Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

৬৪ বছর, ৪০০ টেস্ট, কিছু মাইলফলক...

প্রকাশের সময় : ১৫ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে নিজেদের ইতিহাসের প্রথম দিবা-রাত্রির টেস্ট খেলছে পাকিস্তান। গত বৃহস্পতিবার শুরু হওয়া ম্যাচে তাদের প্রতিপক্ষ ক্যারিবিয় দল ওয়স্টইন্ডিজ। ক্রিকেটের দীর্ঘতম পরিসরে এটি পাকিস্তানের ৪০০তম ম্যাচও। ৬৮ বছরের এই ছোট্ট ইতিহাসে আছে কত ঘটনা। রেকর্ড ভেঙে হয়েছে নতুন সব রেকর্ড। কিন্তু যা কিছু প্রথম তা চিরদিনই প্রথম। তেমনি কিছু টুকরো স্মৃতি নিয়ে ইএসপিএনক্রিকইনফো অবলম্বনে আমাদের আজকের আয়োজন সাজিয়েছেন ইমামুল হাবীব বাপ্পি

প্রথম ম্যাচ
সকালের আকাশ যদি দিনের বার্তা দিয়ে থাকে তাহলে এই ব্যাপারটাও তেমনি। ৬৮ বছর আগে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের বিপক্ষে তাদেরই মাটিতে দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলায় ক্রিকেটের দীর্ঘতম পরিসরে যাত্রা শুরু করে পাকিস্তান। সেই পাক দলেরই সদস্য ছিলেন পরবর্তিতে কিংবদন্তির খাতায় নাম লেখানো সদ্য প্রায়াত হানিফ মোহাম্মদ। সেই দলের অধিনায়ক ছিলেন ফজল মাহমুদ। দু’জনই ইতিহাসের প্রথম ম্যাচে খুব বেশি আলো ছড়াতে না পালেও নিজেদের জানান ঠিকই দিয়েছিলেন তারা। হানিফ দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যর্থ হলেও প্রথম ইনিংসে করেছিলেন অর্ধশতক। ফজলের পারফর্ম ছিল ঠিক এর উল্টো, প্রথম ইনিংসে ব্যর্থতার পর দ্বিতীয় ইনিংসে শেষ পর্যন্ত অপরাজিত ছিলেনন ৪১ রানে। ম্যাচটা অবশ্য জয় দিয়ে স্বরনীয় করে রাখতে পারেনি তারা। প্রথম ইনিংসে ভারতের ৩৭২ রানের জবাবে ফলোঅনে পড়া পাকিস্তান দুই ইনিংস মিলে করে ৩০২। ইনিংস ও ৭০ রানের হার দিয়ে টেস্ট ক্রিকেটে যাত্রা শুরু হয় পাকিস্তানের।


প্রথম জয়
ঘুরে দাঁড়াতে অবশ্য একদম সময় নেয়নি ফজল মাহমুদের দল। দলপতি নেতৃত্ব দিলেন সামনে থেকে। লক্ষ্মৌতে লালা অমরনাথের দলকে ইনিংস ও ৪৩ রানে হারিয়ে সিরিজে ঘুরে দাঁড়ায় পাকিস্তান। অর্থাৎ নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচেই জয়ের দেখা পায় পাকিস্তানের টেস্ট ক্রিকেট। ফজল একাই সে ম্যাচে নেন ১২ উইকেট। এই ম্যাচে অবশ্য ভারত প্রথম ম্যাচের নায়ক বিনোদ মানকাদকে দলে পাননি। প্রথম ম্যাচে একাই ১৩ উইকেট নিয়েছিলেন বিনোদ।

প্রথম সেঞ্চুরিয়ান
পাকিস্তানের টেস্ট ইতিহাসে প্রথম বলটি মোকাবেলা করেছিলেন নজর মোহাম্মাদ। এই ঘটনার আট দিন পর লক্ষৌতে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচে তিন অঙ্কের ম্যাজিক ফিগার স্পর্শ করেছিলেন নজর, নিজেদের ইতিহাসে যা প্রথম সেঞ্চুরির রেকর্ড। ওপেনিং হিসেবে ব্যাটে নেমে ৮ ঘন্টা ৩৫ মিনিট ক্রিজে থেকে শেষ পর্যন্ত অপরাজিত ছিলেন ১২৪ রানে। এই রানের ওপর দাঁড়িয়েই ইনিংস ব্যাবধানে জয় পায় পাকিস্তান। উইজডেন ক্রিকেট আলমানাক-এর মতে, ‘ইতিহাসের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে তিনি পুরোটা ইনিংস ক্রিজে থাকার গৌরব অর্জন করেন। এক দুর্ঘটনায় হাত ভেঙে যাওয়ায় সেখানেই ক্যারিয়ারের যবনিকা টানতে হয় নজরকে । পরবর্তিতে তিনি হয়েছিলেন দলের কোচ, নির্বাচক। এছাড়া তিনি ক্রিকেটের একজন অন্যতম গল্পকারও।


প্রথম দশ উইকেট
শতক ও টেস্টে দশ উইকেটÑ দুই প্রথমেরই জন্ম হয়েছিল নিজেদের ইতিহাসের দ্বিতীয় টেস্টে। ব্যাট হাতে সেদিন ঝলক দেখিয়েছিলেন নজর, আর বল হাতে দলপতি ফজল মাহমুদ। প্রথম পাকিস্তানি বোলার হিসেবে এক ম্যাচে তুলে নেন ১০ উইকেট। প্রথম ইনিংসে ৫ উইকেটের পর দ্বিতীয় ইনিংসে নেন ৭টি। তাতেই ভারত ছারখার হয়ে ইনিংস ব্যবধানে হেরে বসে। প্রথম পাক ক্রিকেটার হিসেবে ১০০ উইকেটের মাইলফলও স্পর্শ করেন ফজল এবং সবকিছুই তিনি করেন অধিনায়ক হিসেবে। লম্বা সুদর্শন এই যুবক ছিলেন পাকিস্তানের প্রথম পোষ্টার বয়।

প্রথম সিরিজ জয়
খুব বেশিদিন নয়, ১৯৫২ সালে টেস্ট অভিষেকের তিন বছর পরই সিরিজ জয়ের স্বাদ পায় পাকিস্তান। নিউ জিল্যান্ডকে করাচি ও লাহোরে হারিয়ে তিন ম্যাচ সিরিজের ট্রফি দখলে নেয় তারা। করাচিতে ৮৩ ওভার বল করে ৭৯ রানে ১১ উইকেট নিয়েছিলেন অফস্পিনার জুলফিকার আহমেদ। ওভারপ্রতি রান খরচ ছিল একের কম! পরের ম্যাচে লাহোরে প্রথম উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান হিসেবে ডাবল সেঞ্চুরি করেন ইমতিয়াজ আহমেদ। সাত নম্বরে ব্যাটে নেমে দ্বিশতক করেছিলেন ইমতিয়াজ। শেষ ৪ উইকেটে পাকিস্তান যোগ করে ৪৫০ রান।

প্রথম বিদেশে সিরিজ জয়
এজন্য ২০ বছর অপেক্ষা করেতে হয়েছে পাকিস্তানকে। তখন তাদের প্রধান প্রতিপক্ষই ছিল কন্ডিশন। ওয়েলিংটন হয়ে ডানেডিন, এরপর অকল্যান্ড। তিন ম্যাচেই ব্যাট হাতে সাদিক ও মুস্তাক মোহাম্মাদ রাখেন পারিবারিক পরিচয়। দুজন হলেন হানিফ মোহাম্মাদের ভাই। পাকিস্তান ক্রিকেট দলের বর্তমান টিম ম্যানেজার ইনতিখাব আলম উইকেট ছাড়া সেই সিরিজে ২০ রানের বেশি অতিক্রম করেননি একবারো। সিরিজে বোলিং তালিকার শীর্ষেই ছলেন তিনি। সিরিজের শীর্ষ ৫ ব্যাটসম্যানের তালিকাতেও ৪ জনই ছিলেন পাকিস্তানি।


প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরি
ক্রিকেট ইতিহাসের বিরলতম কিছু পুরোনো রেকর্ডের মত এই রেকর্ডটিও এখনো অমলিন। ৫৮ বছর আগে ৯৭০ মিনিট ক্রিজে থেকে ৩৩৭ রান করেছিলেন হানিফ মোহাম্মাদ। আজও যা সময়ের বিবেচনায় ব্যাক্তিগত দীর্ঘতম ইনিংসের রেকর্ড। অন্যতম সাহসী ইনিংসও এটি। বারবোডোসে সেদিন পাকিস্তানকে ফলোঅনে ফেলে ব্যাটে পাঠায় ওয়েস্ট ইন্ডজ। এটি ছিল সবে ম্যাচের দ্বিতীয় দিন, আরো একটি বিষয় জানান দেওয়া দরকার তা হল, তখন টেস্ট ম্যাচ ছিল ৬ দিনের। ম্যাচ বাঁচাতে রানের চেয়ে উইকেটে টিকে থাকাই ছিল তখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। হানিফের ব্যাটে সেই চ্যালেঞ্জে জিতেছিল পাকিস্তান। প্রথম ইনিংসে ৪৭৩ রানের লিড নেওয়া ক্যারিবিওদের দ্বিতীয় ইনিংসে ১৮৫ রানের লক্ষ্যও দেয় পাকরা। হানিফ আউট হন ষষ্ঠ দিনেরও শেষ সময়ে। ক্যারিবিওরা ব্যাট করার সুযোগ পায় মাত্র ১১ ওভার। ম্যাচটি ড্র হয়েছিল বটে, কিন্তু যে ড্র ছিল পাকদের কাছে জয়ের সমান। জ্যামাইকান পত্রিকা দ্য গ্লেনার সেদিন শিরোনাম করেছিলÑ ‘অ্যান আনফরগটঅ্যাবল টেস্ট’। এজন্যই হানিফকে বলা হয় ক্রিকেটের ‘আসল লিটল মাস্টার’। ডেইলি টেলিগ্রাফের ক্রিড়া বিশেষজ্ঞ সিল্ড বেরির মতে, ‘তিনিই (হানিফ মোহাম্মাদ) লাহোরের শিক্ষিত এলিট শ্রেণীর মানুষ থেকে শুরু করে সবার মাঝে আজকের ক্রিকেটকে পৌঁছে দিয়েছিলেন।’

 

প্রথম টেস্টের ১ নং দল
রাজত্বটা অবশ্য বেশিদিন থাকেনি, মাত্র দুই মাসÑ আগস্ট এবং সেপ্টেম্বর ১৯৮৮। তবে এটাও বিশাল এক প্রাপ্তি। টানা তিন বছর কোন সিরিজ না জিতে ভারত সফরে যায় ইমরান খানের দল। ভারতকে সেবার হারিয়ে প্রথমবারের মত বিজয়ীর বেশে দেশে ফেরে পাকিস্তানের ক্রিকেটাররা। এরপরেই যান ইংল্যান্ড সফরে। সেখান থেকেও সিরিজ জয়ের ট্রফি সাথে দেশে ফেরে ইমরান খানরা। ওটাই ছিল ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তাদের প্রথম সিরিজ জয়। এরপরেই আসে সেই স্বীকৃতি। তবে আইসিসি টেস্ট র‌্যাংকিং চালু হয় ২০০৩ সালে। এরপর চলতি বছরই ইংল্যান্ডের মাটিতে ২-২ ব্যবধানে সিরিজ ড্র করার পর প্রথম বারের মত র‌্যাংকিংয়ের শীর্ষে ওঠে মিজবাহ-উল-হকের দল। তবে এবারো বেশিদিন স্থায়ী হয়নি রাজত্বটা। সদ্য নিউ জিল্যান্ডকে নিজেদের মাটিতে হোয়াইটওয়াশ করে পাকদের কাছে থেকে টেস্টের রাজদন্ট দখলে নেন ভারত অধিনায়ক বিরাট কোহলি। বেশিদিন অবশ্য রাজত্বটা ধরে রাখতে না পরলেও স্বল্প সময়ের এই অর্জনের মহত্বটাও কম নয়। ঘরের মাঠই যখন টেস্টে যে কোন দলের শক্তির প্রধান যায়গা, সেখানে পাকিস্তান আইসিসি টেস্ট র‌্যাংকিংয়ের শীর্ষস্থান দখল করেছিল বিদেশের মাটিতে খেলেই। ২০০৯ সালে গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে যাওয়ার পথে শ্রীলঙ্কা জাতীয় ক্রিকেট দলের উপর বন্দুকধারীদের হামলা হয়। এরপর থেকে পাকিস্তানে বন্ধ হয়ে আছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট। তখন থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতকে ঘরের মাঠ বানিয়ে নিয়েছে দলটি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ৬৪ বছর
আরও পড়ুন