Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সত্যালোকের সন্ধানে সালাত দর্শন : একটি তাত্ত্বিক সমীক্ষা

প্রকাশের সময় : ২০ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এ, কে, এম ফজলুর রহমান মুন্্শী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আরবের যে সকল লোক নিজেদের হযরত ইব্রাহীম (আ:)-এর অনুসারী বলে মনে করত তাঁদের মাঝে এমনও ছিল যারা ইবাদতের নির্দিষ্ট তরীকা সম্পর্কে ওয়াকেফ ছিল না। যায়েদ বিন আমরের ঘটনায় উল্লেখ আছে যে, তিনি বলতেন, “হে আল্লাহ! আমি জানি না কেমন করে তোমার ইবাদত করব।” একথা বলে তিনি উভয় হস্ত উত্তোলন করতেন এবং এর উপর সেজদাহ করতেন। (ইবনে হিশাম : যায়েদ বিন আমর বিন নুফায়েল প্রসঙ্গ) কিন্তু এদের মাঝে দু’একজন এমনও ছিলেন যে, যারা কোন না কোনভাবে নামাজ আদায় করতেন। সুতরাং হযরত আবুজর গিফারী (রা:) রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর সাথে মোলাকাত করা ও ইসলাম গ্রহণ করার তিন বছর পূর্বে নামাজ আদায় করতেন। কেউ তাঁকে জিজ্ঞেস করলো যে, তখন আপনি কোনদিকে মুখ করে নামাজ পড়তেন? তিনি বললেন, “সেদিকেই মুখ করতাম।” (সহীহ মুসলিম : ফাযায়েলে আবুজর)। আরবের একজন অন্ধকার যুগের কবি ‘জাররানল ইওয়াদ’ বলেছে, “এবং এই আরোহীরা রাতের শেষ অংশকে পেয়েছে, ঐ সময়ের পরে যখন ইবাদত গুজার হানিফী সম্প্রদায় নামাজ আদায় শেষ করে।” এই কবিতার দ্বারা বুঝা যায় যে, তৎকালীন আরবের হানিফী মাযহাবের অনুসারীরা রাতের শেষাংশে নামাজ আদায় করতো।
ইহুদীদের বৃহত্তর দল নামাজের কথা বিস্মৃত হয়ে পড়েছিল। তাদের নামাজ ছিল কতিপয় রুসুম ও রেওয়াজের সমষ্টিমাত্র। তারা নামাজ হতে অধিক গুরুত্ব দিত কোরবানী ও নজরানার প্রতি। তাদের মাঝে এখলাস ও আল্লাহর আনুগত্যের নামগন্ধও ছিল না। খৃস্টানরা আল্লাহর নামাজের সাথে সাথে মানুষের জন্যও নামাজ পড়া শুরু করেছিল। তারা হযরত ঈসা (আ:) ও হযরত মারয়াম (আ:) ছাড়া অগণিত দেবতা ও শহীদদের ইবাদতে মশশুল হয়ে পড়েছিল। দেখুন, ইনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা : একাদশ সংস্করণ ইবাদত (ডঙজঝঐওচ) শব্দ।
দ্বীনে ইব্রাহীমির দাবীদার ও অনুসারীগণ নিজেদের চিন্তা ও ধারণা মোতাবেক কিছু কিছু আরকান আদায় করতো। মোটকথা রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর আবির্ভাবের পূর্বে নামাজের নির্দিষ্ট ও তৌহিদভিত্তিক হাকীকত সাধারণত পৃথিবী হতে মুছে গিয়েছিল। এর আকার-আকৃতি এতটুকু বিকৃত হয়ে গিয়েছিল যে, আজো তাদের সহীফাগুলোর মাঝে এর মৌলিক নমুনা খুঁজে পাওয়া যায় না। না তাদের আরকানের সন্ধান পাওয়া যায়, না একথা বুঝা যায় যে, ইলহামী সহীফার ধারক-বাহকগণ এই ফরজকে কেমন করে আদায় করতো এবং তারা প্রভাব বিস্তারকারী কোন কোন দোয়াগুলো পাঠ করতো এবং এগুলো আদায়ের জন্য কোন কোন সময় নির্দিষ্ট ছিল। তবে যা কিছু তাদের মাঝে অবশিষ্ট ছিল তা মূলত কতিপয় রুসুম ও রেওয়াজপ্রসূত কর্মকা- ও পরবর্তীকালের ধর্মবেত্তাদের প্রদর্শিত আচার অনুষ্ঠান মাত্র। এগুলোকেই তারা ধর্মীয় ফরজিয়ত বলে আমল করতেছিল। সেজদাহ নামাজের প্রাণ এবং আল্লাহর আনুগত্যের চূড়ান্ত মঞ্জিল, তা’ ইহুদী ও নাসারাগণ কষ্টদায়ক পীড়া মনে করে ছেড়ে দিয়েছিল। একইভাবে নামাজের জাহেরী আকারও তারা পরিবর্তন করে ফেলেছিল। আল-কোরআনে তাদের অবস্থার বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। “তারপর অযোগ্য উত্তরপূরুষগণ একের পর এক তাদের স্থলাভিষিক্তরূপে কিতাবের উত্তরাধিকারী হয়, তারা এই তুচ্ছ দুনিয়ার সামগ্রী গ্রহণ করে এবং বলে, আমাদেরকে ক্ষমা করা হবে; কিন্তু এর অনুরূপ সামগ্রী তাদের নিকট আসলে তাও তারা গ্রহণ করে, কিতাবের অঙ্গীকার কি তাদের নিকট হতে লওয়া হয়নি যে, তারা আল্লাহর সম্বন্ধে সত্য ছাড়া বলবে না? এবং তারাতো এতে যা আছে তা অধ্যয়নও করে, যারা তাকাওয়া অবলম্বন করে তাদের জন্য পরকালের আবাসই শ্রেয়, তোমরা কি তা অনুধাবন কর না? যারা কিতাবকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করে ও সালাত কায়েম করে আমি তাদের মত সৎকর্মশীলদের শ্রমফল নষ্ট করি না।” (সূরা আরাফ : রুকু-২১) সূরা মারয়ামে সকল সত্যবাদী আম্বিয়াদের কথা উল্লেখ করার পর আল্লাহপাক ঘোষণা করছেন, “তাদের পরে তাদের উত্তরাধিকারিগণ এমন হয়ে গেল যে, যারা নামাজকে বরবাদ করে দিল এবং নিজেদের খাহেশাতের পায়রবী করল।” (সূরা মারয়াম : রুকু-৪)।
নামাজকে বরবাদ ও ধ্বংস করার উদ্দেশ্য শুধু কেবল নামাজকে ছেড়ে দেয়াই নয়, বরং বেশিরভাগ এর হাকীকত বিনষ্ট করা এবং এর প্রাণশক্তিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়াও বুঝায়। মুসলমানগণ যখন স্বীয় নামাজের জন্য হাইয়্যা আলাস সালাহ (নামাজের জন্য আসুন) ধ্বনি বুলন্দ করতেন, তখন ইহুদী ও নাসারাগণ হাসিতামাসা করতে থাকত। তাদের এই কর্মকা- সম্পর্কে আল- কোরআনে এই সাক্ষ্য প্রদান করেছে যে, আল্লাহর এবাদতের প্রাণশক্তি এতখানি নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল যে, যখনই অন্যান্য লোকজন আল্লাহর এবাদতের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হত, তখন তারা এটাকে হাসি-তামাসা ও খেলা বলে উপহাস করত। ইরশাদ হচ্ছে, “এবং যখন তোমরা নামাজের জন্য আহ্বান কর, তখন তারা এটাকে হাসি-তামাসা বলে উপহাস করে, তা এজন্য যে, তারা ছিল বুদ্ধিহীন কওম।” (সূরা মায়েদাহ : রুকু-৯)
আহলে আরব এবং কুরাঈশদের মাঝে যারা পৈতৃক মাযহাবের উপর ছিল, তারা যদিও নামাজের আকৃতি সম্পর্কে কিছুটা পরিচিত ছিল, কিন্তু কখনো ভুলক্রমে এই ফরযকে আদায় করত না। মূর্তি পূজা, জ্বিনদের আশ্রয় গ্রহণ এবং ফেরেশতাদের সন্তুষ্টি অর্জনই ছিল তাদের এবাদতের মূল মর্ম। হজ, তাওয়াফ ও অন্যান্য ক্ষেত্রে তারা আল্লাহর নিকট দোয়া ও প্রার্থনা করত কিন্তু এখানেও তারা দেবতাদের নাম উচ্চারণ করত এবং শেরেকসন্তুূত শব্দাবলী উচ্চারণ করত। তাদের মাঝে বিনয় সহকারে এক আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করার নাম-গন্ধও ছিল না। তারা যখনই মুসলমানদের নামাজ পড়তে দেখত, তখনই তাদের মুখ বিকৃত হয়ে যেত এবং উচ্চস্বরে শব্দ করত এবং তালি বাজাত। এ সম্পর্কে আল-কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, “এবং খানায়ে কাবাতে তাদের নামাজ ছিল শিষ দেয়া ও তালি বাজানো।” (সূরা আনফাল)
প্রাচীন মুফাসরিরগণ এই আয়াতের দু’টো মতলব বিবৃত করেছেন। (১) প্রকৃতই তারা যখন নামাজ আদায় করত তখন শিষ দিত ও তালি বাজাত। (২) আর মুসলমানগণ যখন নামাজ আদায় করতেন তখন তারা শিষ দিয়ে ও তালি বাজিয়ে তাদের নামাজকে প- করে দিতে সচেষ্টই হত। মূলত তাদের নামাজই ছিল এরূপ। (ইবনে জারীর, তাবারী) প্রথম অর্থের দিকে লক্ষ্য করলে বুঝা যায় যে, তাদের নামাজ ছিল খেল-তামাসা ও শোরগোল করার নামান্তর মাত্র। আর দ্বিতীয় অর্থ অনুসারে বুঝা যায় যে, তাদের মাঝে প্রকৃতপক্ষে কোন নামাজই ছিল না, বরং অন্যদের নামাজ হতে বিরত রাখাই ছিল তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। অপর এক আয়াতে এসেছে, “তুমি কি ঐ ব্যক্তিকে দেখেছ যে এক বান্দাহকে নামাজ হতে বিরত রাখতে প্রয়াসী।” (সূরা আলাক) এখানে এক বান্দাহ বলতে রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর সত্তাকে বুঝানো হয়েছে। কেননা, তিনি যখন কাবা প্রাঙ্গণে নামাজরত হতেন তখন কুরাঈশরা বেখেয়ালভাবে এখানে সেখানে বসে থাকত এবং কখনো রাসূলুল্লাহ (সা:)-কে উপহাস করত এবং কখনো শোরগোল করত, পিঠের উপর নাপাক বস্তু ছেঁছড়ে মারত। কখনো তিনি যখন নিক্ষিপ্ত বস্তুর ভারে মাথা তুলতে পারতেন না, তখন উচ্চস্বরে হাসি-তামাসা করত। (তফসীরে ইবনে জারীর ও সহীহ বুখারী) এজন্য রাসূলুল্লাহ (সা:) ইসলামের শুরুতে গোপনীয়তা রক্ষাকল্পে এবং তাদের নিগ্রহের হাত হতে বেঁচে থাকার লক্ষ্যে দিনে ও রাতে কোনও নিভৃত গুহায় গমন করে সেখানে নামাজ আদায় করতেন। এমনকি মুসলমানগণও চুপে চুপে নির্জনে নামাজ আদায় করতেন। অথবা নির্জন রাতে এই ফরজকে সম্পাদন করতেন। তবুও যদি অবিশ্বাসীরা তাদের অবস্থা সম্পর্কে জানতে পারত তখন তাদের আক্রমণ করতে উদ্যত হত এবং প্রতিহত করতে প্রচেষ্টা চালাত। ইবনে ইসহাকে বলা হয়েছে যে, সাহাবায়ে কেরাম যখন নামাজ পড়তে ইচ্ছা করতেন তখন কোনও গোপন ঘাঁটিতে চলে যেতেন। একবার হযরত সায়াদ বিন আবু ওয়াক্কাস (রা.) কতিপয় সাহাবিসহ মক্কার কোনো এক ঘাঁটিতে নামাজ পড়ছিলেন, এমন সময় মুশরেকীনদের একটি দল এসে হাসির হলো, তারা নামাজকে একটি নতুন কাজ বলে মনে করল এবং মুসলমানদেরকে গালিগালাজ করে আক্রমণ করতে উদ্যত হলো। (সহিহ বুখারি)
মোট কথা রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন মানুষকে আল্লাহর সন্নিধানে মস্তক অবনত করার আহ্বান জানালেন, তখন আরবে তিন শ্রেণীর লোক বিদ্যমান ছিল। (১) ইহুদি, যারা নামাজ পড়ত কিন্তু এর হাকিকত সম্পর্কে সম্পূর্ণ বেখেয়াল ছিল। মূলত তাদের নামাজ ছিল, লেজকাটার মতো ভ্রান্ত কল্পনা-বিলাস, আন্তরিকতাহীন, একাগ্রতাহীন, ভয়ভীতিহীন অনুষ্ঠান মাত্র। (২) খৃস্টান সমাজ, যারা আল্লাহর ইবাদতের সাথে মানুষের এবাদতকেও এক বলে মনে করত, তারা তাওহীদের সাথে শেরেকী অবস্থাকে যুক্ত করে ফেলেছিল। (৩) আরবের মূর্তিপুজারি শ্রেণী যারা কখনো আল্লাহর নাম নিত না, কখনো আল্লাহর সামনে মাথা নতও করত না, এমনকি নামাজের রুহানী স্বাদ ও আকর্ষণ সম্পর্কে কিছুই ধারণা করতে পারত না।
তাওহীদের পর ইসলামের প্রথম রোকন :
রাসূলে পাক (সা.) নবুওত প্রাপ্তির পর সর্বপ্রথম তাওহীদের দীক্ষা লাভ করেন। তাওহীদের পর প্রথম নির্দেশ যা লাভ করলেন, তা হলো সালাত। ইরশাদ হচ্ছে, “হে বস্ত্রাচ্ছাদিত! উঠুন, সতর্কবাণী প্রচার করুন এবং আপনার প্রতিপালকের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করুন।” সুতরাং আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করাই হলো সালাতের বুনিয়াদ। এরপর পর্যায়ক্রমে সালাতের পরিপূর্ণতা সাধিত হয় আহকাম, আরকান, ওয়াজেব, সুন্নাত, মোস্তাহাব এবং আদায়ের পদ্ধতি ও কাঠামো সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) সকলকে অবহিত করেন। তারপর আরও ইরশাদ হলো, “আপনার পরিচ্ছদ পবিত্র রাখুন এবং অপবিত্রতা হতে দূরে থাকুন”। নির্দেশের এই পর্যায়ে রুহানী মিরাজের শীর্ষ দেশের মুক্তাঙ্গন উদ্ভাসিত হয়ে গেল। আল্লাহর হাবীব (সা.) নিদ্রাচ্ছন্নদের জাগিয়ে তুললেন, পথভ্রান্তদের পথের দিশা দান করলেন, রুহানী মিরাজ সম্পর্কে যাদের কোনোই ধারণা ছিল না তাদেরকে পরিপূর্ণ জ্ঞানদান করলেন এবং সালাতের মাধ্যমে বান্দাহ ও আল্লাহর মধুর মিলনের এতকালের ছিন্ন সেতুবন্ধনকে নতুন করে প্রতিষ্ঠিত করলেন। এমন কি সোনা, রুপা, পাথর, মূর্তি ও ভ্রান্ত উপাদানকে নির্মূল করে এক আল্লাহর স্বীকৃতি ও পরিচয়কে তুলে ধরলেন এবং এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কাহারো সামনে মাথা নত করা, প্রণিপাত করা ও উপাসনা করাকে সর্বৈব হারাম ঘোষণা করলেন।
এভাবে রাসূলে পাক (সা.)-এর শিক্ষার মাধ্যমে সারা বিশ্বে সালাতের হাকীকত বিকাশ লাভ করে। তিনি আরববাসী ও দুনিয়ার মূর্তিপুজারি সম্প্রদায়গুলোর সামনে সালাতের পদ্ধতি বিকশিত করলেন এবং আরকান ও নিয়মাবলী একে একে তুলে ধরলেন। খ্রিস্টানদেরকে অদ্বিতীয় ¯্রষ্টার এবাদতের প্রতি অনুপ্রাণিত করলেন, ইহুদিদেরকে সালাতের মর্ম, আন্তরিকতা ও বিশুদ্ধচিত্ততার সংবাদ দান করলেন এবং আম্বিয়াগণের বিক্ষিপ্ত সালাত পদ্ধতিকে একই কেন্দ্রে সমন্বয় সাধন করলেন। তাছাড়া প্রাণ ও দেহের সমন্বিত ভালোবাসার ¯্রােতধারা সালাতের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত করলেন। সাথে সাথে নির্দেশ হলো, “তোমরা সালাতকে হেফাজত করো।” এই নির্দেশের মাঝে সালাতের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উভয় দিকের হেফাজতই বিধৃত রয়েছে। আর সত্যিকার মুসলমান কে হতে পারে তার স্বরূপ এবং এর চিহ্ন নিরূপিত হওয়ার দিকনির্দেশনা সম্বলিত নির্দেশও জারি হলো। ইরশাদ হচ্ছে, “যারা স্বীয় সালাতের হেফাজত করে, যারা সার্বিকভাবে সালাত প্রতিষ্ঠায় তৎপর; তারাই কামিয়াব যারা তাদের সালাতের হেফাজতে উন্মুখ থাকেন।”
সালাতের প্রতিষ্ঠা শুধু কেবল একক ব্যক্তিসত্তার ওপরই নির্ভরশীল নয়। এরক্ষেত্র বহুল বিস্তৃত ও সুদূরপ্রসারী। এ কারণে আল্লাহপাক নির্দেশ করলেন “হে প্রিয় হাবীব! আপনি স্বয়ং সালাত কায়েম করুন, পরিবার-পরিজনদেরকে সালাত আদায়ের হুকুম প্রদান করুন এবং সর্বাবস্থায় একান্ত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সাথে সালাত প্রতিপন্ন করুন।” যেমন ইরশাদ হচ্ছে, “আপনার গৃহবাসীদের প্রতি সালাতের তাগিদ প্রদান করুন, এর ওপর সুদৃঢ় থাকুন।”
সালাত কেমনভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে এর স্বরূপ বিশ্লেষণ করে আরো ইরশাদ হচ্ছে, “আল্লাহর সামনে আদব ও শিষ্টাচারসহ দ-ায়মান থাকুন।” সাথে সাথে এই একনিষ্ঠ আত্মনিবেদনকারীদের শুভ পরিণামও ঘোষিত হলো। ইরশাদ হচ্ছে, “তারাই সফল যারা স্বীয় সালাতে একান্ত আত্মসমর্পণকারী।” এই সফলতাকে সর্বাঙ্গিন সুন্দর ও প্রাণবন্ত করে তোলার জন্য আরও অধিক উৎসাহ প্রদান করে ঘোষণা করা হলো, “তোমরা স্বীয় পরওয়ারদিগারকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মাধ্যমে নীরবে ডাকতে থাক।”
আল্লাহ ও বান্দাহর সার্বিক সম্পর্ককে জোরদার করার জন্য পুনরায় ঘোষণা করা হলো, “মিলনের প্রত্যাশা এবং বিরহের ভীতি নিয়েই ইবাদতে অগ্রসর হও।” সুতরাং বিরহ বিচ্ছেদের ভয় যখন মিলনের মধুর পরশে বিদূরিত হয়ে যাবে তখন একান্ত আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর স্মরণকে সঞ্জীবিত করে তোলে। ইরশাদ হচ্ছে, “আল্লাহর স্মরণকে এমনভাবে উজ্জীবিত কর যেন খালেস দ্বীন ও মাশুকের দীদার লাভের আকাক্সক্ষা মূর্ত হয়ে ফুটে ওঠে।”
এই প্রাণবন্ত রূপের মর্মবাণী হলো, বস্তুকে অতিক্রম করে বস্তুহীনতার উন্নতি হওয়া এবং বস্তুহীন প্রেমময়ের প্রেমের সাগরে হারিয়ে যাওয়া। এটা কেমন করে প্রতিষ্ঠা লাভ করে তার অবস্থা সম্বন্ধে সম্যক সচেতন হওয়া সকল বান্দাহর উচিত।
আমরা জানি, জীবমান প্রত্যেক মানুষেরই দুটি রূপ আছে। একটি হলো, তার বস্তুগত রূপ কাঠামো বা সুরত এবং দ্বিতীয়টি হলো, অন্তর্নিহিত প্রাণশক্তি বা রূহ। আগুন, পানি, মাটি, বাতাস দ্বারা নির্মিত দেহ কাঠামো বস্তুর আবরণে আচ্ছাদিত ও অন্ধকার পরিম-লে অবস্থিত।
কারণ প্রতিটি বস্তুর সাথেই অন্ধকার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে। এই বস্তুসর্বস্ব অন্ধকারে নিবদ্ধ মানুষ নামের কাঠামোটিকে উজ্জ্বল ও জ্যোতিময় করার লক্ষ্যে বস্তুহীন পবিত্র জগতের আলোর বিন্দুসদৃশ রূহ-রূপ প্রাণশক্তিকে এর মাঝে বিচ্ছুরিত করা হয়েছে একটিমাত্র নির্দেশের দ্বারা। যার কথা তুলে ধরে ইরশাদ হচ্ছে, “বলে দিন, রূহ হচ্ছে আমার প্রতিপালকের নির্দেশের প্রতিফলন মাত্র।” এতে বস্তু এবং বস্তুহীনতার সংমিশ্রণে সঞ্চারিত হয়েছে একটি আবেগ প্রবণতা, একটি অনুরাগের মৃদু গুঞ্জরণ। বান্দাহ যখন সালাত কায়েমের লক্ষ্যে দ-ায়মান হয় তখন গুঞ্জরণের প্রকাশ ঘটে-তাকবীরের মাধ্যমে। তারপর শুরু হয় তার অগ্রযাত্রা, আলোর কেন্দ্রবিন্দুর দিকে। যে কেন্দ্র হতে বিচ্ছুরিত হয়েছে তার প্রাণশক্তি বা রূহ। তাসবীহ, তাহমীদ, তাসলিম ও তাজকিরের রশি ধরে সেই প্রাণশক্তি ধাবিত হয় অস্তিত্ব হতে অনস্তিত্বের সীমাহীন জগতের দিকে। প্রেম, প্রণয়, অনুরাগ ও ভালোবাসা তাকে দেয় উৎসাহ ও উদ্দীপনা। আলোর বিকিরণ যতই বিস্তৃতি লাভ করে, ততই তার গতিময়তা বাড়তে থাকে, দ্রুত হতে দ্রুততর হতে থাকে তার অগ্রযাত্রা। এরই মাঝে যখন সে রুকুতে উপনীত হয়, তখন সে ভুলে যায়, চিরতরে হারিয়ে যায় তার যাত্রালগ্নটি। যা ছিল বস্তু হতে উৎসারিত। এখন আর বস্তুময় পরিম-লে সে বিচরণ করে না। তখন হতেই বস্তুহীনতার সাগরে সে পাড়ি জমায়। এভাবে অগ্রসর হয়ে চরম ও পরম লক্ষ্যে উপনীত হয় সেজদার হালতে। যেখানে আল্লাহ ছাড়া আর কিছুই নেই। এখানে বান্দাহ নিঃশেষে বিলীন হয়ে যায় সীমাহীন আলোর বন্যায়। সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু হতে গুঞ্জরিত হতে থাকে, “সোবহানা রাব্বিয়াল আলা” ধ্বনি। যেমন, আল্লাহর হাবীব (সা.)-এর জবান হতে চূড়ান্ত মুহূর্তে ধ্বনিত হয়েছিল “আল্লাহুম্মা র্ব্রািফিকিল আলা” ধ্বনি। তাই হৃদয়ের তারে তারে পরাণের শোণিত ধারে সে ধ্বনির গভীর মূর্ছনা ও ব্যাকুল ব্যঞ্জনার প্রভঞ্জন জাগিয়ে তোলে সালাতের ভিতর দিয়ে, হে পথিক! এ পথ যে অফুরান।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সত্যালোকের সন্ধানে সালাত দর্শন : একটি তাত্ত্বিক সমীক্ষা
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ