বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
জনৈক ফার্সী কবি কত সুন্দরই না বলেছেন : ‘দুচিজ আদমীরা কাশাদ জোরে জোর, একে আবেদানা দিগার খাকে গোর’ অর্থাৎ দুটি বস্তু মানুষকে জোরে জোরে টানছে, এর একটি হলো খাদ্য ও পানীয় এবং দ্বিতীয়টি হলো কবরের মাটি। এই দুটি বস্তুর টান হতে কোনো মানুষই রেহাই পায় না। জীবন ধারণের জন্য দানা-পানির যেমন প্রয়োজন আছে, তেমনি মৃত্যুর পর কবর দেশে গমন করাও অবধারিত। তাই, প্রথমেই জানা দরকার কবর কী? কবর কাকে বলে? আসুন, এবার সে দিকে লক্ষ্য করা যাক।
বস্তুত : কবরের মূল ও প্রকৃত অর্থ মাটির ওই গর্ত সেখানে সব দেহকে প্রেথিত করা হয়। তবে, কবর শুধু মাটির গর্তের অর্থেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং যেখানেই মানুষের মরদেহ থাকবে বা তার অংশসমূহ থাকবে, তা-ই তার কবর। চাই তা মাটির গর্ত হোক অথবা সমুদ্রের জলাধার হোক, কিংবা হিংস্র প্রাণীর উদর হোক। সর্বাবস্থায় ঐ জায়গাকে রূপক অর্থে কবর বলে নাম করণ করা হবে। এতদপ্রসঙ্গে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের অন্তর্ভুক্ত মাশায়েখে কেরাম যা বলেন, তা’ খুবই প্রণিধান যোগ্য।
যেমন (ক) প্রত্যেক মৃত ব্যক্তিরই মুনকার-নাকীরের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। চাই সে কবরে থাকুক অথবা বন্য প্রাণীর পেটে থাকুক, অথবা পাখীর উদরে থাকুক অথবা আগুনে পুড়িয়ে ভস্ম করার পর বাতাসে উড়িয়ে দেয়া হোক। (আল ইয়া ওয়াকিতু ওয়াল জাওয়াহিরু : খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ১৩৮)।
(খ) সমুদ্রে জলমগ্ন, বন্য প্রাণীর উদরস্থ, বায়ূ প্রবাহে উড়ন্ত মৃত ব্যক্তিকে ও আযাব দেয়া হবে। যদিও আযাবের স্বরূপ সম্পর্কে আমরা অবগত নই। (নিবরাস : পৃষ্ঠা ২১০)। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য নিম্নোক্ত কিতাব সমূহ পাঠ করা যেতে পারে। (১) মিরকাত : খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ২০৩) (২) শারহুল মাকাসিদ : খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ৩৬৫-৩৮৬। (৩) শারহুস সুদুর : পৃষ্ঠা ১৪৬-১৬০)।
বারযাখের জগতে শান্তি ও শাস্তির ধারাবাহিকতা চালু থাকবে। সৎ লোকের জন্য আরাম ও আনন্দের ব্যবস্থা থাকবে। তাদেরকে বিভিন্ন পুরস্কারে পুরস্কৃত করা হবে। আর অসৎ লোকেরা থাকবে আযাব ও শাস্তিতে। এর প্রমাণ হচ্ছে এই :
(ক) আল কোরআনে ইরশাদ হয়েছে : তাদের গোনাহের কারণেই তাদেরকে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে, তারপর অগ্নিতে প্রবেশ করিয়ে দেয়া হয়েছে। তারা আল্লাহ ছাড়া কাউকে সাহায্যকারীরূপে পাবে না। (সূরা নূহ : আয়াত-২৫)। (খ) হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন : কবর বেহেস্তের উদ্যান সমূহের একটি উদ্যান অথবা জাহান্নামের গর্ত সমূহ হতে একটি গর্ত। (জামেয়ে তিরমিযী : খণ্ড ২, পৃষ্ঠা : ৫২৪)।
এ পর্যায়ে আমরা আম্বিয়ায়ে কেরাম মৃত্যু বরণ করার পর কবর দেশে জীবিত আছেন কি-না, এ বিষয়ের ওপর আলোকপাত করতে প্রয়াস পাব। আসুন, অগ্রসর হওয়া যাক।
বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মাদ মোস্তফা আহমাদ মুজতাবা (সা.) এবং অন্যান্য নবী রাসূলগণ (আ.) পার্থিব জীবনের পরিসমাপ্তিতে কবর দেশে জীবিত আছেন। তাঁদের এ জীবন বারযাখী, হিস্সী বা অনুভূতি পূর্ণ, এবং দৈহিক জীবন ও বটে। এর প্রমাণ নিম্নে পেশ করা হলো০।
যথা : (১) আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন : যারা আল্লাহর পথে মত্যুবরণ করেন তাদেরকে সাধারণত মৃত বল না, বরং তারা জীবিত; কিন্তু তোমরা তা’ পুরাপুরী অনুধাবন করতে পার না। (সূরা বাকারাহ : আয়াত ১৪৫)। (২) আল্লাহপাক আরও ইরশাদ ফরমায়েছেন : আল্লাহর পথে শাহাদত বরণকারীদেরকে তোমরা মৃত ভেব না, বরং তারা আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের সান্নিধ্যে জীবিত, রিযিক প্রাপ্ত। (সূরা আলে ইমরান : আয়াত ১৬৯)।
(৩) আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তায়ালা আরও ইরশাদ করেছেন : যখন তারা নিজেদের ওপর জুলুম করে আপনার নিকট আগমন করে, অনন্তর আল্লাহর দরবারে ইস্তিগফার করে এবং রাসূল (সা.) ও তাদের জন্য আল্লাহর সমীপে ক্ষমা প্রার্থনা করেন, তবে তারা অবশ্যই আল্লাহ পাককে তাওবাহ কবুলকারী ও অতীব দয়ালু পাবে। (সূরা নিসা : আয়াত ৬৪)। (৪) হযরত আনাস বিন মালিক (রা.) হতে বর্ণিত আছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : নবীগণ তাঁদের কবরে জীবিত, নামাজ আদায় করেন। (মুসনাদে আবু ইয়ালা : খণ্ড ৩ পৃষ্ঠা ২১৬)।
(৫) প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী (রহ:) বলেন : আমি বলব, নবীদের হায়াতের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন নেই। কেননা, নবীগণ শহীদগণ হতে শ্রেষ্ঠ। আর শহীদগণ তো তাদের রবের নিকট যিন্দা আছেন। সুতরাং নবীগণ তো প্রশ্নাতীতভাবেই যিন্দা থাকবেন। (উমদাতুলক্বারী : ১১ খণ্ড, ৪০২ পৃষ্ঠা।
(৬) শহীদগণ যেহেতু আল কোরআনের ও হাদীসের দলীলের ভিত্তিতে জীবিত প্রমাণিত, আল কোরআনে তার সুস্পষ্ট ঘোষণা আছে, সুতরাং নবীগণ ও জীবিতই থাকবেন। কারণ তারা শহীদগণ হতে উত্তম। (ফাতহুল বারী : খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ২৮৮)। (৭) নবীগণ কবরে জীবিত ও নামাজেরত এ হাদীসটি সম্পূর্ণ সহীহ। (মিরকাত : খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ২৬১)।
(৮) হাদীসে প্রমাণিত যে, নবীগণ কবরে জীবিত আছেন। ইমাম বায়হাকী ও ইমাম মুনযেরী (রহ:) হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। (নায়লুল আওতার : খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ২৬১)। (৯) নি:সন্দেহে নবী করীম (সা.) ওফাতের পর কবরে জীবিত আছেন। অনুরূপভাবে অন্যান্য নবী ও রাসূলগণ শহীদদের চেয়েও পূর্ণ হায়াতে জীবিত। যাঁদের সম্পর্কে আল্লাহ তাবারাকা ওয়া তায়ালা তাঁর পবিত্র কিতাবে সংবাদ দিয়েছেন। (আল্ ওয়াফাউল ওয়াফা : খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৪০৫)। (১০) নবীদের কবর দেশে জীবিত থাকার প্রমাণাদি দাবি করে যে, তারা দুনিয়ার পার্থিব জীবনের মতই দৈহিকভাবেই জীবিত। তবে তারা পানাহারের মুখাপেক্ষী নন। (আল ওয়াফাউল ওয়াফা : খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৪০৮)।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।