Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সিডরের কালো রাত্রির বিভিষিকা উপকুলবাসীকে আজো তাড়া করছে

ইতিহাসের ভয়াবহ প্রাকৃতিক ধ্বংসলীলার কালো রাত্রী আজ

নাছিম উল আলম | প্রকাশের সময় : ১৫ নভেম্বর, ২০২১, ৯:৩৪ এএম

ইতিহাসের ভয়াবহ প্রাকৃতিক ধ্বংসলীলা ‘সিডর’এর কালো রাত্রী আজ। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাতে বঙ্গোপসাগর থেকে প্রায় পৌনে ৩শ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে এসে উপকুলের ১০টি জেলার বিস্তীর্ণ জনপদকে লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল ভয়াল ঘূর্ণিঝড় সিডর। প্রাক-প্রস্তুতি ও আগাম সতর্কতা থাকায় ঐ ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা থেকে প্রানহানীর সংখ্যা যথেষ্ট হ্রাস করা সম্ভব হলেও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমান ছিল প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। সরকারী হিসবে যা ১৬ হাজার কোটি বলে সেনা সমর্থিত তৎকালীন তত্ত্ববধায়ক সরকারও স্বীকার করেছিল। সরকারী হিসেবে মৃতের সংখ্যা ৩ সহ¯্রাধিক বলা হলেও আরো সহ¯্রাধিক নিখোঁজের কথা জানিয়েছিল প্রশাসন। তবে ঐসব নিখোঁজদের বেশীরভাগই চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
সেই রাতের ঐ ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় দেশের উপকুলীয় ও দক্ষিনাঞ্চলের ৩০টি জেলায় কম-বেশী আঘাত হানলেও প্রায় ২শ উপজেলার সাড়ে ১৭শ ইউনিয়ন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সরকারী হিসেবে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের সংখ্যা ১৭ লাখ ৭৩ হাজার বলা হলেও বাস্তবে তা ছিল প্রায় ২০ লাখেরও বেশী। আর ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের সংখ্যাও ছিল প্রায় ১ কোটি। সরকারীভাবে ৩ হাজার ১৯৯ জনের মৃত্যু ও ১ হাজার ৭২৬ জনের নিখোঁজের কথা বলা হলেও এ সংখ্যাও আরো অনেক বেশী ছিল বলে সে সময় বিভিন্ন সাহায্য সংস্থা দাবী করে। বেশীরভাগ নিখোঁজদের আর কোন সন্ধান না মেলায় তাদের সকলকেই সিডরের বয়ে আনা জলোচ্ছ্বাস সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে নিখোঁজদের স্বজনরা নিকটজনের লাশটিও আর দেখতে পায়নি।
প্রকৃতির ঐ তান্ডবে দক্ষিন উপকুলের বিশাল জনপদের প্রায় ৪ লাখ ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ও আরো প্রায় ১০ লাখ আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। একই সাথে প্রায় ২ লাখ হেক্টর জমির আমন ধান সম্পূর্ণ ও আরো ৫ লাখ হেক্টরের আংশিক ক্ষতি হয়। প্রায় ৫০ লাখ গবাদী পশু ও হাঁস-মুরগীর মৃত্যু ঘটে সিডরের রাতে প্রকৃতির ঐ কালো থাবায়।
আবহাওয়া অধিদফতর ২০০৭-এর ১১ নভম্বর দুপুর ১২টায় দক্ষিন বঙ্গোপসাগরের আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের প্রায় ২শ কিলোমিটার ভাটিতে একটি লঘুচাপ শনাক্ত করে। যা ক্রমশ উত্তরÑপশ্চিমে অগ্রসর হয়ে আন্দামান নিকোবরকে ডানে রেখে ১৩ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় সোজা উত্তরে এগুচ্ছিল। এরপর লঘুচাপটি নিম্নচাপ থেকে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নিয়ে ক্রমশ উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে ১৪ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় বাংলাদেশ উপকুলের ৫শ কিলোমিটার দক্ষিন দিয়ে ক্রমশ বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যবর্তী রায়মঙ্গলÑহাড়িয়াভাঙ্গা সোজা অগ্রসর হয়। ঘূর্ণিঝড়টির নামকরন করা হয় ‘সিডর’।
১৫ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় ঘূর্ণিঝড় সিডর বাংলাদেশের দক্ষিনÑপশ্চিম উপকুলের মাত্র ১শ কিলোমিটারের মধ্যে চলে আসে। ঝড়টি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের উপকুলীয় সুন্দরবন এলাকা অতিক্রম করবে বলে মনে করা হলেও বিকেলেই আকষ্মিকভাবে তার গতিপথ উত্তরমুখী থেকে কিছুটা উত্তরÑপূর্বমুখী হতে শুরু করে। সন্ধ্যা ৬টার পরেই ঝড়টি উত্তরÑপূর্বমুখী হয়ে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিন সীমান্ত থেকে প্রায় ৩শ কিলোমিটার পূর্বে বরগুনা এবং বাগেরহাটের মধ্যবর্তি হরিণঘাটা-বুড়িশ্বর ও বিশখালী নদীর বঙ্গোপসাগর মোহনা দিয়ে প্রায় পৌনে ৩শ কিলোমিটার বেগে মূল ভূখন্ডে আছড়ে পড়ে।
ঝড়টির ব্যাস দেড়শ কিলোমিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও তার দৈর্ঘ্য ছিল কয়েকগুন লম্বা। সাগরাড়ের হরিণঘাটাÑপাথরঘাটা থেকে প্রায় আড়াইশ কিলোমিটার দুরে বরিশাল পর্যন্ত একই সাথে প্রায় সমান গতিবেগে সিডরের তান্ডব অব্যাহত ছিল। এমনকি খোদ বরিশাল মহানগরীতেও ঘূর্ণিঝড়-সিডর প্রায় ২২৪ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানে। সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত দেড়টা পর্যন্ত পশ্চিমে বাগেরহটের মোড়েলগঞ্জ, শরনখোলা, রামপাল থেকে বরিশাল হয়ে মাদারীপুর, শরিয়তপুর ও গোপালগঞ্জ পর্যন্ত সিডরের তান্ডব অব্যাহত ছিল। প্রায় পৌনে ৩শ কিলোমিটার বেগের ঝড়ের সাথে প্রায় ১৫Ñ২০ফুট উচ্চতার জলোচ্ছাস সে রাতে উপকুলের বাগেরহাট, পটুয়াখালী, বরিশাল, ঝালকাঠী ও পিরোজপুরের বিশাল জনপদ সহ ফসলী জমিকে লন্ডভন্ড করে দেয়।
তবে উপকুলীয় এলাকায় সেদিন সিডরের তান্ডবে ক্ষয়ক্ষতি আরো ভয়াবহ আকার ধারন করতে পারত, যদি বিশাল উপকুলীয় সবুজ বেষ্টনী ও পরিকল্পিত বনায়ন না থাকত। সেই রাতে প্রকৃতির ঐ তান্ডব প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিহত করেছিল প্রকৃতিই। কাল রাত্রির ঐ তান্ডব সামাল দিতে সে রাত উপকুলীয় বনায়ন কর্মসূচী ও সবুজ বেষ্টনী প্রকল্পের লক্ষ লক্ষ গাছ ছাড়াও সাধারন মানুষের প্রায় এক কোটি গাছ মাটিতে মিশে যায় ।
ঐ ঝড়ে প্রায় পৌনে ৭শ কিলোমিটার আঞ্চলিক ও জাতীয় মহাসড়ক সহ পল্ল¬ী যোগাযোগ অবকাঠামো সম্পূর্ণ এবং প্রায় ৯০ হাজার কিলোমিটার সড়ক আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বিধ্বস্ত এলাকার প্রায় ১৮শ সরকারীÑবেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ ও প্রায় সাড়ে ৬ হাজার আংশিক ক্ষতির কবলে পড়ে। বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কের ১ হাজার ৬৫৪টি সেতু এবং কালভার্ট সম্পূর্ণ ও প্রায় ৯শটি আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
সিডর আঘাত হানার দিন সকাল থেকেই রেড ক্রিসেন্ট-এর ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচীর ৪০ সহ¯্রাধিক স্বেচ্ছাসেবক উপকুলের লক্ষাধিক মানুষকে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রে স্থানান্তর সহ দূর্যোগ পরবর্তী উদ্ধার তৎপরতায়ও অত্যন্ত সাহসী ও মানবিক দায়িত্ব পালন করে।
তবে সিডর উত্তরকালে প্রায় ৪০টি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা বিভিন্ন সাহায্যÑসহযোগীতার আশ্বাস দিলেও তার মধ্যে ৩২টি দেশ পরবর্তীতে তা বাস্তবায়ন করেনি। এমনকি ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রী প্রনব মুখার্জীও বরিশাল বিমান বন্দর হয়ে শরনখোলার ঘূর্ণি উপদ্রুত এলাকা সফর করে সেখানের কয়েকটি গ্রামের দূর্গতদের ঘরবাড়ী নির্মান করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও তার বাস্তবায়ন হয় পরবর্তি সরকার ক্ষমতা গ্রহনেরও প্রায় দেড় বছর পরে। পাকিস্তান সরকার সেদিন বাংলাদেশের ঘূর্ণি উপদ্রুত এলাকায় তার সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের পাঠিয়ে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ এবং চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম গ্রহণ করছিল। পাক বিমান বাহিনীর ৪টি ‘সি-১১০’ পরিবহন বিমান বরিশাল বিমান বন্দরে ত্রান ও উদ্ধারকারী দল নিয়ে অবতরন করে। বরিশাল থেকে ২টি মোবাইল হাসপাতাল সহ পাক সম্মিলিত বাহিনী সেদিন পিরোজপুরের মঠবাড়ীয়া ও ভান্ডারিয়াতে চিকিৎসা সহায়তা কার্যক্রমের পাশাপাশি বিশুদ্ধ পানি সরবরাহেও অংশ নেয়। একই সাথে মার্কিন মেরিন সেনারাও ঘূর্ণি উপদ্রুত উপকুলীয় এলাকায় পানি সরবরাহ ও চিকিৎসা সেবা কার্যক্রমে অংশ গ্রহন করে।
ভয়াল সিডরের কালো রাত্রির বিভিষিকা গোটা উপকুলবাসীকে আজো তাড়া করছে।

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ