বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
মানুষের চরিত্রের উৎকর্ষতা ও নিম্নতা মাপার একটি মাপকাঠি হচ্ছে ভাষা। ভাষা তিক্ত ও কঠোর হলে তার আঘাত হয় বড্ড ভয়ঙ্কর এবং তার ক্ষত অনেক গভীর পর্যন্ত পেঁৗছে যায়। ভাষার সুন্দর ব্যবহারের সর্বোচ্চ দিক হলো, সকল নবী—রাসূল এ ভাষার মাধ্যমে তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছেন। আবার এর নেতিবাচক দিক খেয়াল করলে দেখা যাবে আখলাক এবং মানুষের যাবতীয় কাজ—কর্ম, চাল—চলনের সবচেয়ে বড় দুশমনও এটিই। আজকে ভাষা ও প্রচার মাধ্যমগুলোর মাধ্যমে দুশমনদের নৈতিক স্খলন ও চারিত্রিক রোগ—ব্যধি আমাদের মধ্যেও অনুপ্রবেশ করছে।
এটা একটা সর্বজন স্বীকৃত কথা যে, আমাদের চারিত্রিক উন্নতির পেছনে ভাষার ভূমিকা অনেক। চরিত্র তখনই সুদৃঢ় হয় যখন এর ভিত্তি স্থাপিত হয় গভীর জ্ঞান এবং সঠিক পরিকল্পনার হাতে। আর জ্ঞানের সর্বপ্রকার প্রকাশ ঘটে ভাষার মাধ্যমে।
এ কারণে সুন্দর কথোপকথন জরুরি। সুন্দর কিংবা ভালো ভাষা ও কথোপকথন কী—এ বিষয়ে কিছু কলাকৌশল উল্লেখ করব। ১. কথোপকথনের আকর্ষণ নির্ভর করে বক্তব্যের উদ্দেশ্যের ওপর। সুতরাং বক্তব্যের উদ্দেশ্য যত মহৎ হবে বক্তব্য ও কথোপকথন তত সুন্দর ও শ্রম্নতিকাম্য হবে। তাই অর্থহীন বাক্যবিনিময় থেকে বিরত থাকা একান্ত কর্তব্য।
২. সর্বদা সত্য কথা বলা নিজের জন্য অত্যাবশ্যকীয় করে নিতে হবে। কেননা, মিথ্যা সকল পাপের মূল। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, সবচেয়ে বড় খেয়ানত হলো, তুমি তোমার মুসলমান ভাইকে এমন একটি কথা বললে যা সে সত্য বলে মনে করল অথচ তা মিথ্যা। (আবু দাউদ)।
৩. কথাবার্তায় ঐ সব বিষয় শামিল থাকা চাই যে বিষয়ে পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস আছে। নিজের বক্তব্যের সাথে কাজের মিল রাখার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। বক্তব্য ও কাজের বৈপরীত্য থেকে বাঁচার চেষ্টা করতে হবে। অন্যথায় এতে সমাজে বে—আমলীর পরিবেশ সৃষ্টি হবে। কথা ও কাজের বৈপরীত্যের নিন্দা করে কোরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা মানুষকে ভালো কথা শোনাও অথচ নিজেরা তা ভুলে যাও!’ (সুরা বাকারা : ৪৪)।
৪. বাক্য প্রয়োগে কৃত্রিমতা ও লৌকিকতা থেকে মুক্ত থাকতে হবে। কেননা এসব মানুষের সাথে সম্পর্ক জোড়ার পরিবর্তে সম্পর্কের ভাঙন সৃষ্টি করে। নিজের সত্তাকে অন্যের সামনে সহজ—সরল রূপে প্রকাশের চেষ্টা করতে হবে।
৫. মন ভাঙে, হতাশা এবং ভীতির সৃষ্টি করে এ ধরনের বাক্যের পরিবর্তে আশা সঞ্চারক এবং কল্যাণকর কথা বলা চাই। বক্তার প্রধান উদ্দেশ্য যদি হয় মানুষের কল্যাণ কামনা তাহলে সে সামাজিক জীবনে মানুষের জন্য উপকারী ব্যক্তি হিসেবে প্রমাণিত হবে। হাদীসে ইরশাদ হয়েছে— বান্দার যবান থেকে কোনো সময় ভালো কথা বের হয়, যা আল্লাহর পসন্দের কারণ। বান্দা এটাকে তেমন গুরুত্বই দেয় না। অথচ আল্লাহ তাআলা এর বদলায় তার মর্যাদা বুলন্দ করেন। (সহীহ বুখারী)।
৬. বাক্যে কমনীয়তা ও ঋজুতা অবলম্বন করতে হবে। আল্লাহ তাআলা ফেরাউনের মতো জালেমের সাথেও নরম ভাষায় কথা বলার আদেশ দিয়েছিলেন হযরত মূসা (আ.)—কে। ইরশাদ হয়েছে, ‘তাদের সাথে নরম ভাষায় কথা বলবে’। তাহলে মুসলমান পরস্পরের মধ্যে কী ধরনের বাক্য বিনিময় করবে তা বলাই বাহুল্য।
৭. শ্রোতার বয়স, মেধা, মানসিক অবস্থা এবং যোগ্যতার প্রতি লক্ষ রেখে কথা বলবে। শিশুদের সাথেও আদব বজায় রেখে কথা বলবে এবং তাদের সাথে দর্শন বা ফালসাফার কথা বলবে না। এমনিভাবে মা—বাবার সাথে কথা বলার সময় আল্লাহর নির্দেশ পালনে যত্নবান থাকবে। তাদের সামনে ‘উফ্’ শব্দটিও উচ্চারণ করবে না, কঠোরতা করবে না, উত্তেজিত বা বিরক্ত হবে না। সর্বদা আদব ও ইহতেরামের প্রতি খেয়াল রাখবে।
৮. আবেগতাড়িত হয়ে কথা বলবে না এবং কখনও একথা মাথায় আনা যাবে না যে, আমার কাছে যে ইলম আছে এটাই একমাত্র সঠিক। নিজেকে সর্বদা সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে রেখে অন্যের কথা ও মতামত শোনার মানসিকতা রাখবে। সংক্ষিপ্ত এবং অর্থবহ বাক্য বিনিময় করবে। অর্থহীন দীর্ঘ আলাপচারিতা থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করবে।
৯. যার সাথে কথা বলবে দৃষ্টিও রাখবে তার দিকে। অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে কথা বলবে না। আমাদের যবানের পবিত্রতা নিঃসন্দেহে আত্মার পবিত্রতার মাধ্যম। এজন্য যবানের স্খলনকে মামুলী মনে করবে না। যবানের স্খলন থেকে বেঁচে থাকার জন্য সতর্কতা ও সচেতনতা জরুরি। এই সতর্কতার গুণ অর্জন করতে সদা তৎপর থাকতে এবং অন্যদেরকেও এ ব্যাপারে উৎসাহিত করতে হবে। অন্যের দুর্বলতা দূর করতে না পারলেও অব্যাহত প্রচেষ্টায় নিজের সংশোধনী আসবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।