বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
পরম কৌশুলী, সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী ও সর্ব শক্তিমান আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত মানুষের মধ্যে দু’টি বিষয়ের সমন্বয় সাধন করেছেন। একটি হলো দেহের বাহ্যিক অবয়ব এবং অপরটি হলো এর আভ্যন্তরীণ চালিকা শক্তি অন্তর।
বাইরের আকার প্রকার, রং-রূপ দৈর্ঘ-প্রস্থ দেখা যায়, অনুধাবন করা যায়। কিন্তু অন্তর দেখা যায় না, ধরা যায় না। অথচ তার শাসন মেনে চলতে হয়। তাই, অন্তরের বিষয়টি হলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং তার প্রভাব ও প্রতিপত্তি ও বিরাট গৌরবময়। কারণ আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত অন্তরের এসলাহ বা সংশোধনের জন্য সর্বশেষ আসমানী কিতাব আল কোরআন নাজিল করেছেন এবং অন্তরের সংশোধন, পরিচ্ছন্ন করণ, সুসজ্জিত করণ ও অন্তরকে সুবাসিত ও সুগন্ধযুক্ত করার জন্য যুগে যুগে, কালে কালে নবী, রাসূল, ওলী-আওলিয়া, এবং মোজাদ্দেদগণকে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন।
এতদ প্রসঙ্গে আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে : ‘হে মানব জাতি! তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে এমন এক বস্তু সমাগত হয়েছে যা পরিপূর্ণ নসীহত এবং অন্তরসমূহের সকল রোগের আরোগ্যকারী, আর ঈমানদারদের জন্য তা পথ প্রদর্শক ও রহমত স্বরূপ’। (সূরা ইউনুস : আয়াত-৫৭)।
আল্লাহ জাল্লা শানুহু আরও ইরশাদ করেছেন : নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা বিশ্বাসীগণের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, যখন তিনি তাদের নিজেদের মধ্য হতে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের নিকট তাঁর নিদর্শনাবলী পাঠ করেন ও তাদেরকে পবিত্র করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত (কুরআন ও বিজ্ঞান) শিক্ষাদান করেন’। (সূরা আলে ইমরান : আয়াত-১৬৪)।
বস্তুত : পিয়ারা নবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) বৃহত্তর ও মহত্তর যা নিয়ে এসেছেন তাহল অন্তরের সংশোধন ও পরিশুদ্ধতার ব্যবস্থা মাত্র। এ কারণেই একমাত্র রাসূলুল্লাহ (সা.) এর পথ ও পদ্ধতির অনুসরণ ও অনুকরণ ছাড়া অন্তর পরিশুদ্ধ করার কোনো উপায় নেই। অন্তরের বিষয়ে মনোযোগ দেয়া এবং তা পরিচ্ছন্ন করার আবশ্যকতার কারণ হলো এই যে, অন্তর এমন একটি সুক্ষ্ম অথবা কমনীয় মাংসখণ্ড যাকে আল্লাহর রাব্বুল ইজ্জত স্বীয় জ্ঞান ও বিচক্ষণতার দ্বারা চয়ন ও মনোনীত করেছেন এবং তাকে স্বীয় নূরের স্থান এবং হেদায়েতের জন্য মূল কেন্দ্র বানিয়েছেন।
আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত স্বীয় কিতাব আল কোরআনে অন্তরের উদাহরণ উল্লেখ করে ইরশাদ করেছেন : ‘আল্লাহ তায়ালা আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর নূর বা জ্যোতি তাঁর জ্যোতির উপমা হলো যেন একটি দীপাধার, যার মধ্যে আছে এক প্রদীপ, প্রদীপটি একটি কাঁচের আবরণের মধ্যে স্থাপিত, কাঁচের আবরণটি উজ্জ্বল নক্ষত্র সাদৃশ্য, এটা প্রজ্জ্বলিত করা হয় পুতঃপবিত্র যয়তুন বৃক্ষের তৈল দ্বারা, যা প্রাচ্যের নয়, প্রতিচ্যেরও নয়, অগ্নি একে স্পর্শ না করলেও যেন এর তৈল উজ্জ্বল আলো দিচ্ছে, জ্যোতির উপরে জ্যোতি! আল্লাহ জাল্লা শানুহু যাকে ইচ্ছা তাঁর জ্যোতির দিকে পথ নির্দেশ করেন, আল্লাহ তায়ালা মানুষের জন্য উপমা দিয়ে থাকেন এবং আল্লাহ সব বিষয়ে সর্বজ্ঞ’। (সূরা নূর : আয়াত-৩৫)।
মোদ্দা কথা হচ্ছে এই যে, অন্তর হলো পরিচয়ের স্থান। তাই এই অন্তর দিয়েই বান্দাহ তার প্রতিপালক ও মনিব আল্লাহ তায়ালার পরিচয় লাভ করে থাকে। এর মাধ্যমেই মহান আল্লাহপাকের যাত অর্থাৎ সত্তা এবং তাঁর গুণাবলী সম্পর্কে পরিচয় লাভের সেতু বন্ধন রচিত হয়। আর এরই মাধ্যমে বান্দাহ আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের শরঈ, আয়াত অর্থাৎ তিনি তাঁর বান্দাহর প্রতি ওহী আকারে যা নাযিল করেছেন তা’ গভীর মনোযোগের সাথে চিন্তা ভাবনা করে থাকে।
এ বিষয়ে আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তায়ালা আল কোরআনে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন: ‘তবে কি তারা কোরআন সম্বন্ধে অভিনিবেশ সহকারে চিন্তা-ভাবনা করে না? নাকি তাদের অন্তর তালা বদ্ধ? (সূরা মোহাম্মাদ : আয়াত-২৪)।
আসলে তাদের অন্তরে এমন তালা লাগানো আছে, যা মুক্তভাবে চিন্তা ভাবনা করতে বাঁধার সৃষ্টি করে। পক্ষান্তরে এই অন্তর দিয়েই বান্দাহ আল্লাহ তায়ালার মাখলুকাত (যেমন, দিন ও রাত, এবং চন্দ্র, সূর্য ইত্যাদি) এবং নভোমণ্ডল ও সুদুর প্রান্তের নির্দশনাবলী নিয়ে চিন্তা ও গবেষণা করে থাকে। আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তায়ালা আরও ইরশাদ করেছেন : ‘তারা কি পৃথিবী ভ্রমণ করেনি? তাহলে তারা জ্ঞানবুদ্ধি সম্পন্ন অন্তর ও শ্রুতিশক্তি সম্পন্ন কর্ণের অধিকারী হতে পারত। বস্তুত : চক্ষু তো অন্ধ নয় বরং অন্ধ হচ্ছে তাদের বক্ষ স্থিত অন্তর সমূহ’। (সূরা হজ্জ : আয়াত-৪৬)।
এই আয়াতে কারীমায় আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে, মানুষ নিজের মধ্যে এবং আল্লাহর মাখলুকাত, দিগন্ত ও সুদুর প্রান্তের নিদর্শন নিয়ে অন্তর ও বোধশক্তি দ্বারাই চিন্তা ও গবেষণা করে থাকে। আর অন্তরের বিষয়ে গুরুত্ব দেয়ার আবশ্যকতার তাকিদের কারণ হলো এই যে, অন্তর এমন এক বাহন বা ঊর্ধ্বারোহনের যন্ত্র যার মাধ্যমে বান্দাহ তার আখেরাতের পথকে অতিক্রম করতে পারে।
কেননা আল্লাহর দিকে ভ্রমণ বা গমন করার অর্থ হলো অন্তরের ভ্রমণ, শরীর ও কায়ার ভ্রমণ নয়। কবি কত সুন্দরইনা বলেছেন : ‘আল্লাহর সন্নিধানে পৌঁছতে পথের দূরত্ব ও ব্যবধান অন্তর দ্বারা অতিক্রম করা সম্ভব। সওয়ারীর গদিতে বসে নয়’।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।