বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
হযরত আবু হোরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : তোমরা নিজেকে মন্দ ধারণা হতে রক্ষা কর। কারণ মন্দ ধারণার বশবর্তী হয়ে যে কথা বলা হয়, তা সবচেয়ে বড় মিথ্যাচার এবং অপর সর্ম্পকে তথ্য (অন্যের দোষত্রুটি) সংগ্রহ করতে লেগে যেয়ো না এবং তোমরা পরস্পর ‘তানাজুশ’ করোনা এবং পরস্পর ঘৃণা-বিদ্বেষ পোষণ করোনা এবং পরস্পর শত্রুতা, সম্পর্কচ্ছেদ করোনা এবং তোমরা আল্লাহর বান্দা হয়ে থাকো এবং পরস্পর ভাই ভাই হিসেবে জীবনযাপন করো। (বোখারী-মুসলিম)।
এটি সমাজ চিত্রের একটি প্রকৃষ্ট রূপ যাতে কতক বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে। সবকটি মুসলমানদের মধ্যে বিদ্যমান, নৈতিকতার পরিপন্থী এবং সবটাই পাপাচারের অংশ। কোরআনে যেমন এগুলো থেকে বেঁচে থাকার জন্য বহু স্থানে বলা হয়েছে, তেমনি বহু হাদীসেও এসব আচরণের কঠোর নিন্দা ও সতর্ক বাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। বর্ণিত হাদীসে ব্যবহৃত কয়েকটি শব্দ বিশ্লেষণযোগ্য।
(১) ‘তাজাস্সুস’ কোরআনে সূরা তাহরীমের আয়াতে উল্লেখিত হাদীসে ব্যবহৃত হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, কোনো গোপন বিষয় অনুসন্ধান করা। কেউ কেউ বলেছেন, কারো কথা কান পেতে শ্রবণ করা এবং সেদিকে দৃষ্টিপাত করা। হুজুর (সা.) এর একথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে যে, কারো কথা শোনার জন্য চুপিসারে দাঁড়িয়ে যাওয়া এবং তার সে কথাকে তার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা ও লোকদের দৃষ্টিতে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করা। এটি ইসলামবিরোধী আচারণ।
‘তাহাস্সুস’ একই হাদীসে এ শব্দটিও ব্যবহৃত হয়েছে। এটি ও প্রথম শব্দটির অন্তর্ভুক্ত। কারো কারো মতে, এর অর্থ হচ্ছে কারো দোষের সন্ধানে থাকা কখন তার দ্বারা দোষ প্রকাশ পায় এবং কখন তার দুর্বলতা জানা যায়, সঙ্গে সঙ্গে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য যেখানে সেখানে তা প্রচারে লিপ্ত হয়ে যাওয়া। এ সর্ম্পকে আরো অনেক ব্যাখ্যা আছে।
(২) ‘তানাজুশ’-এ শব্দ বেচাকেনার সাথে সম্পৃক্ত। একে দালালিও বলা হয়। দালাল ও ব্যবসায়ীর মধ্যে কথা পাকাপাকি হয় যে, দালাল কোনো দ্রব্যের দাম বাড়িয়ে বলবে কিন্তু কেনা তার উদ্দেশ্য নয় বরং গ্রাহকদের ফাঁসানো তার লক্ষ্য।
(৩) ‘তাদাবুর’-এর অর্থ হচ্ছে পরস্পর শত্রুতা করা কিংবা সম্পর্কচ্ছেদ করা। কোরআন ও হাদীসে বর্ণিত কতিপয় নৈতিক ও সামাজিক অপরাধের কথা উপরে তুলে ধরা হয়েছে। এগুলোর বিচার-বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করলে সামাজিক যে অপরাধ চিত্র ফুটে উঠবে তা বলাই বাহুল্য। ঘরোয়া বৈঠক থেকে শুরু করে এমন কোন বৈঠক সমাবেশ নেই, যেখানে পরনিন্দা (গীবত) পরস্পর কানাঘুষা, অপবাদ, গুজব রটনা (মিথ্যাচার), হিংসা-বিদ্বেষ ছড়ানো প্রভৃতি ঘৃণিত ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপের চর্চা অনুশীলন হয় না।
অনেকে মনে করতে পারেন, এসব কার্যকলাপ বুদ্ধিমত্তা ও চালাকির। বেহুদা ও অর্থহীন, ক্ষতিকর এবং অকল্যাণকর তৎপরতার কল্যাণ-উপকারের কোনো দিক থেকে থাকলে ইসলাম তাও স্পষ্ট করে দিয়েছে, যাতে খোদা ভীতি ও মানব কল্যাণের বিষয়ও দৃশ্যমান। রাষ্ট্রীয়, জাতীয় ও ধর্মীয় স্বার্থে এবং মানবকল্যাণে কোনো বিষয় গোপন রাখা অপরিহার্য হয়ে পড়লে সে সম্পর্কে ইসলামের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে গোয়েন্দা বিভাগ রাখার ব্যবস্থার প্রয়োজন স্বীকৃত। রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা ফাঁস করে দেয়া অন্যায় এবং দেশদ্রোহীতার শামিল।
রসূলুল্লাহ (সা.) এর সীমিত প্রচার মাধ্যমের যুগে তিনি ওহীর মাধ্যমে কথা বলতেন, প্রচার চালাতেন। তাঁর এবং সাহাবায়ে কেরামের বিরুদ্ধে মোনাফেক- ইহুদী, খৃষ্ট্রান তথা বিধর্মীদের গোপন ষড়যন্ত্রের অন্ত ছিল না, কোরআন ও হাদীসে যার বিশদ বর্ণনা রয়েছে। রসুলুল্লাহ (সা.)-কে আল্লাহ তা’আলা সবকিছু অবহিত করতেন। আধুনিক অতি উন্নত প্রচার মাধ্যম যুগে কল্যাণকর ও ক্ষতিকর কোনো গোপন বিষয় গোপন থাকে না, প্রকাশ পায়, ফাঁস হয়ে যায়। আগেকার কানপাতা যুগের পরিবর্তন ঘটেছে।
টেলিফোন, মোবাইল, ফেইসবুক, ইউটিউব ইত্যাদি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ছড়াছড়ি গুপ্তকথা বা কানকথার স্থান দখল করে নিয়েছে। বর্তমানে আড়িপাতার প্রচলন সর্বত্র। এটির আর কোথাও সীমাবদ্ধ নেই, আন্তঃরাষ্ট্রীয়ভাবেও আড়িপাতার তেলেসমাতও চলছে, যাকে ক্ষতিকর ও নাশকতামূলক আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। সুতরাং কোরআন ও হাদীসে বর্ণিত গুপ্ত বা কানকথা বা আড়িপাতা-ষড়যন্ত্রেরই অর্ন্তভূক্ত। এ সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।