Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চাল নিয়ে চালবাজি

প্রকাশের সময় : ১৫ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুনশী আবদুল মাননান
চাল নিয়ে চলছে চালবাজি। রাজধানীসহ সারাদেশে চালের দাম হু-হু করে বাড়ছে। নিয়ন্ত্রণ করার কেউ নেই। সরকার বলছে মিলার ও ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে চালের দাম বাড়ছে। তারা ধান-চাল কিনে মজুদ করছে। ফলে দাম বাড়ছে। মিলার-ব্যবসায়ীরা বলছে, সরকারের নীতির কারণে চালের দাম বাড়ছে। সরকার ধান ও চাল কিনছে যথাক্রমে ২৩ টাকা ও ৩২ টাকা কেজি দরে। তাদের ভাষায়, এই দাম তুলনামূলকভাবে বেশি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই চালের দাম বেড়েছে ও বাড়ছে। আর একটি কারণের কথাও তারা বলছে। বলছে, চাল আমদানীর ওপর শুল্ক বাড়ানোর ফলে ভারত থেকে চাল আমদানি কমে গেছে। আমদানি না কমলে চালের দামে এতটা উল্লম্ফন ঘটতো না। সরকার ও মিলার-ব্যবসায়ীরা যার যার কথা বলেই খালাস। মাঝখান থেকে ক্রেতাভোক্তাদের যায়যায় অবস্থা।
চালের দাম বাড়ার ফলে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে হতদরিদ্র, দরিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারী, স্বল্প আয়ের মানুষ, নি¤œবিত্ত এমনকি মধ্যবিত্তরাও। এদের বেশিরভাগ মোটা চালের ক্রেতা। অথচ এই মোটা চালের দামই বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। ঈদের আগে রাজধানীর বাজারে গুটি ও স্বর্ণা জাতের মোটা চালের দাম ছিল প্রতি কেজি ২৮ টাকা থেকে ৩০ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ৩৮ টাকা থেকে ৪০ টাকা। মাঝারি মানের বিআর ২৮ জাতের চালের দাম ছিল প্রতি কেজি ৩৫-৩৬ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা। সরু মিনিকেট চালের প্রতি কেজির দাম ছিল ৩৮ থেকে ৪০ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫০ টাকা। উন্নতমানের চালের দাম কেজিতে ৪/৫ টাকা করে বেড়েছে। সাম্প্রতিক কয়েক বছরে চালের দাম অনেকটা স্থিতিশীলই ছিল। মাঝে মধ্যে কখনো কখনো কেজিপ্রতি দুয়েক টাকা বাড়লেও পরে কমে গেছে। এবারই ব্যতিক্রম। সব ধরনের চালের দামই এবার বেড়েছে। মোটা দাগে বেড়েছে। কৃষি বিপণন অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে প্রতি কেজি মোটা চালের গড় মূল্য ছিল প্রায় ২৬ টাকা। পরের দু’বছরে তা ছিল যথাক্রমে ৩০ ও ৩৩ টাকা। ২০১৫ সালে দাম না বেড়ে বরং কমে যায়। এই তথ্য মোতাবেক, এবারই মোটা চালের দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। অন্যান্য চালের ক্ষেত্রেও এ কথা সমানভাবে প্রযোজ্য।
মাস খানেকের ব্যবধানে চালের দামে এই ব্যাপক বৃদ্ধির কারণ এই নয় যে, চালের উৎপাদন কমে গেছে কিংবা চালের মজুদে টান পড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩ কোটি ৪৯ লাখ ৬৮ হাজার টন চাল উৎপাদিত হয়েছে যা আগের বছরের তুলনায় ২ লাখ ৫৮ হাজার টন বেশি। এছাড়া এমন কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটেনি যাতে ধান থেকে চাল বানানোর ক্ষেত্রে বা সরবরাহের ক্ষেত্রে কোনো ব্যাঘাত ঘটেছে বা মজুদ হ্রাস পেয়েছে। সরকারি-বেসরকারী উভয় পর্যায়ে ধান-চালের যথেষ্ট মজুদ রয়েছে। খাদ্যমন্ত্রী কদিন আগে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, সরকারের কাছে ২৪ লাখ টন চাল উদ্ধৃত রয়েছে। খাদ্য ভা-ারে স্টক আছে ৭ লাখ টনেরও বেশি। মিল মালিকদের কাছ থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার টন চাল সংগ্রহ হলে এ মাস শেষে খাদ্য ভা-ারে জমা থাকবে ৯ লাখ টন। অনেক সময় ধানের কোনো আবাদ মার খেলে কিংবা মার খাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে ব্যবসায়ীদের মধ্যে মজুদ বৃদ্ধি ও দাম বাড়ানোর প্রবণতা দেখা দেয়। আমনের আবাদ এবার অন্যান্যবারের তুলনায় ভালো হয়েছে। বাম্পার ফলনের আশা করছে সবাই। মাসখানেকের মধ্যে নতুন ধান বাজারে আসবে। এমতাবস্থায় দাম বরং কমে যাওয়ার বা স্থিতিশীল থাকার কথা, বাড়ার কথা নয়।
এক সময় দেশের মানুষ বছরে দুবার আকালের মুখে পড়ত। একবার আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে; আরেকবার কার্তিক মাসে। তখন ধানের মৌসুম ছিল দুটিÑ আউশ ধানের মৌসুম ও আমন ধানের মৌসুম। আউশ ধান উঠত ভাদ্র মাসে এবং আমন ধান উঠতে অগ্রহায়ণ মাস। আউশ ধান ওঠার দুই মাস আগে আর আমন ধান ওঠার এক মাস আগে ধান-চালে টান পড়ত। এই সময় গ্রামে কাজকর্মও তেমন থাকত না। ফলে অতি দরিদ্র ও দিনমজুর শ্রেণির মানুষ প্রচ- অভাবের সম্মুখীন হতো। অনেক বছর হয়ে গেল এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। এখন প্রায় সারা বছরই ধান হয়। বিশেষ করে ইরি-বোরো আবাদ বাড়ার কারণে আউশ-আমনের জমি কমে গেছে। আগে অধিকাংশ জমি ছিল এক ফসলি। এখন অধিকাংশ জমিই দু-তিন ফসলি। এর মধ্যে অন্তত ধান হয় দুবার। ইরি-বোরোর আবাদ যেমন বেড়েছে তেমনি আউশ-আমনের চেয়ে এর উৎপাদনও অনেক বেশি। বস্তুত এ কারণেই দেশ খাদ্যে স্বয়ংম্ভরতার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। সরকার অবশ্য দাবি করে, দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। তথ্য-পরিসংখ্যান ও বাস্তবতা এ দাবি সমর্থন করে না। যদি দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতাই অর্জন করে থাকে তাহলে প্রতি বছর ভারত থেকে চাল আমদানি করতে হয় কেন? সরকারের দাবির মধ্যে অতিরঞ্জন থাকলেও এ কথা ঠিক যে, খাদ্যশস্য আবাদে বড় কোনো বিপর্যয় না ঘটলে প্রচ- খাদ্যাভাব কিংবা দুর্ভিক্ষাবস্থা সৃষ্টির কোনো কারণ আপাতত নেই। দেশের মানুষের দুই বেলা দু’মুঠো খাওয়ার জোগান দেয়ার মতো খাদ্য দেশে হচ্ছে এবং আগামীতে খাদ্য উৎপাদন বাড়ার সম্ভাবনাও নিঃশেষিত নয়।
প্রশ্ন হলো, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে যখন ধান-চালের মজুদ পর্যাপ্ত এবং কিছু দিনের মধ্যেই আমন ধান উঠবে, তখন চালের দাম এভাবে বাড়ল কেন, বাড়ছে কেন? স্বাভাবিকভাবেই মনে হয়, এর পেছনে মিলার-ব্যবসায়ীদের হাত রয়েছে। সরকার ধান-চালের যে সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করেছে সেটা কৃষকদের জন্য উৎসাহজনক। স্বাভাবিক কারণেই মিলার-ব্যবসায়ীদের আগের চেয়ে বেশি দামেই ধান কেনার কথা। তাতেও মোটা চালের প্রতি কেজির দাম ৩২ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। এখানে এ কথা বলে রাখা বিশেষভাবে আবশ্যক যে, কৃষকরা কখনই সরকার নির্ধারিত মূল্যে সরাসরি ধান-চাল বিক্রি করতে পারে না। মাঝখানে বাগড়া হয়ে আছে ফড়িয়া, দালাল ও মধ্যস্বত্বভোগীরা; যাদের মধ্যে এই মিলার ব্যবসায়ীরাও আছে। আছে ক্ষমতাসীন দলের মৌসুমি ব্যবসায়ীরাও। তাদের দাপটে কৃষকরা কখনই সরকার নির্ধারিত দাম পায় না। বলা যায়, সরকার নির্ধারিত দামের অজুহাত খাড়া করে মিলারব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত মুনাফা শিকারের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে। সরকার তাদের কাছে অনেকটাই আটকা পড়ে আছে। কারণ ধান-চালের বাজার তারাই মূলত নিয়ন্ত্রণ করে। এখানে যদি সরকারের আংশিক নিয়ন্ত্রণও থাকত কিংবা থাকত সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা তাহলে মিলার-ব্যবসায়ীরা এরকম যথেচ্ছাচার করতে পারত না। অতীতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা গেছে, সরকার শেষ পর্যন্ত ব্যবসায়ীদের সাথেই হাত মেলায়। যখনই কোনো পণ্যের দাম বাড়ে তখনই ব্যবসায়ীদের ডাক পড়ে। সরকারি প্রতিনিধিদের সঙ্গে তাদের বৈঠক হয়। এরপর ব্যবসায়ীরা তাদের নানা কথার পাশাপাশি আশ্বাসও দেয়। কিন্তু বাস্তবে সে আশ্বাস তারা কার্যকর করে না। সরকারও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়ার আগ্রহ দেখায় না। এভাবেই চলছে। চালের দাম বাড়া নিয়েও সরকারের লোকদের সঙ্গে মিলার-ব্যবসায়ীদের কথাবার্তা হয়েছে। যথারীতি আশ্বাসও মিলেছে। তবে বাজারে তার কোনো প্রতিফলন নেই। মিলার-ব্যবসায়ীরা স্বল্প শুল্কে বা আগের শুল্কে ভারত থেকে নি¤œমানের চাল আমদানি করার জন্য চালের দাম হঠাৎ করে বাড়িয়ে দিয়েছে কিনা, সে প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। মাত্র ১০ শতাংশ শুল্কে ভারত থেকে চাল আমদানির সুযোগে মিলার-ব্যবসায়ীরা বিপুল পরিমাণ চাল আমদানি করে বাজার সয়লাব করে একদিকে মোটা অংকে লাভবান হতো, অন্যদিকে এ কারণে কৃষকরা ধান-চালের ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত মূল্য থেকে বঞ্চিত হতো। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় পত্রপত্রিকায় বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। বিভিন্ন সংগঠন-সমিতি লাগামহীন চাল আমদানি বন্ধের দাবি জানিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটেই সরকার চাল আমদানির ওপর ১০ শতাংশের জায়গায় ১৫ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করে। মিলার-ব্যসায়ীরা চালের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে চালের আমদানি শুল্ক বাড়ানোর কথা উল্লেখ করাতে এটা ধরে নেয়াই যায়, তারা চাইছে চালের আমদানি শুল্ক কমিয়ে দেয়া হোক। সরকার তাদের ইচ্ছা বা কৌশলের কাছে হার মানবে কিনা, সেটা সরকারই বলতে পারে।
সরকার মিলার-ব্যবসায়ীদের কারসাজি রুখতে অনেক কিছুই করতে পারে। চালের দাম নির্ধারণ করে দিতে পারে। সরকারের স্টক থেকে খোলাবাজারে কম দামে চাল বিক্রির ব্যবস্থা করতে পারে। শেষোক্ত ব্যবস্থাটি দ্রুত ও অধিক কার্যকর ফল দিতে পারে। অতীতেও আমরা দেখেছি, চালের দাম বাড়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেলেই সরকার কম দামে খোলাবাজারে চাল বিক্রির পদক্ষেপ নিয়েছে, যাতে হতদরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষ থেকে শুরু করে অনেকেই লাভবান হয়েছে। ক’দিন আগে খাদ্য মন্ত্রণালয় খোলাবাজারে চাল বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আরো আগেই এটা নেয়া যেত বলে অনেকে মনে করে। এই সময়টাতে গ্রামাঞ্চলে কাজ কমে যায়। দরিদ্র ও দিনমজুর শ্রেণির মানুষ কষ্টে পড়ে। এ সময় টিআর-কাবিখা কর্মসূচি বাড়িয়ে দেয়া গেলে প্রথমত, তারা কাজ পায় এবং দ্বিতীয়ত তার বিনিময়ে তাদের খাদ্যের সংস্থানও হয়। সেই সঙ্গে বান-বন্যায় রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন অবকাঠামোর যে ক্ষতি হয়েছে তা দ্রুত সংস্কার করা সম্ভব হয়। অবশ্য আমরা এসব কর্মসূচিতে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির কথাও জানি। সংশ্লিষ্টরা চাল, গম বা টাকা নির্বিবাদে লুটেপুটে খায়।
চালের দাম বাড়লে প্রায় সবাইকেই তা স্পর্শ করে। উচ্চবিত্তের মানুষেরা এটা পরোয়া না করলেও পারে এবং সাধারণত করে না। উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষও তেমন সমস্যা বোধ করে না। নি¤œমধ্যবিত্ত থেকে পরবর্তী বিত্ত-শ্রেণির মানুষ, যাদের সংখ্যা ১৫ কোটির বেশি ছাড়া কম নয়, তারাই বড় রকমের সংকটে পতিত হয়। তাদের আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ব্যবধান বেড়ে যায়, সংসারে টানাটানিটা দুঃসহ হয়ে যায়। সরকারের তরফে অর্থনীতির হালসাকিন নিয়ে যত চমৎকার-চিত্তাকর্ষক কথাই বলা হোক না কেন, আসলে অর্থনীতির অবস্থা ততটা চাকচিক্যময় নয়। সাধারণ মানুষের অবস্থা থেকেই পরিমাপ করা যায়, অর্থনীতি কতটা ভালো বা মন্দ। পরিসংখ্যান বলছে, দেশে এখন হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা পৌনে দুই কোটি। এ ছাড়া দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে আরো চার কোটি মানুষ। এদের সঙ্গে দরিদ্র, নি¤œবিত্ত ও নি¤œ মধ্যবিত্তের সংখ্যা যোগ করলে সংখ্যাটি কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা দ্বিতীয়বার উল্লেখের প্রয়োজন পড়ে না। এক তথ্যে দেখা যায়, চলতি মূল্যে জিডিপির আকার এখন ১৭ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এই মোট সম্পদের ৯০ শতাংশ অর্থাৎ ২৫ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকা রয়েছে দেশের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর হাতে যাদের সংখ্যা সাকুল্যে ৫৫ লাখ। আর অবশিষ্ট ১ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা রয়েছে ১৫ কোটি ৪৫ লাখ লোকের আওতায়।
সবচেয়ে বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে হতদরিদ্র পৌনে দুই কোটি মানুষ। তাদের প্রায় কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করা চার কোটি মানুষ। উল্লেখ করা দরকার, দারিদ্র্যসীমার নিচে ও উপরে বসবাসকারীদের মধ্যে পার্থক্য অতি সামান্য। এ থেকে এই সিদ্ধান্তে সহজেই আসা যায় যে, দেশের বেশিরভাগ মানুষ দারিদ্র্যের বৃত্তের মধ্যেই বসবাস করছে। তাদের অভাব-বঞ্চনার কোনো শেষ নেই। প্রশ্ন ওঠে, তাহলে জন-উন্নয়ন ও দারিদ্র্য-বিমোচন কোথায় হচ্ছে?
সরকারের এটা ভালোভাবেই জানা আছে, সাধারণ মানুষ বলতে আমরা যাদের বুঝি তারা কি অবস্থায় আছে। এ জন্য সরকারের কিছু কর্মসূচি আছে যাতে এই সাধারণ মানুষ উপকারভোগী হতে পারে। দেখা গেছে, এসব কর্মসূচিতে অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণে ‘টার্গেট গ্রুপের’ মানুষেরা খুব কমই উপকার লাভ করতে পারে। সরকার এবার প্রথমবারের মতো হতদরিদ্রের জন্য ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির কর্মসূচি নিয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্র মতে, দেশের ৫০ লাখ পরিবারের মাঝে প্রতি মাসে ৩০ কেজি করে চাল দেয়া হবে। সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর এবং মার্চ ও এপ্রিলÑ এই পাঁচ মাস এ চাল বিক্রি করা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৭ সেপ্টেম্বর কুড়িগ্রামের চিলমারী থেকে এ কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। যে কোনো বিচারে এটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও প্রশংসাযোগ্য একটি কর্মসূচি। এ কর্মসূচি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে ৫০ লাখ হতদরিদ্র পরিবার যে যারপরনাই উপকৃত হবে তাতে সন্দেহ নেই। দেশের বিভিন্ন মহল এই আশাবাদ ব্যক্ত করে কর্মসূচিটির সাফল্য কামনা করেছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বিগত দিনগুলোতে এই কর্মসূচির যে চিত্র-চরিত্র বেরিয়ে এসেছে এবং এখনো বেরোচ্ছে তা দুঃখজনকই নয়, চরম হতাশাজনকও। সর্বত্র শুরু থেকেই এ কর্মসূচি অনিয়ম-দুর্নীতির কবলে পড়েছে। শাসক দলের এক শ্রেণীর লোকজন এবং স্থানীয় প্রভাবশালীরা ‘গরীবের চাল’ লুটপাটের মহোৎসবে মেতে উঠেছে। যাদের এ চাল পাওয়ার কথা তাদের অতি স্বল্পসংখ্যকই তা পাচ্ছে। শাসক দলের নেতা-কর্মী-সমর্থক, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, তাদের আত্মীয়স্বজন, সরকারী কর্মচারী, স্কুল-কলেজের শিক্ষকসহ স্থানীয় প্রভাবশালীদের অনেকেই এই চাল ভাগবাটোয়ারা করে খাচ্ছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রায় প্রতিদিনই গরীবের চাল নিয়ে নির্লজ্জ চালবাজির খবর প্রকাশিত হচ্ছে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখের প্রয়োজন নেই। এই চাল নিয়ে যেসব অভিযোগ মোটা দাগে উঠে এসেছে তার মধ্যে রয়েছে : চাল গরীবদের স্থলে ধনীরা পাচ্ছে। কোথাও কোথাও চাল কম দেয়া হচ্ছে; ৩০ কেজি চাল দেয়ার টিপসই নিয়ে দেয়া হচ্ছে ১০-২০ কেজি। কোথাও কোথাও তালিকা অনুমোদনের আগেই চাল বিক্রি করা হচ্ছে। অনেক এলাকায় হতদরিদ্রের নাম তালিকায় আসেনি। খাদ্য বিভাগ থেকে কোথাও কোথাও যে চাল দেয়া হয়েছে, অভিযোগ আছে, তা নি¤œমানের। চাল বিক্রি হচ্ছে অনেক এলাকায় খোলাবাজারে।
অভিযোগ রয়েছে, তালিকা তৈরি ও ডিলার নিয়োগে প্রায় সর্বত্র গুরুতর অনিয়ম হয়েছে। কোনো ক্ষেত্রেই ঘোষিত নিয়ম-নীতি মানা হয়নি। তালিকা তৈরি করেছে স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত কমিটি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের, যাদের প্রায় সবই শাসক দলের, কথাই শিরোধার্য করা হয়েছে। তারা যে তালিকা করেছে তাই গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে তালিকায় প্রাধান্য পেয়েছে দলীয় নেতা-কর্মী-সমর্থক, তাদের আত্মীয়স্বজন ও প্রভাবশালীরা। ডিলার নির্বাচনের ক্ষেত্রেও একই রকম ঘটনা ঘটেছে। যারা প্রকৃত ডিলার বা ডিলার হওয়ার উপযুক্ত তাদের এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। ডিলার করা হয়েছে অনভিজ্ঞ, অব্যবসায়ী শাসক দল ও তার অঙ্গ সংগঠনসমূহের নেতা-কর্মীদের। এতে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। চালের যারা প্রকৃত প্রাপক তারা পাচ্ছে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারাই পাচ্ছে যাদের পাওয়ার কথা নয়। আর এই ব্যবস্থাপনায় চাল লুটপাটও হয়ে যাচ্ছে।
হতদরিদ্রের চাল নিয়ে চারদিক থেকে নানা অভিযোগ ওঠার প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীকে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে হুশিয়ারি উচ্চারণ করতে হয়েছে। বলতে হয়েছে, ১০ টাকার চাল বিতরণে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকেও চাল বিক্রিতে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় একই ধরনের সতর্কবার্তা দিয়েছে । কিন্তু বাস্তবে এই হুঁশিয়ারি ও সতর্কবার্তার কোনো প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। একটি ভালো, দরিদ্রবান্ধব কর্মসূচি কোনো কারণে ব্যর্থ হয়ে যাক, তা কারো কাম্য হতে পারে না। সরকার কর্মসূচি সফল করার জন্য নিজ গরজেই কার্যকর ও কঠোর ব্যবস্থা নেবে, এটাই আমরা প্রত্যাশা করি। চাল নিয়ে সব ধরনের চলবাজি রুখতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চাল নিয়ে চালবাজি

৬ জানুয়ারি, ২০১৯
১৫ অক্টোবর, ২০১৬

আরও
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ