বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
চলমান দুনিয়ার মানুষ বাহির বা বহিরাবরণকে সুসজ্জিত ও মনোহর করে গড়ে তোলার জন্য যতখানি চেষ্টা-তদবির ও প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে, তার হাজার ভাগের এক ভাগ চেষ্টা ও সাধনা অন্তর বা ভেতরকে পরিচ্ছন্ন করার জন্য ব্যয় করছে না। অথচ আল্লাহপাক অন্তরের পরিচ্ছন্নতার প্রতিই গভীরভাগে দৃষ্টিপাত করে থাকেন। হাদিস শরীফে এর সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা পাওয়া যায়। হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন : ‘নিশ্চয়ই আল্লাহপাক তোমাদের বাহ্যিক আকার-আকৃতি ও ধন-সম্পদের দিকে দৃষ্টিপাত করেন না, বরং তিনি লক্ষ করে থাকেন তোমাদের অন্তরের দিকে এবং তিনি তাঁর আঙ্গুল দিয়ে বুকের (অন্তরের) দিকে ইশারা করলেন। (সহীহ মুসলিম : হাদিস নং-২৫৬৪)।
এতে বোঝা যায় যে, অন্তরে আল্লাহভীতি পয়দা হওয়া, অন্তর পরিচ্ছন্ন হওয়া একান্ত দরকার। দেহের বহিরাবরণকে সুসজ্জিত করার পূর্বে অন্তরকে নির্মল করাই অধিক শ্রেয়। এতদ প্রসঙ্গে হযরত আবু যর (রা.) হতে বর্ণিত, হাদিসে কুদসীতে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন : ‘হে আমার বান্দাহগণ! তোমাদের পূর্বাপর সকল মানুষ ও সকল জিন যদি তোমাদের মধ্যেÑ এমন এক শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির চেয়েও অধিক সংযমশীল বা পরহেজগার হৃদয়ের মতো হয়ে যায়, তবে তা আমার রাজত্বের কিছুই বাড়াতে পারবে না।
হে আমার বান্দাহগণ! তোমাদের পূর্বাপর সকল মানুষ ও জিন যদি তোমাদের মধ্যে এমন নিকৃষ্ট ব্যক্তিত্ব যে সর্বাধিক পাপী, তার মতো পাপাসক্ত হৃদয়ের অধিকারী হয়ে যায়, তবুও আমার রাজত্বের কিছুই কমাতে পারবে না।’ (সহীহ মুসলিম : হাদিস নং-২৫৭৭)।
এই হাদিস হতে জানা যায় যে, তাকওয়ার মূল হলো অন্তরের পরহেজগারী। একইভাবে অন্যায় ও ব্যভিচারের প্রতি প্রেরণাদানকারীও হলো এই অন্তর। এ জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকওয়া বা পরহেজগারীকে এবং অন্যায় ও ব্যভিচারকে একই উৎসের সাথে যুক্ত করেছেন। আর উক্ত উৎসটি হলো অন্তর।
রাসূলুল্লাহ (সা.) এ উভয়বিধ সম্পর্কের ব্যাখ্যা নিজেই প্রদান করেছেন। হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন : ‘তাকওয়া (পরহেজগারী) এখানে, তাকওয়া এখানে এবং (তৃতীয়বারে) তিনি তাঁর বক্ষের (অন্তরের) দিকে ইশারা করলেন।’ (সহীহ মুসলিম : হাদিস নং-২৫৬৪)।
রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর বুকের দিকে ইশারা করার কারণ হলো এই যে, অন্তরই হলো তাকওয়া বা পরহেজগারীর স্থান ও তার মূল। প্রকৃতপক্ষে অন্তরের তাকওয়া হলো মূল জিনিস। অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বা বহিরাবরণের পরহেজগারী নয়। মহান আল্লাহপাক কুরবানির পশু জবেহের বিষয়ে যা নির্দেশ করেছেন তা এ কথারই প্রমাণ বহন করে। আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে : ‘আল্লাহর কাছে এগুলোর গোশত ও রক্ত পৌঁছে না। বরং তাঁর কাছে তোমাদের (অন্তরের) তাকওয়াই পৌঁছে।’ (সূরা হজ্জ্ব : আয়াত ৩৭)।
এতে বোঝা যায় যে, আল্লাহপাকের কাছে অন্তরের তাকওয়াই শুধু পৌঁছে থাকে। এই আয়াতে কারীমার ব্যাখ্যা আল্লাহপাক নিজেই করেছেন। আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে : ‘তাঁরই (আল্লাহর) দিকে পবিত্র বাণীসমূহ আরোহণ করে এবং সৎকর্ম একে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে দেয়।’ (সূরা ফাতির : আয়াত-১০)।
এ জন্য মুমিন-মুসলমানদের সকল প্রকার আমলের মূল উদ্দেশ্য হতে হবে আল্লাহভীতি ও পরহেজগারী। আর তা সম্ভব হবে ভালোবাসা ও সম্মানের সাথে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য অন্তরের ইবাদতের মাধ্যমে। এ জন্য অন্তরকে সংশোধন করা, পবিত্র করা, সকল প্রকার আবিলতা থেকে মুক্ত করা এবং অন্তরকে মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের ভূষণে সুসজ্জিত করা ও অলঙ্কৃত করার প্রতি তাগিদ করা হয়েছে। কারণ আল্লাহপাক বান্দাহর অন্তরকে দেখা বা দর্শনের স্থান বানিয়েছেন।
বস্তুত অন্তরের বিষয়ে অধিক মনোযোগ দেয়ার প্রতি তাগিদ করার কারণ হলো এই যে, মানুষের অন্তরই হলো তার দেহের বাদশাহ এবং অনুকরণীয় রাষ্ট্রপ্রধান। কাজেই অন্তরের পরিচ্ছন্নতা, সুস্থতা ও সঠিকতাই হলো সকল কল্যাণের মূল উৎস এবং দুনিয়াতে কামিয়াবী ও আখেরাতে মুক্তির মাধ্যম।
হযরত নুমান ইবনে বশীর (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন : ‘সাবধান! দেহে বা শরীরে একটি মাংসখণ্ড আছে। মাংসখণ্ডটি যখন সুস্থ ও ভালো থাকে, তখন সমস্ত দেহ ও শরীর সুস্থ ও ভালো থাকে। আর যখন তা নষ্ট ও বিকৃত হয়ে যায়, তখন সমস্ত দেহ ও শরীর নষ্ট হয়ে যায়। জেনে রেখো! সেই মাংসখণ্ডটি হলো কালব বা অন্তর’। (সহীহ বুখারী : পৃ. ৫২; সহীহ মসলিম : পৃ. ১৫৯৯)।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।