Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

দূষণ ছড়াচ্ছে ভূগর্ভে

আন্তর্জাতিক নদী দিবস পালিত বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, ধলেশ্বরী, শীতলক্ষ্যা, কর্ণফুলী, করতোয়া, তিস্তা, রূপসা ও মেঘনা নদীতে সবচেয়ে বেশি দূষণ, মরেছে ১৫৮টি নদ-নদী ৬০ বছর ধরে দখল দূষণে প

রফিক মুহাম্মদ | প্রকাশের সময় : ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:০১ এএম

নদী দখল ও দূষণ বেড়েই চলছে। নদী রক্ষায় গঠিত কমিশন থাকলেও তারা নদীর দখল বা দূষণ কিছুই কমাতে পারছে না। উল্টো দিন দিন তা বেড়েই চলেছে। দখল আর দূষণে এরই মধ্যে দেশের ১৫৮টি নদী মরে গেছে। অনেক নদী প্রবাহ হারিয়ে এখন মৃত্যুর মুখে। বর্জ্যরে ভাগাড় হিসেবে ব্যবহৃত হতে হতে নদী এখন বিষাক্ত হয়ে গেছে। এসব বিষাক্ত পানি এখন ভূগর্ভে প্রবেশ করে সেখানকার পানিকে দূষিত করছে। এটি মানব স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ভূগর্ভ থেকে আমারা খাওয়ার ও সেচের পানির বড় অংশ পাচ্ছি। এই পানি দূষিত হয়ে তা খাবারের সঙ্গে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে প্রাণঘাতী সব রোগের সৃষ্টি করছে।

বাংলাদেশে গত ৪০ বছরে দেশের নদ-নদীগুলো নিয়ে হওয়া ২৮৩টি গবেষণা পর্যালোচনা করে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে শিল্পায়ন ও নগরায়ণ দ্রুতগতিতে বাড়ছে। কিন্তু তাতে পরিবেশ সুরক্ষা এবং বর্জ্য নিয়ন্ত্রণ বা ব্যবস্থাপনার বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিত থাকছে। বিভিন্ন উৎস থেকে বের হওয়া বর্জ্যের বড় অংশ শেষ পর্যন্ত নদীতে গিয়ে পড়ে। বুড়িগঙ্গা থেকে শুরু করে তুরাগ, বালু, ধলেশ্বরী, শীতলক্ষ্যা, কর্ণফুলী, করতোয়া, তিস্তা, রূপসা ও মেঘনা নদীতে সবচেয়ে বেশি দূষণ হচ্ছে বলেও প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
দখল আর দূষণের নির্যাতনে দেশের নদীগুলো যখন কাঁদছে তখন গতকাল পালিত হলো আর্ন্তজাতিক নদী দিবস। এ দিবসটির এবারের সেøাগান ‘মানুষের জন্য নদী’। গতকাল ঢাকায় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের শহীদ শেখ কামাল মিলনায়তনে মুজিব শতবর্ষ ও বিশ্ব নদী দিবস-২০২১ উপলক্ষে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আয়োজিত ‘বঙ্গবন্ধুর নদী ও পরিবেশ ভাবনা এবং আমাদের করণীয়’ শীর্ষক সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করা হয়। এতে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সার্বিকভাবে ধারণ করতে পারলে বিশ্ব আসনে বাংলাদেশকে আরো মর্যাদার জায়গায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। আমরা যদি বঙ্গবন্ধুকে পুরোটাই আমাদের মাঝে নিতে পারি তাহলে নদীমাতৃক এ বাংলাদেশকে সার্বিকভাবেই এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
নদী রক্ষা কমিশনের তথ্য মতে, দেশে নদী দখলদার বেড়েছে। সংস্থাটি গত বছর ৩৯ হাজার ৫৫৮ জন নদী দখলদারের হালনাগাদ তালিকা প্রকাশ করলেও এ বছর তা বেড়ে ৬০ হাজারে দাঁড়িয়েছে। দেশে নদীর সংখ্যা নিয়ে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান আজো হয়নি। তবে বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলনের পক্ষ থেকে গত ২৩ সেপ্টেম্বর এক অনুষ্ঠানে বলা হয়েছে দেশে নদী রয়েছে ১৫ শ’র বেশি। এর মধ্যে সর্বশেষ সমীক্ষা অনুযায়ী ১৯৬৩ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দফায় দফায় দখল আর দূষণে এরই মধ্যে ১৫৮টি নদী শুকিয়ে গেছে। আর পানিপ্রবাহ কমে যাওয়ায় দূষিত হয়ে পড়া নদীগুলোর তলদেশে ১০ থেকে ১২ ফুট পর্যন্ত ক্ষতিকর ধাতুর কঠিন স্তর পড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের নদ-নদীগুলো দূষণের স্তর পেরিয়ে এখন বিষাক্ত অবস্থায় পৌঁছে গেছে। আর এগুলো ভূগর্ভে প্রবেশ করায় তা জনস্বাস্থ্যের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে গুরুতর সমস্যা তৈরি করবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মতিন উদ্দিন আহমেদের ২০১৮-১৯ সালে পরিচালিত গবেষণায় ঢাকার মতো বড় শহরগুলোর ভূগর্ভে ভারি ধাতুযুক্ত বিষাক্ত পানি প্রবেশ করার চিত্র উঠে এসেছে। ঢাকার হাজারীবাগ, সদরঘাট, সাভার ও গাজীপুরের নলকূপ ও গভীর নলকূপের পানি তিনি পরীক্ষা করেছেন। তার গবেষণায় এসব পানিতে ভারি ধাতুর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে। ড. মতিন উদ্দিন বলেন, ঢাকাসহ বড় শহরগুলোতে খাবারের পানির বেশির ভাগ ভূগর্ভ থেকে তুলে জোগান দেওয়া হচ্ছে। ভূগর্ভে একবার বিষাক্ত পানি প্রবেশ করলে তা পরিশোধন করা খুবই কঠিন। তাই সরকারের উচিত নদীগুলোকে দ্রুত দূষণমুক্ত করার ব্যাপারে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া।

পরিবেশ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের টেক্সটাইল শিল্প থেকে ২০১৬ সালে ২১ কোটি ৭০ লাখ ঘনমিটার তরল বর্জ্য নির্গত হয়। গত পাঁচ বছরে তা বেড়ে ২০২১ সালে ৩৪ কোটি ৯০ লাখ ঘনমিটারে পরিণত হয়েছে। আর শুধু সাভারের চামড়াশিল্প নগরী থেকে দিনে ৪০ হাজার ঘনমিটার তরল এবং ৩৩২ টন কঠিন বর্জ্য বের হয়ে পাশের ধলেশ্বরী নদীতে গিয়ে পড়ে। শিল্পকারখানা দূষণের দিক থেকে পর্যায়ক্রমে রয়েছে সিমেন্ট কারখানা ও সার কারখানা। এর পরেই রয়েছে টেক্সটাইল, প্লাস্টিক, তেল প্রক্রিয়াজাত কারখানা, ফার্মাসিউটিক্যালস ও মেটাল কারখানা। এসব দূষিত শিল্প বর্জ্য নদীতে মিশে পানিকে বিষাক্ত করছে। আর এই বিষাক্ত পানি ভূগর্ভে প্রবেশ করে ভূগর্ভে পানিকে দূষিত করছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরিফ জামিল ইনকিলাবকে বলেন, নদীরক্ষা কমিশন থাকার পরও দখল দূষণ কমে নি, বরং বেড়েছে। বুড়িগঙ্গা, শতীলক্ষ্যা, তুরাগ এসব নদীতে দখল এবং দূষণ আগের চেয়ে আরও বেড়েছে। ২০১৩ সালের জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইনে কমিশনকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল দখলদারদের তালিকা তৈরি করার। এরপর ১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত নদী রক্ষা কমিশন একটি সমীক্ষা করে দখলদারদের একটি তালিকা তৈরি করে। পরবর্তী বছর আবারো জরিপ করে আরেকটি তালিকা তৈরি করে। এই তালিকার পর নদী দখল তো কমেই নি বরং আইন লঙ্ঘন করে দখলদারদের সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত রয়েছে। যেমন আইনে আছে নদী দখলদাররা নির্বাচন করতে পারবেন না কিংবা ব্যাংক ঋণসুবিধা পাবেন না। কিন্তু এসব আইন বাস্তবায়ন তো হয়নি উল্টো তারা পুরস্কৃত হয়েছেন, ফলে দখল দূষণ বন্ধ হয়নি, আরও বেড়েছে। তিনি বলেন, আদালতের রায় বাস্তবায়ন ছাড়া নদী রক্ষা অসম্ভব। যে যাই করুক আইন থাকার পরও তার প্রয়োগ না থাকায় অপরাধীরা উৎসাহ পায়। যার কারণে দিন দিন তাদের অপরাধের মাত্রা বাড়তে থাকে। তার প্রমাণ গত বছর দখলদারের তালিকায় ৩৯ হাজার ৫৫৮ জনের নাম থাকলেও এবার তা বেড়ে ৬০ হাজারে দাঁড়িয়েছে।

এ বিষয়ে গতকাল জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান এ এস এম আলী কবীর বলেন, সর্বশেষ ২৪ সেপ্টেম্বরের তালিকা অনুযায়ী ৭০০ নদী ৬০ হাজার দখলদার দ্বারা নানাভাবে গ্রতিগ্রস্ত হয়েছে। আগের তালিকার চেয়ে হালনাগাদ তালিকায় দখলদারের সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। তবে কমিশন গঠনের পর দখল দূষণে পড়া নদীগুলো রক্ষায় দফায় দফায় চেষ্টা চলছে। এরই মধ্যে কিছু অগ্রগতিও হয়েছে। তবে ৬০ বছর ধরে দফায় দফায় দখল দূষণে পড়া নদীগুলো আট বছরে উদ্ধার সম্ভব না। এজন্য সময় প্রয়োজন। নদী দখলদারের সংখ্যা অনেক বড়। ফলে উচ্ছেদ করতেও একটু সময় লাগছে। আমরা চেষ্টা করছি নদী দখল ও দূষণ বন্ধ করার। একসময় এর সফলতা আসবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দূষণ

২৫ জানুয়ারি, ২০২৩
২৮ ডিসেম্বর, ২০২২
৪ ডিসেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ