বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
দাড়ি বা চুলে খেযাব (কলপ) ব্যবহার করা সম্পর্কে ওলামায়ে কেরামের মধ্যে মতানৈক্য আছে। তবে অধিকাংশের মতে বিশেষ করে মুহাদ্দিসগণের মতে এটা মাকরুহ।
কেননা, হুযুর পাক (সা.) এত বার্ধক্যে উপনীত হননি, যাতে তাঁর খেযাব ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে। ইন্তেকালের সময় তাঁর কেশরাজি এবং দাড়ি মোবারকে সতেরো বা আঠারোটি চুল সাদা হয়েছিল। তাও আবার তিনি চুলে তেল ব্যবহার করে তা আঁচড়ালে সেগুলো ঢাকা পড়ে যেত। হযরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, মাথা ও দাড়ি মোবারকে মাত্র গুটিকতক চুল সাদা হয়েছিল; আমি ইচ্ছা করলে তা গণনা করতে পারতাম। তিনি আরো বলেন, হুযুর পাক (সা.) খেযাব ব্যবহার করেননি।
হুযুর পাক (সা.) এর ঝরেপড়া চুল মোবারক, যা হযরত আনাস (রা.)র নিকট রক্ষিত ছিল, তা খেযাবকৃত ছিল বলে যে বর্ণনা পাওয়া যায়, সে সম্পর্কে ওলামায়ে কেরাম বলেন, চুলগুলো আসলে খেযাবকৃত ছিল না; বরং কোনো প্রকারের খুশবু দিয়ে সেগুলোকে সুগন্ধিযুক্ত করা হয়েছিল। বাহ্যিকভাবে দেখা যেত, যেন খেযাব লাগানো হয়েছে; অথবা এও হতে পারে, পরবর্তীতে হযরত আনাস (রা.) সে কেশ মোবারকগুলো খেযাব করে রেখে দিয়েছিলেন।
হযরত উম্মু সালামা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসের বেলায়ও উক্ত সমাধানটি প্রযোজ্য। মাওয়াহেবে লাদুন্নিয়া কিতাবে বুখারী ও মুসলিম শরীফ থেকে হযরত ইবনে ওমর (রা.)র মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে, তিনি হুযুর পাক (সা.)কে জরদ রঙ ব্যবহার করা অবস্থায় দেখেছেন। এ সম্পর্কে ওলামায়ে কেরাম বলেন, জরদ রঙ বলতে এখানে জাফরানকে বোঝানো হয়েছে, যা সুগন্ধির জন্য ব্যবহার করতেন। শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ. বলেন, আমি হযরত শায়খ আবদুল ওয়াহাব মুত্তাকী রহ. থেকে এরূপ শুনেছি যে, উক্ত জরদ রঙটি খেযাব ছিল না।
কেননা, হুযুর পাক (সা.)-এর কেশরাজি তো কৃষ্ণবর্ণই ছিল। আর চুলের কৃষ্ণতা তো অন্য কোনো রঙকে ধারণ করে না। কাজেই তিনি জরদ বর্ণ ব্যবহার করেছেন তা ছিল জাফরান, যা দিয়ে চুল ধৌত করে পরিষ্কার করেছেন। তবে যে ক’টি দাড়ি সাদা ছিল, তা অবশ্যই কৃষ্ণবর্ণকে ধারণ করে নিয়েছে আর হুযুর পাক (সা.) বার্ধক্যে খেযাব ব্যবহার করেছেন। কাজেই এ ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনার অবকাশ রয়েছে।
আর তিনি (আবদুল ওয়াহাব মুত্তাকী) ইমাম নববী থেকে বর্ণনা করেছেন, হুযুর পাক (সা.) কখনো কখনো খেযাব ব্যবহার করতেন। তবে অধিকাংশ সময়ই চুল বা দাড়িকে স্বাভাবিক অবস্থায় ছেড়ে দিতেন। কাজেই বর্ণনাকারীগণ তাঁকে যখন যে অবস্থায় দেখেছেন, সেরূপই বর্ণনা করেছেন। এক্ষেত্রে প্রত্যেকের বর্ণনাই সঠিক।
হযরত শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ. বলেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, হুযুর আকরাম (সা.) শত্রুপক্ষের দৃষ্টিতে পুরোপুরি যৌবন, শক্তি, ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির অধিকারী ছিলেন। কেননা, দীনের দৃঢ়তা অর্জনের জন্য এবং ইসলামের শান-শওকত প্রকাশের ক্ষেত্রে উক্ত গুণাবলির যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে।
বিশেষ করে নবুওয়াতের যামানায় কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার জন্য আল্লাহ তাআলা হুযুর পাক (সা.)-কে বার্ধক্য থেকে সংরক্ষিত করেছেন। কেননা, বার্ধক্য হচ্ছে দুর্বলতা ও অক্ষমতার নিদর্শন। আর হুযুর পাক (সা.) যে সাহাবাগণকে খেযাব ব্যবহার করে নওজোয়ানদের সাথে সাদৃশ্য রাখার জন্য উৎসাহ দিয়েছেন, তার কারণও এটাই ছিল। নবী কারীম (সা.) এর জীবনে বার্ধক্যের আবির্ভাব ও বহিঃপ্রকাশ যা ঘটেছিল, তা মূলত কয়েকটি চুলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল; আর এও হয়েছিল আল্লাহ পাকের ভয়ে।
এ সম্পর্কে তিনি স্বয়ং এরশাদ করেছেন, হুদ, ওয়াকিআহ, আল-মুরসালাত, আম্মা ইয়াতাসাআলুন ও ইযাশ-শামসু সূরাসমূহ আমাকে বৃদ্ধ বানিয়ে দিয়েছে। আর তাঁর বার্ধক্য আবার এমনও ছিল না যে, যৌবনের আকৃতিতে ত্রুটির সৃষ্টি করে; বরং যৌবনের লাবণ্যের সাথে সাথে বার্ধক্যের মর্যাদা ও নূরও বিদ্যমান ছিল, যেমন হযরত ইবরাহিম খলীল আলাইহিস সালাম ও তদীয় পুত্র হযরত ইসহাক আলাইহিস সালামের মধ্যে বয়সের পার্থক্য বোঝানোর জন্য আল্লাহ তা‘আলা পিতার চুলে শুভ্রতা এনেছিলেন। এ দেখে তিনি আরজ করলেন, হে আমার প্রতিপালক, এটা কী? আল্লাহ তা‘আলা বললেন, এটা হচ্ছে, মর্যাদার প্রতীক। তখন তিনি বললেন, হে আমার প্রভু, আমার মর্যাদা আরো বৃদ্ধি করে দিন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।