Inqilab Logo

মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

গণতন্ত্র-ধনতন্ত্রের সংঘাত এবং পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা

প্রকাশের সময় : ১৯ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জামালউদ্দিন বারী
ঊনবিংশ শতকের শেষদিকে ইউরোপীয় সা¤্রাজ্যগুলোর জটিল ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থদ্বন্দ্ব এবং রাশিয়া ও বলকান অঞ্চলকে ঘিরে নতুন নতুন সামরিক-রাজনৈতিক গাঁটছড়ার মধ্য দিয়ে ১৯১৪ সালে প্রথম মহাযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। প্রায় ছয় বছরব্যাপী যুদ্ধের পরিসমাপ্তিতে হলি এলায়েন্স বা মিত্রপক্ষের বিজয়ের মধ্য দিয়ে অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয় সা¤্রাজ্য, জার্মানির কাইজার সা¤্রাজ্য এবং অটোমান সা¤্রাজ্যের পতন নিশ্চিত হয়। মূলত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পতিত সা¤্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর পুনরায় মাথা তুলে দাঁড়ানোর ক্ষমতা দাবিয়ে দিতেই মাত্র দুই দশকের মধ্যে নতুন ধনতান্ত্রিক সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির জন্য আরেকটি মহাযুদ্ধের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। রাজত্বের নিরাপত্তা ও সা¤্রাজ্য সম্প্রসারণের উচ্চাভিলাষ সম্পর্কিত স্বার্থ নিয়ে রাজায় রাজায় দ্বন্দ্ব সভ্যতার সমান পুরনো। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ যুদ্ধের সেই পুরনো স্বার্থের ধারণাকে বদলে দিয়ে একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। প্রথমদিকে সরাসরি মহাযুদ্ধে সম্পৃক্ত না থাকলেও পার্ল হার্বারে জাপানি বিমান বাহিনীর বোমা হামলাকে কেন্দ্র করে অবশেষে আটলান্টিকের অপর পারের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে যুদ্ধজয়ের মূল অনুঘটক হিসেবে আর্বিভূত হয় এবং জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে পারমাণবিক বোমা ফেলে শহর দুটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার মধ্য দিয়ে অক্ষশক্তির অন্যতম ভিত্তি জাপানকে যুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে পরাজয় মেনে নিতে বাধ্য করা হয়েছিল। অর্থাৎ বিশ্বের প্রথম এবং একমাত্র পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভাগ্য ও ফলাফল নিজের পকেটে ভরতে সক্ষম হয়েছিল। সেই থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বকে মার্কিনিরা নিজেদের বিশ্ব বলে দাবি করতে শুরু করে। বিশাল আয়তন ও অর্থনৈতিক-সামরিক ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতার কারণেই যুদ্ধের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমা মিত্ররা মার্কিনিদের নতুন বিশ্বব্যবস্থার ধারণাকে গ্রহণ করেই নতুন সা¤্রাজ্যবাদী খেলায় লিপ্ত হয়। প্রথম মহাযুদ্ধের মাঝপথেই ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় ভøাদিমির ইলিচ লেনিনের নেতৃত্বে সংঘটিত সমাজতান্ত্রিক বলশেভিক বিপ্লব পশ্চিমা ধনতান্ত্রিক পুঁজিবাদীদের জন্য নতুন মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশাল সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে যুক্ত হওয়া পূর্ব ইউরোপ ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর আন্তর্জাতিক প্রভাব বলয় শক্তির ক্ষেত্রে বিশ্বে এক ধরনের ভারসাম্য তৈরি করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপীয় মিত্ররাও একে একে পারমাণবিক বোমায় সজ্জিত হতে শুরু করার মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর দুনিয়া একটি পারমাণবিক চুল্লিতে পরিণত হয়। এখন বিশ্বের অন্তত ১৫টি রাষ্ট্রের হাতে কয়েক হাজার পারমাণবিক বোমার মজুদ রয়েছে, যা দিয়ে গোটা বিশ্বকে অন্তত দশবার ধ্বংস করা সম্ভব। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা বিজয়ী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হলেও এখন নতুন বাস্তবতায় দ্বিধাবিভক্ত বিশ্বের উভয় পক্ষের হাতেই হাজার হাজার পারমাণবিক বোমা রয়েছে। সাগরে, পাহাড়ের গভীরে এবং ভূ-পৃষ্ঠের সুগভীর বাঙ্কারে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য পারমাণবিক বোমা। ইচ্ছা করলেই কোনো পক্ষের সব বোমা একসাথে ধ্বংস করতে পারবে না, এটা প্রায় নিশ্চিত। সম্ভাব্য আগামী মহাযুদ্ধ যদি পারমাণবিক যুদ্ধে রূপ নেয় তবে পুরো বিশ্বই একটি অনিবার্য ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে পারে।
উত্তর আমেরিকাকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত করে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফাউন্ডিং ফাদারদের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের মুখোমুখি হয়েছিল। ঔপনিবেশিক সামন্তবাদ, ডায়ন্যাস্টিক কৌলিন্য ও দ্বিধাবিভক্ত মার্কিন জাতিকে বর্ণবাদী বৈষম্য ও দাসত্ব প্রথা থেকে বের করে এনে একটি ন্যায় ও সাম্যভিত্তিক রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত করার মূলমন্ত্রটি ছিল গণতন্ত্র। রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের বিজয় ছিনিয়ে আনা মার্কিন স্বাধীনতার অন্যতম স্থপতি, যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের একটি বিখ্যাত উক্তি হচ্ছেÑ ‘দ্য ব্যাসিস অব আওয়ার পলিটিক্যাল সিসটেম ইজ দ্য রাইট অব দি পিপল টু মেইক অ্যান্ড টু অল্টার দেয়ার কনস্টিটিউশনস অব গভর্নমেন্ট’Ñ অর্থাৎ ‘আমাদের রাজনীতির মূল বিশেষত্ব হচ্ছে শাসনতন্ত্র তৈরি এবং তা পরিবর্তনের যাবতীয় ক্ষমতা বা অধিকার জনগণের হাতে’। যদিও মার্কিন গণতন্ত্র কখনই তার ফাউন্ডিং ফাদারদের স্বপ্নের কাছাকাছি পৌঁছতে পারেনি। শুধুমাত্র ধনতান্ত্রিক সা¤্রাজ্যবাদী অভিপ্সা পূরণের স্বার্থেই মার্কিন শাসকরা যুগে যুগে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ছবক বিলিয়েছেন। কর্পোরেট পুঁজিবাদের স্বার্থ অক্ষুণœ রেখে নিজ দেশে যতটা সম্ভব গণতান্ত্রিক চর্চা অব্যাহত রাখার কৌশল গ্রহণ করলেও বিদেশে তারা নিজেদের ইচ্ছামতো গণতন্ত্র চাপিয়ে দিতে অনেকটা আপসহীন। পুঁজিবাদী স্বার্থের বাইরে গিয়ে সত্যিকার অর্থে জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে মার্কিন রাষ্ট্রযন্ত্রের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ তা সমূলে ধ্বংস করে দিয়েছে, বিশ্ব ইতিহাসে এমন ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৬তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন গণতন্ত্রের সঠিক স্পিরিটকে ধারণ করেছিলেন, ‘ডেমোক্রেসি ইজ অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল অ্যান্ড ফর দ্য পিপল’ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক ও ছাত্রদের কাছে এখনো তার দেয়া গণতন্ত্রের এই সংজ্ঞাটি সারা বিশ্বে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয়। তবে জনগণই যদি জনগণের সকল ক্ষমতা, শাসন ও সম্পদের মালিক হয়, তবে গুটিকতক মানুষের হাতে হাজার হাজার কোটি ডলার পুঞ্জীভূত হওয়ার সুযোগ থাকে না। কেউ ফুটপাতে অভুক্ত রাত যাপন করবে আর কেউ বিলাসবহুল জেট প্লেনে ঘুরে বেড়াবে, ন্যায়ভিত্তিক গণতান্ত্রিক শাসনে তা অসম্ভব। সত্যিকারের গণতন্ত্রের সাথে ধনতন্ত্রের সংঘাত এখানেই। নিজ দেশে গণতন্ত্রের আদি স্পিরিট অনুসারে সত্যিকারের জনগণের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আব্রাহাম লিঙ্কনকে আততায়ীর হাতে খুন হতে হয়েছিল ১৮৬৫ সালে। তিনি বলেছিলেন, (‘আই অ্যাম দ্য ফার্ম বিলিভার ইন দি পিপল, ইফ গিভেন দ্য ট্রুথ, দে ক্যান বি ডিপেন্ডেড আপন টু মিট এনি ন্যাশনাল ক্রাইসিস) জনগণের প্রতি আমি পূর্ণ আস্থাশীল, তাদের কাছে সত্য উন্মোচন করা হলে তারা নিজেদের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে জাতির যে কোনো সংকট মোকাবেলা করতে পারে। পুঁজিবাদী ভিত্তির ওপর গড়ে ওঠা পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদ কখনই গণতন্ত্রের মূল স্পিরিটকে ধারণ করতে পারেনি। রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নেতা লেনিন বলেছিলেন, পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে মানুষের স্বাধীনতা সর্বদাই প্রাচীন গ্রিসের মতো, যেখানে স্বাধীনতা মানে দাস মালিকদের স্বাধীনতা। (ফ্রিডম ইন ক্যাপিটালিস্ট সোসাইটি অলওয়েজ রেমেইন্স অ্যাবাউট দ্য সেইম অ্যাজ ইট ওয়াজ ইন অ্যানশিয়েন্ট গ্রিক : ফ্রিডম ফর স্লেইভ ওনার্স’)। শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষকে নানাভাবে বঞ্চিত রেখে একভাগ পুঁজিপতির স্বার্থরক্ষার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে পুঁজিবাদী বিশ্বের রাষ্ট্রব্যবস্থা। শুধুমাত্র পুঁজির বাজার ও অর্থনৈতিক সা¤্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো অপেক্ষাকৃত দুর্বল ও ভঙ্গুর রাষ্ট্রগুলোর ওপর খবরদারি করছে। সেসব দেশে সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক শাসন ও জনগনের ঐক্য ঠেকিয়ে রাখতেই গৃহযুদ্ধ ও আঞ্চলিক সংঘাত চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। গত শতাব্দীর শেষ দিকে সমাজতন্ত্রের পতনের আগেই পুঁজিবাদের বিশ্বায়ন ঘটে যায়। প্রচুর দক্ষ জনশক্তি, উদ্ভাবনী প্রতিভা ও এন্ট্রেপ্রেনারশিপের হাত ধরে চীন, ব্রাজিল, ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর শিল্পায়ন ও বাণিজ্য সম্প্রসারণের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদের নতুন মেরুকরণ ঘটে গেছে। চীন, রাশিয়া, ইরান ও পাকিস্তানের মতো ভূ-রাজনৈতিক পরাশক্তিগুলো পশ্চিমা একাধিপত্যের বিরুদ্ধে কৌশলগতভাবে জোটবদ্ধ হওয়ার প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যবস্থার সংঘাত এখন নতুন মোমেন্টাম গ্রহণ করেছে।
কয়েক বছর ধরে বিশ্ব একটি জটিল ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ এবং রিজিম চেঞ্জের নামে মধ্যপ্রাচ্যে পরাশক্তিসমূহের জটিল রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের দাবা খেলা ক্রমে রক্ষক্ষয়ী হয়ে ওঠার মধ্য দিয়ে চলমান বিশ্ব তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাস্তবতায় প্রবেশ করতে শুরু করেছে বলে কোনো কোনো পশ্চিমা রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছেন। সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন, লিবিয়াকে বিশৃঙ্খল ও অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার পাশাপাশি ইউক্রেনে একটি বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে পশ্চিমা পুতুল সরকার বসিয়ে রাশিয়ার প্রতি বড় ধরনের ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বিশ্বকে আবারো কোল্ড ওয়ারের যুগে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। সমাজতন্ত্রের পতন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের মধ্য দিয়ে শক্তির ভারসাম্য বিনষ্ট হওয়ায় প্রায় চার দশকের কোল্ড ওয়ারের সমাপ্তি এবং ইউনিপোলার মার্কিন আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। শক্তি ও রাজনৈতিক স্বার্থদ্বন্দ্বের এই ভারসাম্যহীনতার শুরু থেকে মধ্যপ্রাচ্যে একের পর এক সামরিক আগ্রাসন ও ব্যর্থরাষ্ট্রের জন্ম দিতে থাকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোট। সেই সাথে মার্সেনারি বাহিনী হিসেবে বিদ্রোহী ও সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে ব্যবহার করে লিবিয়ায় গাদ্দাফির মতো বলিষ্ঠ নেতাকে চরমভাবে পরাস্ত ও হত্যা করা হয়েছে। একইভাবে সিরিয়ায়ও গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে হটাতে আরো বড় পরিসরে প্রায় একই পন্থা অবলম্বন করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের বশংবদ মিত্ররা। বাস্তবতা হচ্ছে, গত ৫ বছরে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু, কোটি মানুষ উদ্বাস্তু ও দেশান্তরী হওয়ার পরও বাশার আল আসাদকে হঠাতে পারেনি পশ্চিমারা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা বিদ্রোহীদের অস্ত্র ও রসদ জুগিয়ে আসছে যুদ্ধের শুরু থেকেই, অনেক দেরিতে রাশিয়া ও ইরান বাশার সরকারের অনুরোধে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসার পর সিরিয়া যুদ্ধের দৃশ্যপট সম্পূর্ণ বদলে যেতে শুরু করে। সিরিয়া এখন মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের জন্য বড় ধরনের প্রেস্টিজ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে বিপজ্জনক খবর হচ্ছে, মার্কিন সামরিক জোট এখন সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর ওপর বিমান হামলা করতে শুরু করেছে। প্রথমে ভুলক্রমে বিমান হামলা করে বহু কষ্টে অর্জিত যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভ-ুল করে দেয়ার পর এবার আনুষ্ঠানিকভাবে সিরিয়ায় বিমান হামলার হুঁশিয়ারি দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়ার সহযোগিতায় সিরিয়ার সরকারি বাহিনী বিদ্রোহীদের কাছ থেকে একের পর এক ঘাঁটি ও অধিকৃত অঞ্চলগুলো যখন দখল করে নিচ্ছে। বিদ্রোহীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শক্ত ঘাঁটি আলেপ্পো বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে চলে আসার প্রেক্ষাপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরেকটি যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব নিয়ে এ সপ্তায় ইউরোপে আলোচনায় বসেছিল। বিদ্রোহীদের পক্ষে মার্কিনিদের অবস্থান এবং সিরিয়া সরকারের পক্ষে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের দৃঢ় অবস্থানের কারণে নতুন যুদ্ধবিরতির সমঝোতা প্রস্তাব ব্যর্থ হয়ে গেছে। গত শুক্রবার সুইজারল্যান্ডের লুসানে সিরিয়ায় যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকটিতে রুশ-মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ঐকমত্যে পৌঁছতে ব্যর্থ হলেও সভায় উপস্থিত দেশগুলোর প্রতিনিধিরা সিরিয়ার ভবিষ্যৎ নির্ধারণে সে সেদেশের জনগণের রায়ই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে বলে মত দিয়েছেন বলে দাবি করেছেন রাশিয়ান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত সবচেয়ে বড় শহর আলেপ্পো সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর দখলে চলে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেখানে সামরিক অভিযান বন্ধ করার দাবি জানিয়ে যুদ্ধ বিরতির নতুন প্রস্তাব তুলেছে। এর আগে গত ৯ সেপ্টেম্বরে বহু সাধনার পর অর্জিত যুদ্ধবিরতির এক সপ্তাহের মাথায় মার্কিন বিমান বাহিনী বোমা বর্ষণ করে সিরীয় সেনাবাহিনীর অন্তত ২০ জনকে হত্যা ও বহুজনকে আহত করার মধ্য দিয়ে যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভেঙে যায়।
সিরিয়া প্রশ্নে লুসান শান্তি আলোচনায় মার্কিনিদের লক্ষ্য অর্জিত না হওয়ায় তারা খুবই নাখোশ হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন সিরিয়ায় বিমান হামলা জোরদার করার ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে রাশিয়া ইতোমধ্যেই সিরিয়ায় তাদের সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধির পাশাপাশি মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমসহ কৌশলগত সমর প্রযুক্তির সন্নিবেশ ঘটিয়েছে। পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফে একটি পারমাণবিক যুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা প্রকাশ করে পাল্টা প্রস্তুতি গ্রহণেরও ঘোষণা দিয়েছে রাশিয়া। অন্যদিকে দক্ষিণ চীন সাগরের সীমানা বিরোধকে কেন্দ্র করে চীনের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উত্তেজনা চলছে দীর্ঘদিন ধরেই। একদিকে ইউক্রেন ও সিরিয়াকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাংঘর্ষিক অবস্থান, অন্যদিকে দক্ষিণ চীন সাগরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর উপস্থিতি এবং চীনের ক্রমাগত নৌশক্তি বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে চীন সাগরের উত্তেজনাকে ঘিরেই একটি নতুন মহাযুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। রাশিয়ার পাশাপাশি সিরিয়ায় এখন বিশ্বের বৃহত্তম ও শক্তিশালী চীনা সেনাবাহিনীও সরাসরি জড়িতে পড়তে শুরু করেছে বলে জানা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা সামরিক বাহিনী তাদের মার্সেনারি গ্রুপগুলো ইরাক, আফগানিস্তান ও লিবিয়ায় রিজিম চেঞ্জ করার পর দশক পেরিয়ে গেলেও সেখানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। অবশ্য মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি থাকল কি থাকল না, সিরিয়ার লাখ লাখ মানুষের জীবন, কোটি কোটি মানুষের আশ্রয়হীনতা তাদের মাথাব্যথার কারণ নয়। ইতোমধ্যে জ্বালানি তেলের দাম প্রায় ৭০ ভাগ পড়ে গেছে। মার্কিন কর্পোরেট কোম্পানিগুলো আইএস ও বিদ্রোহী অধিকৃত তেলক্ষেত্রগুলো থেকে নামমাত্র মূল্যে তেল কিনে নিয়ে যাচ্ছে। বাশার আল আসাদকে হটিয়ে সিরিয়াকে কয়েক ভাগে ভাগ করে সেখানে মার্কিনিদের পুতুল সরকার কায়েম করতে পারলে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসম্পদের ওপর পশ্চিমা আধিপত্য এবং ইসরাইলের নিরাপত্তা আরো অনেক দিনের জন্য সুসংহত হতে পারে, এই লক্ষ্যেই সিরিয়ায় রিজিম চেঞ্জের পশ্চিমা আয়োজন শুরু হয়েছিল। মিথ্যা অজুহাতে ইরাকে ন্যাটোর সামরিক আগ্রাসনে এবং ফলস্ ফ্লাগ বিদ্রোহ এবং ফরাসি বিমান হামলায় সহজেই লিবিয়ায় রিজিম চেঞ্জ সম্ভব হলেও সিরিয়ায় ইতোমধ্যেই পশ্চিমাদের দাঁত ভেঙে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পশ্চিমা পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার জন্য এটি এখন বাঁচামরার লড়াই হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন এন্টি-ওয়ার অ্যাক্টিভিস্ট শিন্ডি শিহান যিনি পিস মম (শান্তি মাতা) হিসেবে সমধিক পরিচিত, তার লেখা একটি নিবন্ধ সম্প্রতি আইসিএইচ অনলাইনে প্রকাশিত হয়েছে। তার লেখার শিরোনামÑ (ইউএস ব্রিঙ্গিং ওয়ার্ল্ড টু দি ব্রিঙ্ক অব নিউক্লিয়ার ওয়ার) ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকে পারমাণবিক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে’। শিন্ডি শিহানের যুদ্ধবিরোধী কর্মকা-, বিশেষত সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের টেক্সাস রেঞ্জের বাড়ির সামনে যুদ্ধবিরোধী অবস্থান কর্মসূচি এবং বুশের কাছে লেখা খোলা চিঠির কারণে সারা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। শিন্ডির একমাত্র পুত্র ক্যাসি শিহান মার্কিন সেনাবাহিনীর সামরিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে ইরাকে গিয়েছিল ২০০৩ সালের পর, সেখানে ইরাকি আত্মঘাতী বোমা হামলায় তার মৃত্যু হয়। এরপরই শিন্ডি শিহান মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদী যুদ্ধনীতির বিরুদ্ধে জনমত গঠন করতে শুরু করেন। অন্যায় যুদ্ধে পুত্র হারানো শিন্ডি শিহান এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটি ভয়ঙ্কর পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। প্রায় শতাব্দীকাল ধরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বে যুদ্ধের বিভীষিকা ছড়িয়ে চলেছে বলে মন্তব্য করেছেন শিহান। সিরিয়ায় আসাদকে সরিয়ে সেখানে একটি পাপেট সরকার বসানোর মার্কিনি চক্রান্ত ব্যর্থতার দ্বারপ্রান্তে চলে আসা এবং চলমান সামগ্রিক বিশ্ব পরিস্থিতি বিশ্বকে ইউনিপোলার থেকে আবারো বাইপোলার বা দ্বিমেরুকেন্দ্রিক বিশ্বে পরিণত করেছে। সমাজতন্ত্রের পতনের মধ্য দিয়ে শক্তির ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার পর ইউনিপোলার পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং রিজিম চেঞ্জের নামে মধ্যপ্রাচ্যসহ গোটা বিশ্বকেই আগের চেয়ে অনিরাপদ, অস্থিতিশীল ও ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। সিরিয়ায় রাশিয়া, চীন, ইরানের হস্তক্ষেপে পশ্চিমাদের স্বপ্নভঙ্গ হওয়ার মধ্য দিয়ে শক্তির ভারসাম্য এবং গায়ের জোরে রিজিম চেঞ্জের বর্বরতা বন্ধ হতে পারে। শক্তির এই ভারসাম্য মধ্যপ্রাচ্যে একটি স্থায়ী শান্তির পথ সুগম করতে পারে। ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলের আগ্রাসন ও দখলদারিত্ব বন্ধের নতুন প্রেক্ষাপটও শুরু হতে পারে। আল আকসা কমপ্লেক্সের ওপর শুধুমাত্র মুসলমানদের অধিকারের প্রশ্নে সম্প্রতি ইউনেস্কোর দেয়া ঐতিহাসিক রায় বিশ্বে ফিলিস্তিনি সলিডারিটিকে আরো সংহত ও শক্তিশালী করবে। ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শর্তহীন কৌশলগত বন্ধুত্ব সত্তর বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যকে অশান্ত-অগ্নিগর্ভ করে রেখেছে। তাদের প্রচলিত সামরিক শক্তি ও কৌশলগত সামরিক ব্যবস্থা এখন আর কাজ করছে না। তারা এখন পারমাণবিক যুদ্ধের কথা ভাবছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি এখনো দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কালেই বসবাস করছে? সেই যুদ্ধে একমাত্র পারমাণবিক বোমার অধিকারী ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া ও চীন ছিল তার মিত্রশক্তি। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের হাতে যে পরিমাণ পরমাণু অস্ত্র আছে চীন-রাশিয়ার ভা-ারে অস্ত্রের পরিমাণ তার থেকে কম নেই। কোনো পাগলের হাতে পরাশক্তির রাষ্ট্রক্ষমতা অর্পিত না হলে কেউ এখন আর পারমাণবিক যুদ্ধের ঝুঁকি নেবে না, এটা প্রায় নিশ্চিত। আর পারমাণবিক যুদ্ধের মাধ্যমে আগামী সম্ভাব্য মহাযুদ্ধের জয়পরাজয় নির্ধারণের কোনো সুযোগ নেই। বিশ্বসভ্যতার পতন ঘটিয়ে কেউ নিজের বিজয় দাবি করতে পারে না। অতএব অর্থনৈতিক সা¤্রাজ্যবাদের ওপর গণতন্ত্র ও মানবতার বিজয় অবশ্বম্ভাবী হয়ে উঠেছে। সিরিয়া, ইরাক, ফিলিস্তিন, ইউক্রেন ও কাশ্মীরের মানুষের রায়েই তাদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের সুযোগ অর্পণ করা হোক। মানবতা ও বিশ্বসভ্যতার ঐতিহ্য রক্ষায় রাশিয়া, আমেরিকা, চীন ও ইউরোপীয় পরাশক্তিগুলোকে সা¤্রাজ্যবাদী যুদ্ধের প্রতিযোগিতা ছেড়ে শান্তির অভিন্ন পথেই হাঁটতে হবে।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: গণতন্ত্র-ধনতন্ত্রের সংঘাত এবং পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ