা। তাদের এ ধারণা ভ্রান্ত হয়নি। এরশাদ আত্মহত্যা করেননি। নাটকীয়ভাবেই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন এবং হাসপাতালের বেডে শুয়ে নমিনেশন পেপারে সাইন ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। অবশ্য এরশাদ নিজেও একজন কবি। নিশ্চয়ই তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন দিব্যদৃষ্টি দিয়ে তা দেখেছিলেন। আত্মহত্যার হুমকির মতো নাটক করবেন, এটাও হয়তো আগে থেকেই দেখে রেখেছিলেন। প্রকৃত কবিরা এমন নাটকীয় দিব্যদৃষ্টি সম্পন্ন কিনা, তা তারাই ভালো বলতে পারবেন। যাই হোক, এরশাদকে বিশ্বাস করা না করা নিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে বিভিন্ন কথা প্রচলিত আছে। তার কথার কোনো মূল্য নেই বলেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে বলেন। এর কারণ, তিনি সকালে এক কথা বললে বিকেলে তিনশ ষাট ডিগ্রি ঘুরে অন্য কথা বলেন। ক্ষমতায় থাকতেও তাকে নিয়ে এমন কথা প্রচলিত ছিল। শুরুতে তিনি ছিলেন চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর, যার সংক্ষিপ্ত রূপ সিএমএলএ। সে সময় যখন একেক সময় একেক কথা বলতেন, তখন সিএমএলএ-কে অনেকে ব্যঙ্গ করে বলতেন, ‘ক্যানসেল মাই লাস্ট অর্ডার’। আবার অনেকে তাকে রাজনীতির একজন পাকা অভিনেতা হিসেবেও আখ্যায়িত করতেন, এখনো করেন। এরশাদের শাসনামল এবং রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে আরও অনেক কথার প্রচলন রয়েছে। দেশের মানুষ তার সম্পর্কে ভালো করেই জানে।
দুই.
বর্তমান শাসক দলের পক্ষ থেকে প্রায়ই তিরস্কার করে বলা হয়, ক্যান্টনমেন্টে যে রাজনৈতিক দলের জন্ম তা কোনো দলই নয়। তারা ক্যান্টনমেন্টে জন্ম নেয়া দল বলতে প্রধানত বিএনপিকেই বুঝিয়ে থাকে। যদিও এরশাদের জাতীয় পার্টি ক্যান্টনমেন্ট থেকে জন্ম নেয়া এবং তাদের ভাষ্যমতে, এ দলটি রাজনৈতিক দলের পর্যায়ে না পড়লেও তা তারা ঘূর্ণাক্ষরেও বলেন না। এটা যে এক ধরনের সুবিধাবাদী কথা, তা সচেতন মানুষমাত্রই জানেন। আমার পক্ষে যে থাকে, সে সিংহভাগ মানুষের কাছে খারাপ লোক হিসেবে স্বীকৃত হলেও তার চেয়ে ভালো লোক পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই, জাতীয় পার্টিকে নিয়ে শাসক দলের এ মনোভাব একজন সাধারণ মানুষও বোঝে। দুঃখের বিষয়, যে এরশাদের বিরুদ্ধে বর্তমান শাসক দলসহ দলমত নির্বিশেষে দেশের মানুষ আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে এবং বহু রক্তের বিনিময়ে তাকে ক্ষমতা থেকে হটিয়েছে, সে এখন শাসক দলের কাছে খুবই বরণীয় এবং আদরণীয়। ক্যান্টনমেন্টে জন্ম নেয়া দলটির প্রধানই এখন ক্ষমতায় থাকা না থাকা, যাওয়া না যাওয়ার অন্যতম গুটিতে পরিণত হয়েছেন। এই দলের সাথে ঐক্য এবং ক্ষমতা ভাগাভাগিতেও শাসক দলের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। এরশাদও বেশ আনন্দে ক্ষমতার অংশীদার হয়ে সুবিধা ভোগ করছেন। এখন তো কনফিডেন্সের সাথেই বলছেন, আগামী নির্বাচনে জয়ী হয়ে এককভাবে তার দল ক্ষমতায় যাবে। প্রশ্ন হচ্ছে, শাসক দলের বিবেচনায় ক্যান্টনমেন্টে জন্ম নেয়া দল যদি কোনো দলই না হয়, তবে জাতীয় পার্টি ক্ষমতার অংশীদার হয় কীভাবে এবং কীভাবেই বা ক্ষমতায় যাবে? গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতায় যেতে হলে তো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নেই। বলাবাহুল্য, শাসক দল জাতীয় পার্টিকে রাজনৈতিক দল মনে করছে এবং মেনে নিয়েছে। তাহলে কেবল বিএনপিকে কেন ক্যান্টনমেন্টে জন্ম নেয়া দল হিসেবে চিহ্নিত করে তিরস্কার করা হচ্ছে? এটা কি স্ববিরোধিতা নয়? সাধারণ মানুষ কি মনে করতে পারে না, শাসক দলের ক্ষমতায় থাকা এবং যাওয়ার ক্ষেত্রে এরশাদ বা তার জাতীয় পার্টিকে সহায়ক বা হাতের পুতুলে পরিণত করার মধ্য দিয়ে এরশাদের অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল এবং তার স্বৈরাচারী শাসনকে বৈধতা দেয়া হয়েছে? অথচ এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে বর্তমান শাসক দলসহ বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল এবং দলমত নির্বিশেষে গণতন্ত্রকামী মানুষ কী সীমাহীন দলন-পীড়ন, জেল-জুলুমেরই না শিকার হয়েছে! বুকে-পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লিখে নূর হোসেন জীবন দিয়েছে। ডাক্তার মিলনকে গুলি খেয়ে মরতে হয়েছে। গুলিস্তানে ফুলবাড়িয়ায় মিছিলে ট্রাক তুলে দিয়ে ছয়-সাতজনকে পিষে মারা হয়েছে। শুধু ক্ষমতায় থাকা ও যাওয়ার জন্যই কি এসব মাফ হয়ে যেতে পারে? সম্প্রতি সিলেটের এক জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে এরশাদ দেশের বর্তমান রাজনীতিতে গুম, খুন, নিপীড়ন, নির্যাতনের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, এখন অসংখ্য মানুষ মারা হচ্ছে। তার আমলে এত লোক মারা যায়নি। মাত্র দুজন মরেছে। একজন নূর হোসেন, আরেকজন ডাক্তার মিলন। পাঠক লক্ষ্য করুন, নূর হোসেন ও ডাক্তার মিলনের মৃত্যুর কথা এরশাদ স্বীকার করেছেন। সাধারণ মানুষ জানে, তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্যই তাদের মরতে হয়েছে। এই মৃত্যুর দায় কি এরশাদ এড়াতে পারেন?
তিন.
শাসক দলের কথামতো জাতীয় পার্টি যে রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃত, তা স্পষ্ট। প্রশ্ন হচ্ছে, সাধারণ মানুষ ও সচেতন নাগরিকরা জাতীয় পার্টিকে রাজনৈতিক দল মনে করেন কিনা? কারণ একটি রাজনৈতিক দলের যে চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য থাকা প্রয়োজন, তার অনেক কিছুই দলটির কার্যক্রমে পরিলক্ষিত হয় না। দলটি একাধারে সরকারের অংশীদার আবার জাতীয় সংসদে বিরোধী দল হিসেবে পরিচিত। এমন বিচিত্র রাজনৈতিক দল বিশ্বে বিরল। এ নিয়ে দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অনেক সমালোচনা করেছেন এবং করছেন। কেউ কেউ ব্যঙ্গ করে জাতীয় পার্টিকে ‘মৎস্যকন্যা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কেউ তুলনা করেছেন, গ্রিক মাইথলজির অর্ধেক মানুষ অর্ধেক ঘোড়ারূপী প্রাণী ‘সেনট্যরাস’-এর সাথে। অর্থাৎ একটি রাজনৈতিক দলের সুনির্দিষ্ট যে লক্ষ্য, আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কর্মপরিধি থাকা বাঞ্ছনীয়, তা জাতীয় পার্টির কার্যক্রমে প্রতিফলিত হয় না। সাধারণভাবে একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে, জনগণের মুখপাত্রে পরিণত হওয়া। জনগণের পক্ষে কথা বলা এবং তাদের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়গুলো ধারণ করে তদানুযায়ী কর্মকা- পরিচালনা করা। আরেকটি প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, দেশ পরিচালনা করার দায়িত্ব নেয়া বা ক্ষমতায় যাওয়া। জনগণ কর্তৃক স্বতঃস্ফূর্ত ভোটে নির্বাচিত ক্ষমতাসীন দল বা জোটের দায়িত্ব হচ্ছে, জনগণের সুখ-সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে অর্থনৈতিক বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা। পাশাপাশি গণতান্ত্রিকভাবে বিরোধী রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম পরিচালনার পরিবেশ সৃষ্টি থেকে শুরু করে সামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত এবং বিশ্বে দেশের ভাবমর্যাদা বৃদ্ধিতে কাজ করা। যারা বিরোধী দলে থাকে, তাদের দায়িত্ব সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিয়ে গঠনমূলক সমালোচনা এবং জনগণের সুবিধা-অসুবিধা সম্পর্কিত দাবি-দাওয়া সরকারের সামনে তুলে ধরে তা আদায় করা। প্রয়োজনে জনগণকে সম্পৃক্ত করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রতিবাদ ও আন্দোলন করা। রাজনৈতিক দল, সেটা সরকারি হোক বা বিরোধী দল হোক, তাদের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে জনগণের কল্যাণ। সাধারণ অর্থে একটি রাজনৈতিক দলের ধরন ও বৈশিষ্ট্য এরূপ হলেও প্রশ্ন হচ্ছে, জাতীয় পার্টির মধ্যে কি এসব বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়? দলটির এযাবতকালের কর্মকা- পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, তারা এ কাজটি যথাযথভাবে করতে পারেনি। এখন দলটির যে অস্তিত্ব আছে, এমন আলামতও স্পষ্ট নয়। সংসদে বিরোধী দল হিসেবে থাকলেও তার ভূমিকা জনগণের কাছে অনেকটা হাস্যকর হয়ে দেখা দিয়েছে। এমনকি বিদেশি কোনো রাষ্ট্র প্রধান বা উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি সফরে এলে দলটির প্রধানের সাথে বৈঠক বা মতবিনিময়ের মতো সৌজন্যমূলক কাজটিও হয় না। অথচ কূটনৈতিক শিষ্টাচার হিসাবে সংসদের বিরোধী দলের নেতার সাথে বৈঠক করা প্রচলিত রেওয়াজ। কেবল সংসদের বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টির ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। কিছু দিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি গুরুত্বপূর্ণ এক সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সংসদের বাইরে থাকা বিএনপি নেত্রীর সঙ্গেও বৈঠক করেন। এমনকি সুধীসমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। অথচ জনগণ দেখল, সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির কারো সঙ্গেই তিনি বৈঠক করেননি। জাতীয় পার্টিকে তিনি পাত্তাই দেননি। জন কেরির পর গত শুক্রবার চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশে এক ঐতিহাসিক সফর করে গেছেন। এই ইতিহাসেরও অংশ হতে পারেনি দলটি। সফরের প্রথম দিনের বিকেলেই বিএনপি নেত্রীর সঙ্গে শি জিনপিং বৈঠক করলেও জাতীয় পার্টির কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ দেননি। অর্থাৎ জাতীয় সংসদে যে জাতীয় পার্টি নামে একটি বিরোধী দল বা রাজনৈতিক দল আছে, বিদেশি রাষ্ট্র প্রধান থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ তা মনে করেন না। তারা বিরোধী দল বলতে এখনো বিএনপিকেই মনে করে। কেউ জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দল মনে না করুক, তাতে কিছু যায় আসে না ধরে নিয়েও বলা যায়, বিরোধী দল হিসেবে দলটি জনগণের পক্ষে কী কাজ করছে! জনগণের কত সমস্যা! আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিসহ ভারতের সাথে একতরফা বিভিন্ন চুক্তি ও পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ের মতো জাতীয় কোনো ইস্যুতে কি দলটি কোনো ভূমিকা রেখেছে? জনগণ ও জাতীয় এসব সমস্যা নিয়ে কি দলটি সামান্য একটি মানববন্ধনও করতে পারে না? এসব প্রশ্ন এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। জনগণ কেবল দেখছে, তাদের নামে প্রতিনিধিত্বকারী সংসদের বিরোধী দলটি সরকারের গুণকীর্তন ও সরকারের অংশীদার হয়ে নিজেদের সুযোগ-সুবিধা নিতেই ব্যস্ত। সরকারের যে ভুল হতে পারে বা ভুল করতে পারে এবং এ ভুল ধরিয়ে দেয়া যে বিরোধী দল হিসেবে তার দায়িত্ব, রাজনৈতিক সাধারণ জ্ঞানের এ পরিচয়টুকুও দলটি দিতে পারছে না। এখন তারা ব্যস্ত কীভাবে আগামীতেও ক্ষমতার অংশ হয়ে থাকা যায়। বর্তমান সরকারের বিগত শাসনামলের মাঝামাঝি জাতীয় পার্টির উপদেষ্টা পর্যায়ের একজনকে প্রশ্ন করেছিলাম, জাতীয় পার্টির লক্ষ্যটা কি? তিনি ঝটপট উত্তর দিয়েছিলেন, লক্ষ্য-টক্ষ কিছু না, আওয়ামী লীগ-বিএনপি যে দলই ক্ষমতায় আসুক, জাতীয় পার্টি আজীবন ক্ষমতার অংশীদার হয়ে থাকতে চায়।
চার.
জাতীয় পার্টি সত্যিকার অর্থে গণসম্পৃক্ত কোনো রাজনৈতিক দল কিনা, তা উপরের সামান্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে পাঠককে মোটের ওপর একটি ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। সচেতন পাঠক এ ধারণার সাথে নিজস্ব বিশ্লেষণের সংমিশ্রণে নিশ্চয়ই জাতীয় পার্টি সম্পর্কে একটি উপসংহারে আসতে পারবেন। অনেকেই একমত হবেন, আদর্শ রাজনৈতিক দল বলতে যা বোঝায়, জাতীয় পার্টি তার ধারেকাছেও নেই। তারপরও ক্যান্টনমেন্টে জন্ম নেয়া দলটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্ষমতায় থাকা ও যাওয়ার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামকে পরিণত হয়েছে। যুগে যুগে এ কথাও প্রচলিত, ‘জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভালো।’ ‘গোবরে পদ্মফুল ফোটে।’ জাতীয় পার্টি তো অন্তত এ কথাগুলো স্মরণ রেখে তার কর্মপদ্ধতির মাধ্যমে জনগণের দলে পরিণত হতে পারত। এ সুযোগ থাকা সত্ত্বেও দলটি যে তা করতে ব্যর্থ হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বলা যায়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন’ হয়ে আছে। শাসক দলের পক্ষ থেকে বিএনপিকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে জন্ম নেয়া দল বলে যতই তিরস্কার করা হোক না কেন, এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারায় দলটি জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত ও প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে একাধিকবার ক্ষমতায় এসেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সংসদে সবচেয়ে বৃহৎ বিরোধী দল হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। দলটির জন্ম যেখানেই হোক, লক্ষ্য ও আদর্শ যেমনই হোক, বিপুল জনগোষ্ঠীকে তার প্রতি আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে। জনগণ তাকে গ্রহণ করেছে এবং সমর্থন ও ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে। ক্ষমতাকামী বা বিরোধী দল উভয় দিক থেকেই দলটির ওপর জনগণের আশা-ভরসার একটি দৃঢ় ভিত্তি গড়ে উঠেছে। জাতীয় পার্টি এবং তার প্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ শাসক দলের কাছ থেকে তিরস্কারমুক্ত হয়েও এ কাজটি করতে পারেনি। এর কারণ, জনগণ জাতীয় পার্টি ও এর প্রধানকে এখনো মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারেনি।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।