Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পায়রা সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দক্ষিনাঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলো

আজ পায়রা সেতুর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে পটুয়াখালী জেলা নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগের আওতায়

পটুয়াখালী থেকে মো. জাকির হোসেন | প্রকাশের সময় : ২৪ অক্টোবর, ২০২১, ১১:১৫ এএম

আজ ২৪ অক্টোবর সকাল ১১ .৪ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পটুয়াখালীর লেবুখালী নদীতে নির্মীত পায়রা সেতু ভার্চুয়াল মাধ্যমে গনভবন থেকে উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে দক্ষিনাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবায়ীত হলো।গত ১৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব ইসমাত মাহমুদ স্বাক্ষরিত চিঠির সূত্রে এ উদ্বোধনের তারিখ ঘোষনার পরই এ অঞ্চলের মানুষের মধ্যে এক নতুন আনন্দের অনুভূতি বইতে শুরু করে। সেতুর এ উদ্বোধন উপলক্ষে সেতুর দক্ষিনপ্রান্ত পটুয়াখালীতে প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে স্থানীয়দের সাথে মতবিনিময় সভায় মিলিত হন। পটুয়াখালী প্রান্তে উপস্থিত ছিলেন পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব): জাহিদ ফারুক এমপি, পটুয়াখালী ১ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মোঃ শাহজাহান মিয়া এমপি, পটুয়াখালী ২আসনের সংসদ সদস্য আসম ফিরোজ এমপি, পটুয়াখালী ৩ আসনের সংসদ সদস্য এসএম শাহজাদা এমপি, পটুয়াখালী ৪ আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ মুহিব্বুর রহমান মুহিব এমপি, সংরক্ষিত আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য কাজী কানিজ সুলতানা , বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার মোঃ: সাইফুল হাসান বাদল, বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি এস এম আক্তারুজ্জামান,সড়ক ও জনপথ বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ, পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী আলমগীর, সাধারণ সম্পাদক ভিপি আ: মান্নান প্রমুখ।

অনুষ্ঠানের শুরুতে প্রধান মন্ত্রীর মূখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস এর উপস্থাপনায় প্রকল্পের বিষয়ে উপস্থাপন করেন সচিব সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক মোঃ নজরুল ইসলাম, স্বাগত বক্তব্য রাখেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এমপি।
বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহনের পরে অবহেলিত দক্ষিনাঞ্চলকে সারা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সমানতালে এগিয়ে নিতে বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের কাজ শুরু করে। এ প্রকল্পগুলির চুড়ান্ত বাস্তবায়নের পথে বড় ধরনের বাধা হয়ে দাড়ায় কুয়াকাটা-ঢাকা মহাসড়কের পটুয়াখালীর লেবুখালীতে পায়রা নদী।খরস্্েরাতা এ নদীর উপর একটি সেতু নির্মান বড় ধরনের একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়ায়। ২০১২ সালে ৮ মে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের পায়রা সেতুর জন্য একটি উন্নয়ন প্রকল্প একনেকের সভায় অনুমোদন পায়।৪১৩ কোটি ২৯ লাখ টাকার প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল ধরা হয় ডিসেম্বর ২০১৬ পর্যন্ত,এর মধ্যে বৈদেশিক সহায়তা কুয়েত ফান্ড থেকে ৩৩৬ কোটি২৬ লাখ এবং সরকারের নিজস্ব ৭৭ কোটি ৩ লাখ। ২০১৩ সালের ১৯ মার্চ প্রতিশ্রæত প্রকল্প হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পটুয়াখালী সফরকালে লেবুখালী নদীর পাড়ে পায়রা সেতুর ভিক্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরবর্তিতে বিভিন্ন জটিলতার কারনে প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হওয়ায় ২০১৫ সালে প্রাক্কলন বাড়িয়ে ৪১৮ কোটি ৫৭ লাখ টাকায় উন্নীত করা হয়।সর্বশেষ ২০১৬ সালের ১২ এপ্রিল কুয়েত ফান্ড ফর ইকোনমিক ডেভোলপমেন্ট কেএফএইডি ও ওপেক ফান্ড ফর ইন্টার ন্যাশনাল ডেভোলপমেন্ট (ওএফআইডি) এর যৌথ অর্থায়নে ১১৭০.০৭ কোটি টাকা ব্যায়ে পায়রা নদীর উপর সেতু নির্মানের জন্য চীনা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান লংজিন রোড এন্ড ব্রীজ কোম্পানী সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের সাথে চুক্তি সাক্ষর করেন।
২০১৬ সালের জুলাই মাসে পূর্তকাজ শুরুর মাধ্যমে বাংলাদেশের দ্বিতীয় এক্সট্রা ডোজড ক্যাবল স্টেইড ১৪৭০ মিটার দীর্ঘ ,চারলেন বিশিষ্ট ফুটপাথ সহ ১৯.৭৬ মিটার প্রশস্থতা সম্পন্ন ব্রীজটির মূল সেতুর ৪টি স্প্যান সহ মোট ৩২টি স্প্যান রয়েছে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর ওপর শাহ আমানত সেতুও এই প্রযুক্তিতে নির্মিত। ১ হাজার ৪৭০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১৯ দশমিক ৭৬ মিটার প্রস্থের সেতুটি ক্যাবল দিয়ে ২ পাশে সংযুক্ত থাকবে। নদীর জলতল থেকে সেতুটি ১৮ দশমিক ৩০ মিটার উঁচু হবে। উভয় পাড়ে ৭ কিলোমিটার জুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে সংযোগ সড়ক। এই সেতুতে ১৩০ মিটার গভীর পাইল বসানো হয়েছে। নদীর মাঝখানে মাত্র একটি পিলার ব্যবহার করা হয়েছে। এতে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ঠিক থাকবে বলে প্রকল্প পরিচালক আব্দুল হালিম জানান ।

দেশে প্রথমবারের মতো এই সেতুতে 'ব্রিজ হেলথ মনিটর' (সেতুর স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণ) স্থাপিত হচ্ছে। যার ফলে বজ্রপাত ও ভূমিকম্পসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা অতিরিক্ত মালামাল বোঝাই যানবাহন চলাচলে সেতুর ভাইব্রেশন সিস্টেমে কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা থাকলে সেই বিষয়ে সংকেত দেবে। সেতুর পরিবেশগত ক্ষতি এড়াতেই এই প্রযুক্তি থাকছে।

এ ছাড়াও, সেতুর পিলারের পাশে নিরাপত্তা পিলার স্থাপন করা হয়েছে। এতে কোনো কিছুর ধাক্কায় সেতুর ক্ষতি ঠেকানো সম্ভব হবে, বাড়বে সেতুর স্থায়িত্ব। আলাদা সাবস্টেশনের মাধ্যমে সেতুতে বিদ্যুৎ সরবরাহের মাধ্যমে বাতি জ্বলবে। থাকছে সৌর বিদ্যুতের ব্যবস্থাও।

প্রকল্প কর্মকর্তারা জানান, সরকার ২০১২ সালের মে মাসে সেতু নির্মাণ প্রকল্পের অনুমোদন দেয়। বিদেশি অর্থায়নে নির্মিত এই সেতু ২০১৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল এবং সেসময় ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪১৩ দশমিক ২৮ কোটি টাকা।

কিন্তু সেতুর প্রাথমিক নকশায় অনেক পরিবর্তনে এনে পরামর্শদাতারা টেন্ডারের নথি প্রস্তুত করেন এবং দরপত্র প্রক্রিয়ার প্রতিটি পর্যায়ে দাতা সংস্থার সম্মতি নিতে হয়েছে। ফলে নির্মাণ কাজ শুরু করতে কিছুটা বিলম্ব হয়।


আলাদা সাবস্টেশনের মাধ্যমে সেতুতে বিদ্যুৎ সরবরাহের মাধ্যমে বাতি জ্বলবে। থাকছে সৌর বিদ্যুতের ব্যবস্থাও।
এ ছাড়াও, প্রাথমিক পর্যায়ে প্রকল্প ব্যয় একটি ধারণাগত নকশার ভিত্তিতে অনুমান করা হয়েছিল। কিন্তু পরে বিস্তারিত নকশা অনুসারে প্রকৃত নির্মাণ ব্যয় চূড়ান্ত করা হয়। ফলে সেতুর নির্মাণ ব্যয় বেড়ে যায়। সর্বশেষ এই সেতু নির্মাণে চুক্তি-মূল্য ছিল এক হাজার ১৭০ কোটি টাকা। তবে সেতুটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে এক হাজার ১১৮ কোটি টাকা, সাশ্রয় হচ্ছে ৫২ কোটি টাকা।
খরস্্েরাতা পায়রা নদীর ভাঙ্গন থেকে নদীতীর রক্ষাপ্রদ কাজও সম্পনের পথে। এ সেতুর মূল প্রাক্কলিত ব্যায় ১৪৪৭ কোটি টাকা এর মধ্যে ৩৬৮ কোটি ২৯ লাখ টাকা সরকারের এ ছাড়াও কুয়েতের ১০৭৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। অনুমোদিত ডিপিপি অনুযায়ী প্রকল্পের মেয়াদ জুন ২০২২ থাকলেও তার পূর্বেই সেতুর কাজ সম্পন্ন হওয়ায় আজ থেকে প্রধানমন্ত্রীর ভিডিও কনফারেন্সের উদ্বোধনের মধ্য দিয়েই যানচলাচলের জন্য খুলে দেয়া হবে।
পায়রা সেতুর নির্মান সমাপ্তির মধ্য দিয়ে পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটার সাথে সারা দেশের নিরবিচ্ছিন্ন সড়ক যোগাযোগের একধাপ এগিয়ে যাবে। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের সমাগম একদিকে যেমন বাড়বে,তেমনি পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটাকে ঘিরে দেশ বিদেশী বিনোয়গকারীদের সংখ্যায় তেমনি বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া শস্য ও মৎস সম্পদ ক্ষেত এ অঞ্চলের উৎপাদিত দ্রব্যাদি রাজধানী সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চরে পরিবহন ও বাজারজাতকরনে সহজতর হবে।যা এ অঞ্চলের জনসাধারনের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে।
এদিকে বর্তমান সরকারের দক্ষিনাঞ্চলকে ঘিরে পটুয়াখালীতে পায়রা সমুদ্রবন্দর সহ একাধিক মেগা প্রকল্পের কাজ শেষের পথে রয়েছে,পায়রা সেতু চালুর মাধ্যমে বন্দর থেকে খালাসকৃত যে কোন পন্য খুবই কম সময়ের মধ্যে সড়ক পথে সারাদেশে পরিবহনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের বাঁধা ছিল লেবুখালী নদীর ফেরী।লেবুখালীর পায়রা সেতুর সমাপ্তি ,পাশাপাশি মাওয়া সেতুর কাজ যতদ্রæত শেষ হবে ততই সম্ভাবনাময় দক্ষিনাঞ্চল সহ সাগড়পাড়ের পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার জনসাধারনের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে বলে পটুয়াখালী পৌর মেয়র মহিউদ্দিন আহম্মেদ জানান।
লেবুখালীর পায়রা সেতুর সমাপ্তির মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন দীর্ঘ্যদিনের ভোগান্তী দূর হবে পাশাপশি এ অঞ্চলে নতুন নতুন বড় ধরনের বিনোয়গের মাধ্যমে একদিকে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে যেমন এখানকার মানুষের জীবন যাত্রার পরিবর্তন হবে পাশাপশি জাতীয় অর্থনীতিতে সাফল্যজনক ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্লেষকগন মনে করেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: যোগাযোগ


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ