Inqilab Logo

সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পৌনে দুই বছরেও শেষ হয়নি তদন্ত

প্রকাশের সময় : ১৭ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

অজানা থেকে যাবে অহনার মৃত্যুর জন্য দায়ী কে?

হাসান সোহেল : চকিৎসকদের অজ্ঞতায় আর দায়িত্বহীনতায় মাত্র সাড়ে চার বছরে মৃত্যুকে বরণ করতে বাধ্য হয় মিষ্টি মেয়ে অহনা। অহনার বাবা মির্জা শাহপার জলিলের (আবীর) দাবি চিকিৎসকদের ভুলে আর অবহেলায় তার শিশু কন্যার মৃত্যু ঘটেছে। তাই এই ঘটনার সুবিচার দাবি করে মেয়ের চিকিৎসায় সম্পৃক্ত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।
মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত নং ৩৩-এ দায়ের করা এই মামলায় আসামি হিসেবে রয়েছেন- ল্যাব-এইড স্পেশালাইজড হাসপাতালের চীফ কনসালটেন্ট শিশু বিভাগ ডা. কাজী নওশাদ-উন-নবী, স্কয়ার হাসপাতালের কনসালটেন্ট শিশু বিভাগ এবং পিআইসিইউ ডা. মো. মাসুদুর রহমান; স্কয়ার হাসপাতালের তৎকালীণ পরিচালক (চিকিৎসা সেবা) প্রফেসর ডা. সানোয়ার হোসেন, স্কয়ার হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী।
মামলার পর আদালত অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে এবং এ সংক্রান্ত তদন্তের জন্য একটি মেডিকেল টিম গঠন করতে ২০১৫ সালের ১১ জানুয়ারি বিএসএমএমইউ’র তৎকালীন ভিসি প্রফেসর ডা. প্রাণ গোপাল দত্তকে বলা হয়। তিনি একটি টিম গঠন করে দিলেও বিগত পোনে দুই বছরেও সেই টিম তদন্তের কোন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করতে পারেনি।
মামলার অনুলিপি থেকে দেখা যায়, ২০১৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের কথা থাকলেও সে দিন কোন প্রতিবেদন আসে নি। তাই ২০ এপ্রিল প্রতিবেদন দাখিলের পরবর্তী দিন ধার্য্য হয়। সেই দিন বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ তদন্তে সময়সীমা বৃদ্ধির আবেদন করে। সে প্রেক্ষিতে ২১ মে তদন্ত প্রতিবেদন প্রদানের আদেশ দেন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ জাকির হোসেন টিপু। পাশপাশি মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেন। কিন্তু পরবর্তী নির্ধারিত দিনে অর্থাৎ ৩১ মে ২০১৫ তারিখে পূণরায় তিনমাস সময় বৃদ্ধির জন্য আবেদন করা হয়। এরপর প্রতিটি ধার্য্য তারিখেই প্রতিবেদন দাখিল না করে পূণঃসময় চাওয়া হয়।
এক পর্যায়ে ১২ সেপ্টেম্বর তারিখে মামলার শুনানী অনুষ্ঠিত হয়। শুনানীতে তদন্ত কমিটির পক্ষ থেকে ব্যাংকক সামিতাভেজ চিলড্রেন হসপিটাল পরিদর্শনে বিষয়ে উল্লেখ করা হয়। যেহেতু অহনার সর্বশেষ চিকিৎসা সেখানেই হয়েছে। কিন্তু তদন্ত কমিটির সেখানে যাওয়ার ব্যয়ভার কে বহন করবে। এক্ষেত্রে আদালত বিষয়টি আলোর মুখ দেখবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। আদেশে উল্লেখ করা হয়, উক্ত খরচ প্রদানের আর্থিক সক্ষমতা বাদী পক্ষের নেই। আদালতেরও এমন কোন খাতের অস্তিত্ব নেই। তাই স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসে বিষয়টি টাকার অভাবে আলোর মুখ দেখবে কিনা। তবে আদালতের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটিকে ব্যাংককে না গিয়ে বিকল্প তিনটি পথও বাতলে দেওয়া হয়। প্রথমত বাদী পক্ষের কাছে থাকা ব্যাংকক সংশ্লিষ্ট হসপিটালের চিকিৎসকদের কাগজাদি পর্যালোচনা, ই-মেইলে যোগাযোগের মাধ্যমে উক্ত হাসপাতাল থেকে প্রয়োজনীয় তথ্যসংগ্রহের করে তদন্ত সম্পন্ন করা অথবা দূতাবাসের মাধ্যমে সরকারি ভাবে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে তদন্ত শেষ করা। তবে এতোসব পরামর্শের পরেও এখনো তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেনি সংশ্লিষ্ট কমিটি।
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় তদন্ত কমিটির আহবায়ক প্রফেসর ডা. শহিদুল্লা এবং সদস্য সচিব ডা. মোহাম্মদ হোসেন এর কাছে। তারা উভয়ে বলেন, বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় ব্যাংককে গিয়েই তদন্ত সম্পন্ন করতে হবে। অন্যথায় তদন্ত সুষ্ঠু নাও হতে পারে।
তবে তদন্তের নামে সময়ক্ষেপণ প্রকৃত বিচারের পথে অন্তরায় বলে মনে করেন মামলার বাদি অহনার বাবা মির্জা শাহপার জলিল। তিনি বলেন, থাইল্যান্ডের চিকিৎসা সংক্রান্ত সকল কাগজাদি রয়েছে। যা থেকে অভিযুক্তদের চিকিৎসায় অবহেলা এবং অজ্ঞতা স্পষ্টত প্রতিয়মান। তারপরেও তদন্ত কমিটির এ ধরনের আচরণ হতাশাব্যঞ্জক।
উল্লেখ্য, ২০১৩ এর এপ্রিলে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে অহনা। কোন কারণ ছাড়াই বমি, কিছুই খেতে না পারা, খেলেই বমি ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দেয়। প্রায় দেড় মাস একই সমস্যা ভুগে অনেকটা দূর্বল হয়ে পড়লে ১৮ই মে ল্যাব-এইড স্পেশালাইজড হসপিটালের ডাক্তার ডা. নওশাদ-উন-নবীর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি সব শুনে অহনা ভারটিগো/মাইগ্রেনে ভুগছে বলে জানান তিনি। কোন প্যাঁথলজিকাল টেস্ট ছাড়াই ডা. নওশাদ-উন-নবী অহনাকে বমির ওষুধ, কিছু ভিটামিন এবং বমি হলে এ্যাটোরেড নামের বিদেশী এনার্জি ড্রিংক খাওয়ানোর পরামর্শ দেন। এরপর শারিরীক অবস্থা আরও নাজুক হয়ে পড়ে। ঘাড় শক্ত হয়ে যায় এবং শিশুটি বার বার মাথা ব্যথার কথা বলতে থাকে। এই প্রেক্ষিতে পুনরায় ডা. নওশাদ-উন-নবীর কাছে গেলে ওষুধ চালিয়ে যেতে বলেন। অবস্থার অবনতি হলে ল্যাব-এইডয়ে ভর্তির পরামর্শ দেন। ওই দিনই অহনা আরো অসুস্থ হলে সকাল সাড়ে ১১টায় ল্যাব-এইড স্পেশালাইজড এর আইপিডিতে ভর্তি করা হয়। বিকেল ৫টায় এমআরআই করা হয়। সন্ধা ৬টায় ডিউটি ডাক্তার জানায় পরীক্ষায় ওর ব্রেইনে একটা টিউমার পাওয়া গেছে যেটা বেশ খারাপ অবস্থায় পৌঁছে গেছে। বিষয়টি ডা. নওশাদ-উন-নবীকে জানালে এটি নিউরোলজিস্টদের বিষয়’ বলে জানান। এরপর সন্ধ্যা সাতটায় ডা. মিজানুর রহমান (নিউরোলজিস্ট) অহনাকে দেখে তার অবস্থা অত্যন্ত খারাপ বলে মন্তব্য করেন। জরুরী ভিত্তিতে অহনার ব্রেইনে আটকে পড়া সিএসএফ রিলিজ করাতে হবে জানান। ডা. মিজান তাদের ব্রেইনের টিউমারটি অপসারণ না করালে প্রথমত সে অন্ধ হয়ে যাবে এবং মৃত্যু ঝুঁকিতে পড়বে বলে জানান। এ বিষয়ে তিনি একই হাসপাতালের চিকিৎসক নিউরোসার্জন ডা. জিল্লুর রহমানের পরামর্শ গ্রহণ করতে বলেন। তৎক্ষণাৎ ডা. জিল্লুর রহমানের সঙ্গে দেখা করে বিস্তারিত জানালে তিনি আসছেন বলে জানিয়ে সাড়ে ৩ ঘন্টা পার করেন। রাত সাড়ে ১১টায় অহনাকে দেখে অন্য হাসপাতালে স্থানান্তরের পরামর্শ দেন। এর কারণ হিসেবে ডা. জিল্লুর বলেন, ল্যাব-এইড স্পেশালাইজডে এ ধরনের অপারেশনের পর শিশুদের রাখার কোন পিআইসিইউ সুবিধা নাই। অর্থাৎ সকাল ১১টায় মেয়েকে ল্যাব-এইডে ভর্তি করি আর রাত সাড়ে ১১টায় হাসপাতালে পর্যাপ্ত সুবিধা নেই বলে স্থানান্তর করতে বলা হয়। এই পরিস্থিতিতে ল্যাব এইডের একজন ডিউটি ডাক্তারের পরামর্শে অহনাকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে নেয়া হয়। ওই রাতে স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও পরদিন সকাল ৯টায় নিউরোসার্জন ডা. পার্থ প্রতীম বিষ্ণু অহনার বাবা-মাকে ডেকে জরুরী ভিত্তিতে অপরেশন করার বিষয়ে জানান। এরপর অপারেশন শুরু হয়। বেলা সাড়ে ১১টায় ডা. পার্থ প্রতীম বিষ্ণু ওটি থেকে বেরিয়ে অপারেশন সাক্সেসফুল হয়েছে জানান। তবে বিকাল ৪টার দিকে জানানো হয়, অহনার অবস্থা আশঙ্কাজনক। পরিবারে পক্ষ থেকে কারণ জানতে চাইলে স্কয়ারের চিকিৎসকরা অশোভন আচরণ করে। তবে এসব প্রতিকুলতা পেরিয়ে ব্যাংককের ‘সামিতিভেজ শ্রীনাকারিন চিলড্রেন হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানকার চিকিৎসকরা দ্রুত অহনার চিকিৎসা শুরু করে এবং তার টিউমারের ৯৯ভাগ অপসারণ করেন। তারা জানান, ব্রেইন হেমারেজ এর রিকভারি করার গোল্ডেন টাইম হল ৬ ঘন্টার মধ্যে চিকিৎসা করা। কিন্তু অহনার হেমারেজ এর স্থায়িত্ব ৪৮ ঘন্টার বেশী। তাদের তথ্য মতে স্থানীয় চিকিৎসকদের অবহেলায় অহনার বেঁচে থাকার ন্যূনতম সম্ভাবনাও নিঃশেষ হয়ে যায়। এজন্য অহনার বাবা মির্জা জলিল আল-হেলাল স্পেশালাইজড হসপিটালের সিইও ডা. আবু শামীম, ডা. নওশাদ-উন-নবীর, ল্যাব-এইড স্পেশালাইজড হসপিটাল এবং স্কয়ার হাসপাতালের বাণিজ্যিক মনোভাবকেই দায়ী করেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পৌনে দুই বছরেও শেষ হয়নি তদন্ত
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ