Inqilab Logo

শুক্রবার ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১, ২৮ রবিউস সানী ১৪৪৬ হিজরি

একশ’ বিঘা জমির মালিকও পেয়েছেন দশ টাকা কেজির চাল

প্রকৃত গরিব, অসহায় দুস্থরা হচ্ছেন বঞ্চিত

প্রকাশের সময় : ১৫ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আবদুল ওয়াজেদ কচি, সাতক্ষীরা থেকে

সাতক্ষীরায় চাল নিয়ে চালবাজি শুরু করেছেন কতিপয় জনপ্রতিনিধিরা। প্রকৃত গরিব, অসহায়, দুস্থরা চাল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রেই দশ টাকার চাল যাচ্ছে ধনীদের বাড়িতে। বাদ যাননি জনপ্রতিনিধির সম্পন্ন স্বজনরাও। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাতক্ষীরা সদর উপজেলার শিবপুর ইউনিয়নের সাত নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বর ও প্যানেল চেয়ারম্যান মজনু গাজীর স্ত্রী মানছুরা খাতুন পেয়েছেন দশ টাকা দরের চালের কার্ড। তার কার্ড নম্বর ৮৪২। একই ইউনিয়নে গদাঘাটা গ্রামের তমিজ উদ্দীনের ছেলে আজিজ ১০০ বিঘা জমির মালিক। তিনিও পেয়েছেন কার্ড। তার কার্ড নম্বর ৭২১। একই গ্রামের ইছহাক আলীর ছেলে আব্দুস সালামও শতাধিক বিঘা জমির মালিক। তিনিও পেয়েছেন দশ টাকা দরের চালের কার্ড। তার কার্ড নম্বর ৭৪০। একই গ্রামের সুলতান সরদারের ছেলে আবুল খায়ের পেয়েছেন কার্ড, একজন চাল ব্যবসায়ী। বাজারে তার ধান চালের আড়ত আছে। তিনিও পেয়েছেন দশ টাকা দরের চালের কার্ড নম্বর ৭৭৩। এমনইভাবে একই গ্রামের আকছেদ আলীর স্ত্রী নাছিমা (কার্ড নম্বর ৭৩২), আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে ইমান আলী (নম্বর ৭৪১), রফিক উদ্দীনের ছেলে মোমিনুরসহ (৭৬৮) অর্ধশতাধিক ব্যক্তি পেয়েছেন দশ টাকা দরের চালের কার্ড; যাদের প্রত্যেকের ২৫ থেকে ৫০ বিঘা জমি রয়েছে। আছে ব্যবসা-বাণিজ্যও। বিপরীতে শিবপুর ইউনিয়নের একই গ্রামের বাসিন্দা ভ্যানচালক আব্দুস সবুর, আলাউদ্দীন, আব্দুস সালাম, বিকাশ ম-ল, আব্দুল আলীম, মনিরুল ইসলামসহ শতাধিক হতদরিদ্র মানুষ দশ টাকা দরের চালের কার্ড থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এলাকাবাসী বলছেন, স্থানীয় মেম্বর মজনু গাজী বেছে বেছে তার আত্মীয়স্বজন ও পছন্দের লোকদের কার্ড দিয়েছেন। এমনকী তার স্ত্রী মানসুরা খাতুনের নামেও কার্ড করেছে। চাল নিয়ে চালবাজি করেছেন মেম্বর মজনু গাজী। শিবপুর ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মুজিদ অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করেননি। তবে এই ভয়াবহ অনিয়মকে ‘খুব বড় সমস্যা’ নয় বলে দাবি করছেন তিনি। এ অবস্থা শুধু শিবপুর ইউনিয়নেই নয়, জেলার ৭৮টি ইউনিয়নের অধিকাংশ ইউনিয়নের কোনো না কোনো ওয়ার্ডে এভাবে চলছে দশ টাকা দরের চাল নিয়ে চালবাজি। সম্প্রতি সদর উপজেলার আলিপুর ইউনিয়নের চার নম্বর ওয়ার্ডে সরকারের দেওয়া ভালো চাল কালোবাজারে বিক্রি করে খারাপ চাল গরিবদের মধ্যে বিক্রির সময় জনতার হাতে ধোলাই খান ডিলার মোহর আলী। এছাড়া দেবহাটায় ৫৫ বস্তা চাল কালোবাজারে বিক্রির ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। সদর উপজেলার লাবসা ইউনিয়নের তিন নম্বর ওয়ার্ডেও চাল নিয়ে চালবাজি হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সদর উপজেলার শিবপুর ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মুজিদ বলেন, ‘প্রথম বার কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে। পরে যখন সংশোধিত তালিকা হবে তখন যারা বাদ পড়েছে, তাদের নাম আসবে।’ অভিযোগ প্রসঙ্গে লাবসা ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল আলিম বলেন, ‘বিষয়টি আমি জানি না। ইউপি মেম্বরদের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী কার্ড বিতরণ করা হয়েছে।’ এদিকে সদর উপজেলার ঝাউডাঙ্গা এলাকার মনিরুল ইসলাম মনি জানান, এই ইউনিয়নে সরকারের দেওয়া হতদরিদ্রের জন্য দশ টাকা কেজির চালের কার্ড বিতরণে গুরুতর অনিয়ম হয়েছে। কার্ডপ্রাপ্তদের অনেকে গাড়ি-বাড়ির মালিক। প্রকৃত হতদরিদ্ররা কার্ড পাননি বলে অভিযোগ করেন তিনি। ২০১৩ সালে জামায়াত-শিবিরের হামলায় আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করেছেন বলাডাঙ্গা গ্রামের মফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘অনেকবার ওই এলাকার ইউপি সদস্য সুমনের কাছে ধর্ণা দিয়েও কার্ড পাইনি। অথচ হতদরিদ্রের কার্ড পেয়েছে একই এলাকার চারটি ট্রাকের মালিক আরিফ, ১২ বিঘা জমির মালিক আব্দুর রহিম, মোকারমসহ অনেকে।’ হাজিপুর গ্রামের নিত্যানন্দ ঘোষ জানান, তাদের চাল দেওয়া হচ্ছে মাধবকাটি ও আখড়াখোলা বাজারে। ৩০০ টাকার চাল আনতে ২০০ টাকা পরিবহন খরচ হচ্ছে। পাথরঘাটা গ্রামের রশিদা জানান, তাদের চাল দেওয়া হচ্ছে ঝাউডাঙ্গা বাজারের দক্ষিণ মাথায় একটি পরিত্যক্ত ঘর থেকে। সেখানে কোনো সাইনবোর্ড নেই। ওই ডিলারের বিরুদ্ধে নিম্নমানের চাল, ওজনে কম দেওয়া ও চাল অন্য জায়গায় ২৫ টাকা দরে বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। অনেকে ওই ঘর খুঁজে না পেয়ে চাল না নিয়ে ফিরে যাচ্ছে।’ তবে ডিলাররা চাল কম দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করছেন। তাদের ভাষ্য, ‘খাদ্য গুদামে টাকা না দিলে আমাদের চাল ওজনে কম দেওয়া হয়।’ ইউনিয়ন পরিষদের সচিব আব্দুল হাকিম দাবি করেন, ইউনিয়নের এক হাজার ৯৫১টি হতদরিদ্র পরিবার দশ টাকা কেজি দরে চাল পাচ্ছে। এই ইউনিয়নের তিনজন ডিলার। এরা হলেন মাধবকাটির মশিউর, আখড়াখোলার গোবিন্দ ও ঝাউডাঙ্গার নিরঞ্জন। ডিলাররা ভাগাভাগি করে চাল বিতরণ করছেন। যার কারণে একটু সমস্যা হচ্ছে। কার্ড বিতরণে অনিয়মের ব্যাপারে সাত নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য সুমন বলেন, ‘শেষ দিনে সচিব একটা নাম পেয়েছিল সেটি আমার এক শুভাকাক্সক্ষী আরিফের নামে দিয়েছি। যা তড়িঘড়ির জন্য এই সামান্য অনিয়ম হয়েছে।’ এছাড়া বাকি কোনো বিষয়ে অনিয়ম হয়নি বলে তিনি দাবি করেন। হয়রানি ও অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে সদর খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আরশাফুজ্জামান বলেন, ‘এসব ব্যাপারে আমাদের কোনো হাত নেই। আমরা শুধু চাহিদা মাফিক চাল সরবরাহ করে থাকি।’ এ ব্যাপারে সদর উপজেলার ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী অফিসার মনিরা পারভিন জানান, কার্ড বিতরণে যদি অনিয়ম হয়ে থাকে, তাহলে তা বাতিল করা হবে। আর হয়রানির বিষয়ে স্থানীয় চেয়ারম্যান ও মেম্বরদের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: একশ’ বিঘা জমির মালিকও পেয়েছেন দশ টাকা কেজির চাল
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ