বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
এমনি অপর একজন সাহাবি হজরত জারীর ইবনে আবদুল্লাহ (রা.)। তিনি একদিন তাঁর ভৃত্যকে একটি ঘোড়া কিনে আনার জন্য পাঠালেন। ভৃত্যটি তিন শত দিরহামে একটি ঘোড়া ক্রয় করত: অশ্ববিক্রেতাকে মূল্য পরিশোধের জন্য গৃহে নিয়ে আসল। সাইয়্যিদুনা জারীর ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) ঘোড়াটিকে দেখার পর বুঝলেন বিক্রেতা ঘোড়াটির মূল্য কম চেয়েছে। তিনি জানতে চাইলেন, ‘তুমি কি ঘোড়াটিকে চারশ’ দিরহামে বিক্রয় করবে?’ বিক্রেতাসম্মত হলো।
জারীর (রা.) বললেন, ‘পাঁচশ’ হলে কেমন হয়?’ মূল্যবৃদ্ধির এই অস্বাভাবিক প্রক্রিয়া তিনি অব্যাহত রাখলেন এবং শেষ পর্যন্ত আট শত দিরহাম মূল্যে হজরত জারীর (রা.) ঘোড়াটি কিনে নিলেন। পরে তাঁর কাছে এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তিনি বললেন, ‘ঘোড়াটির প্রকৃত মূল্য সম্পর্কে বিক্রেতার সঠিক ধারণা নেই। আমি তাকে সঠিক মূল্য দিয়েছি মাত্র। কারণ আমি রাসূল (সা.)-এর কাছে অঙ্গীকার করেছি, আমি সর্বদা সকল মুসলমান ভাইয়ের কাছে অকপট ও শুভাকাক্সক্ষী থাকব।’
আরেকজন সাহাবির কথা। যিনি একটি সোনার আংটি পরিধান করতেন। উল্লেখ্য, কোনো মুসলিম পুরুষের সোনা পরিধান করা নিষিদ্ধ। রাসূল (সা.) সাহাবির নিকট থেকে আংটিটা নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন এবং বললেন, এটা জাহান্নামের জ্বলন্ত অঙ্গার পরে থাকার সমতুল্য। পরে কেউ কেউ তাঁকে আংটিটা তুলে নিয়ে অন্য কোনো হালাল উপায়ে ব্যবহারের পরামর্শ দিলেন। কিন্তু তিনি তাদের পরামর্শ অগ্রাহ্য করে বললেন, ‘অসম্ভব, আল্লাহর শপথ! যে বস্ত্ত আল্লাহর রাসূল (সা.) ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন আমি আর তা কিছুতেই গ্রহণ করব না।’
বলাবাহুল্য, মহান সাহাবিদের জীবন ও মনের যে স্বরূপ, এসব তার এক একটি ছোট ছোট জোনাকী সদৃশ উদাহরণ মাত্র। আসলে তাঁদের পুরো জীবনই এই ধরনের দৃষ্টান্ত দ্বারা পরিপূর্ণ। তাঁরা তাঁদের অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে রাসূল (সা.)-এর নবুওয়তকে মেনে নিয়েছিলেন এবং তাঁরা পরিষ্কার জানতেন, এই মেনে নেওয়ার অর্থ কী এবং সবকিছু জেনেই তাঁদের পুরো জীবন ঈমানকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হলো। পৃথিবীর যে কোনো বস্তুত ও ব্যক্তির তুলনায় তাঁরা রাসূল (সা.) কে অধিক ভালোবাসতেন।
তাঁরা সর্বোচ্চ নিষ্ঠা ও একাগ্রতা নিয়ে তাঁর কার্যাবলি লক্ষ করতেন এবং সর্বান্তকরণে শ্রবণ করতেন তাঁর কথা। তাঁরা সর্বক্ষণই তাঁকে স্মরণ রাখতেন। তাঁর প্রতিটি নির্দেশ তাঁরা নিঃশর্তভাবে মান্য করতেন! তাঁরা কখনও এই কথা বলেননি যে, ‘এটা তো সুন্নাহ’ (ফরজ নয়)। অর্থাৎ উপেক্ষা করা যেতে পারে। তাঁরা কখনও এমন প্রশ্ন করেননি যে, এই নির্দেশ কেন দেওয়া হলো। তাঁরা কখনও অজুহাত খুঁজতেন না। ঘরে-বাইরে, ব্যবসাস্থল কি জিহাদের ময়দান, ছোটখাটো ব্যক্তিগত সমাবেশ অথবা রাজদরবার, সর্বত্রই তাঁরা ছিলেন আল্লাহ তায়ালার অনুগত বান্দা, ছিলেন রাসূল (সা.)-এর সর্বাধিক বাধ্য ও অকুণ্ঠ অনুসারী।
এই সাহাবিরা কেউই কখনও রাসূল (সা.)-এর জন্মদিবস পালন বা উদযাপন করেননি। তাঁরা কেউ প্রয়োজনই অনুভব করেননি যে, রাসূল (সা.)-এর জন্য কোনো বিশেষ দিবস বা মাস উৎসর্গ করা উচিত, কারণ তাঁদের পুরো জীবনই ছিল রাসূল (সা.)-এর প্রতি উৎসর্গকৃত। কিন্তু আমাদের জীবন ও দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সাহাবিদের অতি সামান্যই সাদৃশ্য আছে। আমরা তাঁর প্রশংসা করি, কিন্তু তাঁর কথার আনুগত্য করি না।
আমরা মুহাববতের দাবি করি, কিন্তু তাঁকে অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকি। আমরা বিশ্বাসের দাবি করি, কিন্তু আমাদের জীবন পরিচালিত অবিশ্বাসীদের মতো। আমরা সেই সকল বিষয়ে অধিক গুরুত্বারোপ করি, যে সকল বিষয় ছিল সাহাবিদের নিকট গৌণ। আর সেসকল বিষয়কে উপেক্ষা করি, যা ছিল সাহাবিদের নিকট অতীব গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা রাসূল (সা.) কে মুহাব্বত করতেন এবং তাঁদের জীবন ছিল এই মুহাববতেরই মূর্ত প্রতীক। কিন্তু আমরা? আমরা কি সৎ ও বিশ্বস্তভাবে এই কথা বলতে পারি যে, রাসূল (সা.) কে যেভাবে ভালোবাসা উচিত, আমরাও তাঁকে সেভাবেই ভালোবাসি?
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।