বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
জাদু ও মু’জ্বিযাহ উভয়টিই বাহ্যিক দৃষ্টিতে স্বাভাবিক নিয়মের ব্যতিক্রম বলে একইরকম মনে হয়। কিন্তু এ দুটোর মাঝে আকাশ-পাতাল ব্যবধান বিদ্যমান। সুস্পষ্ট পার্থক্য হলো এই যে, মু’জ্বিযাহ আল্লাহ পাকের মনোনীত বান্দাহ নবীগণের হাতে প্রকাশ পায়। মু’জ্বিযাহ প্রকাশের যাবতীয় এন্তেজাম আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের ইচ্ছা ও নির্দেশে পরিসাধিত হয়। জাদু প্রকাশ পায় এমন মানুষের হাতে সে নবী ও রাসূল নয়। জাদুর কার্য কারণ সম্পর্ক থাকে, যদিও তা সূক্ষ্ম ও গুপ্ত হোক। কিন্তু মুু’জ্বিযাহ কোনো কার্যকারণের অধীন নয়। বরং তা কোনো কারণ ছাড়া সরাসরি আল্লাহ পাকের কাজ বলে পরিগণিত।
যেমন (ক) আল্লাহপাক স্বয়ং বলেন : (হে প্রিয় হাবীব!) যখন আপনি ধূলি নিক্ষেপ করলেন, তখন আপনি নিক্ষেপ করেননি, বরং আল্লাহ তায়ালা নিজে নিক্ষেপ করেছেন। (সূরা আনফাল : আয়াত-১৭)। এখানে ধূলি নিক্ষেপ করাটা আল্লাহতায়ালা নিজের কাজ বলে উল্লেখ করেছেন।
(খ) নমরূদের আগুনের প্রতি আল্লাহ পাক নির্দেশ করলেন : হে আগুন! ইব্রাহীমের জন্য শান্তিদায়ক ঠাণ্ডা হয়ে যাও। (সূরা আম্বিয়া : আয়াত-৬৯)। দীর্ঘ দিন ধরে প্রজ্বলিত অনলকুণ্ড শান্তিদায়ক শীতল হয়ে যাওয়ার মধ্যে কার্যকারণ সম্পর্কের কোনোই ছোঁয়াচ নেই।
(গ) মু’জ্বিযাহ নাবুওয়াত ও রিসালাতের সম্মানজনক মাকামে উপনীত ব্যক্তিদের মাধ্যমে প্রকাশ পায়, যাদের আল্লাহভীতি শারীরিক ও মানসিক পবিত্রতা এবং পুণ্যময় কাজ-কর্ম সকলেই প্রত্যক্ষ করে থাকে। পক্ষান্তরে জাদুর ক্রিয়া তো তাদের দ্বারা প্রকাশ পায় যাদের ভেতর-বাহির অপবিত্রতায় ভরপুর। আল্লাহপাকের যিকির ও ইবাদত-বন্দেগী হতে যারা বহু দূরে অবস্থান করে।
(ঘ) মু’জ্বিযাহ চ্যালেঞ্জের সাথে হয়ে থাকে। এর অর্থ হলো এই যে, মু’জ্বিযাহ প্রদর্শনের পর নবী ও রাসূলগণ চ্যালেঞ্জ করে থাকেন যে, যদি দর্শকদের কেউ এটি অবিশ্বাস করো, তাহলে এর অনুরূপ করে দেখাও। অপরদিকে জাদুকর চ্যালেঞ্জ করার সৎ সাহস সংরক্ষণ করে না। কারণ সে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে ভয় পায়। কারণ জাদু যে কেউ শিখে আয়ত্ত করতে পারে এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে।
(ঙ) শয়তানরা কেবলমাত্র ওই সকল দুষ্ট ব্যক্তির সহযোগিতা করে যারা কাজ, কথা ও বিশ্বাসের অপবিত্রতা ও খাবাছাতের দিক থেকে তাদের সাদৃশ্য। এ বর্ণনার দ্বারা নবী ও রাসূল হতে জাদুকর পৃথক হয়ে যায়।
(চ) জমহুর উলামাগণ জাদু ও মু’জ্বিযার পার্থক্য নির্ণয়ে বলেছেন : জাদু সাধারণ নিয়মের বিপরীত কাজ যা দুষ্ট ও অপবিত্র ব্যক্তির ক্লেদাক্ত কাজের ছোঁয়ার প্রকাশ পায়। মু’জ্বিযা হতে জাদুকরের পদ্ধতি সম্পূর্ণ অচল। জাদুকর কখনো পর্বত দুই ভাগ করা, চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত করা, মৃত ব্যক্তিকে জীবিত করা, চতুষ্পদ প্রাণীর সাথে বাক্যালাপ করা ইত্যাদি নবীর মু’জ্বিযাহর মতো কর্ম প্রদর্শনের ক্ষমতা রাখে না।
(ছ) মুহাক্কিকদের একটি শ্রেণী মু’জ্বিযাহ ও জাদুর মধ্যে পার্থক্য এভাবে বর্ণনা করেছেন যে, মু’জ্বিযাহ অলৌকিক হওয়ার সাথে সাথে প্রতিপক্ষের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়া হয়ে থাকে। জাদুর মধ্যে চ্যালেঞ্জ থাকে না। ভণ্ড ও মিথ্যা নবীর দাবিদারের হাতে কখনো মু’জ্বিযাহ প্রকাশ পাবে না। আল্লাহ পাকের চিরন্তন নীতি এভাবেই চলে এসেছে। এভাবেই নবুওয়াতের গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানিত পদের প্রাচীর ভণ্ড ও মিথ্যাবাদীদের দ্বারা পদদলিত হওয়া থেকে সংরক্ষিত হয়ে এসেছে। (তাফসীরে রূহুল মায়ানী : ১/৩৩৮-৩৩৯)।
(জ) বিশেষ আমলের সংশ্লিষ্টতায় খবীছ ও দুশ্চরিত্র ব্যক্তিদের থেকে সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম এমন কাজ সংঘটিত হওয়া জাদু, সেখানে শিক্ষাদান ও গ্রহণের নিয়ম চলে। এ দু’টি বিষয়ের দ্বারা মু’জ্বিযাহ থেকে জাদু পৃথক হয়ে যায়। কেননা, মু’জ্বিযা আবিষ্কারকের আবিষ্কার ও চয়নকারীদের চয়ন অনুযায়ী সংঘটিত হয় না। অথচ জাদু স্থান-কাল ও শর্তের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে সংযুক্ত।
(ঝ) মু’জ্বিযার প্রতিদ্বন্দ্বিতার ঘোষণা দেয়া হলেও তার প্রতিদ্বন্দ্বিতার দুঃসাহস প্রদর্শন করতে কেউ এগিয়ে আসে না। অপরদিকে জাদুকর অনেক সময় ভেতরে-বাইরে অপবিত্রতা, নোংরামি, ফিসক-ফুজুরীর সাথে জড়িত থাকে বিধায় অন্য কোনো অপবিত্রতা এর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে মাথা তুলে দাঁড়ায়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আরবী মু’জ্বিযাহ শব্দটি ‘ইজ্জুন’ শব্দ হতে উদ্ভূত। এর অর্থ অক্ষম করা, অপারগ করা। মূলত মু’জ্বিযা হলো-ইজ্জুন-এর কর্তা। যিনি অন্যের মধ্যে অক্ষমতা সৃষ্টি করতে পারেন, তিনি হলেন স্বয়ং আল্লাহপাক। এ জন্য আল্লাহপাকের কাজের সঙ্গে পাল্লা দেয়ার সামর্থ্য সৃষ্টি জগতের কোনো কিছুরই নেই। (মেরকাত শরহে মিশকাত : ২/৫৩০)।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।