Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নদীভাঙনে নিঃস্ব মানুষ

ভারত বাঁধ—ব্যারাজ খুলে দেয়ায় বানের পানির রুদ্ররোষ

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:০১ এএম

ভাঙনে ভিটেমাটি, ফসলি জমি, হাট—বাজার, মসজিদ, স্কুল—মাদরাসা, ক্লিনিকসহ সরকারি—বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে বিলীন ব্রহ্মপুত্র—যমুনা—পদ্মা—তুরাগসহ আট নদী ১৯টি পয়েন্টে বিপদসীমার ঊর্ধ্বে : ঢাকার আশপাশে বাড়ছে পানি ভারতে অতিবৃষ্টিতে উজানের ঢল অব্যাহত : উত্তরাঞ্চল থেকে দক্ষিণে বন্যার আরো অবনতি

দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের ১৩টি জেলার বন্যা পরিস্থিতি আরো অবনতি হয়েছে। ভারত সব বাঁধ—ব্যারেজ খুলে দেয়ায় হু হু করে আসছে ঢলের পানি। ফলে দেশের অভ্যন্তরে খুব বেশি বৃষ্টিপাত না হলেও উজানের ঢলে দেশের প্রধান নদ—নদীসমূহ এবং শাখা—প্রশাখা, উপনদীগুলোতে পানি বেড়েই চলেছে। পানি বৃদ্ধির ফলে নদীভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে।

বর্ষায় নদীভাঙন স্বাভাবিক হলেও এ বছর তা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। বাংলাদেশে ব্রহ্মপুত্রের প্রবেশমুখ কুড়িগ্রাম থেকে শুরু করে গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ ও রাজবাড়ী পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চলছে তীব্র নদীভাঙন। অন্যদিকে রাজবাড়ী থেকে শুরু হয়ে মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ঢাকা ও চাঁদপুর পর্যন্ত পদ্মার দুই পাড়ের বাসিন্দারাও নদীভাঙনে নিঃস্ব হচ্ছে। এছাড়া চাঁদপুর থেকে বঙ্গোপসাগরে যাওয়া পর্যন্ত মেঘনা এবং এর শাখা নদীগুলোও ভেঙে নিচ্ছে ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ফসলের মাঠ। পদ্মা—যমুনা—তিস্তা—ব্রহ্মপুত্রসহ অন্যান্য শাখা নদীর রুদ্ররোষে সহায়—সম্পদ হারিয়ে অনেকেই রাতারাতি ভূমিহীনে পরিণত হচ্ছেন।

করোনা মহামারি দুর্যোগকালে বন্যা ও নদীভাঙনে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে লাখো মানুষ। তাদের খাদ্য, বাসস্থান, বিশুদ্ধ খাবার পানি, চিকিৎসার সঙ্কট দিন দিন প্রকট হচ্ছে। বন্যা ও ভাঙন এলাকায় কাজ নেই, খাবার নেই। সরকারি—বেসরকারি ত্রাণসামগ্রী কোথাও কোথাও পৌঁছালেও তা অভাবের তুলনায় খুবই কম। অধিকাংশ স্থানে জরুরি ত্রাণ সাহায্য—সামগ্রী এখনো পেঁৗছেনি। বন্যার্ত নদীভাঙন কবলিত হাজার হাজার পরিবারের নিত্যদিনের কষ্ট—দুর্ভোগের শেষ নেই। ভাঙনে ভিটেমাটি, ফল—ফসলি জমি, রাস্তাঘাট, হাট—বাজার, মসজিদ, স্কুল—মাদরাসা, ক্লিনিকসহ সরকারি—বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রমত্তা নদীগর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে। ভাঙন আতঙ্কে নদী তীরের মানুষের চোখে ঘুম নেই। স্বাভাবিক জনজীবন অচল হয়ে পড়েছে। ভোলা সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নে মেঘনার ভয়াভহ ভাঙনে গত কয়েক দিনে বহু বসতঘর ও দোকানপাট, মাছঘাট, মসজিদসহ প্রায় ৪০০ মিটার এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এতে ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব অসহায় পরিবারগুলো রয়েছে নানা ভোগান্তিতে। নীলফামারিতে তিস্তার ভাঙনে ঝুনাগাছ চাপানি ইউনিয়নের ভেন্ডাবাড়িতে নদীর স্পার বাঁধের ২০০ মিটার নদীগর্ভে চলে গেছে।

পাউবোর বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র গতকাল জানায়, ব্রহ্মপুত্র—যমুনা—পদ্মাসহ আটটি নদ—নদী ১৯টি পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। প্রধান নদ—নদীসমূহে পানি বৃদ্ধির দিকেই রয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত অধিকাংশ শাখা—প্রশাখা, উপনদী, খাল—খাঁড়িগুলো উত্তাল হয়ে বন্যা ও ভাঙন আরো বিস্তৃত হচ্ছে। উজান থেকে ভারতের অব্যাহত ঢলের চাপে দেশের মধ্যাঞ্চলে এমনকি ঢাকার আশপাশের বিভিন্ন নদীতেও বাড়ছে পানি। তুরাগ নদী কালিয়াকৈরে বিপদসীমার ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হচ্ছে।

ভারতের আবহাওয়া বিভাগ জানায়, আসাম, মেঘালয়, সিকিম, অরুণাচল প্রদেশসহ উত্তর—পূর্ব ভারত, বিহার, মধ্য—ভারত, হিমালয় পাদদেশীয় ও গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ এবং নেপালে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টি, কোথাও কোথাও অতি বর্ষণ হচ্ছে। সক্রিয় মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে। ভারতে অতিবৃষ্টির সাথে উজানের বাঁধ—ব্যারেজগুলো খুলে পানি ছেড়ে দেয়ায় ভাটিতে বাংলাদেশের দিকে হু হু করে আসছে ঢল—বানের পানি। বন্যায় তলিয়ে যাচ্ছে দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা। এদিকে গতকাল বাংলাদেশ আবহাওয়া বিভাগের বিশেষজ্ঞ কমিটির দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাস বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, চলতি সেপ্টেম্বর (ভাদ্র—আশ্বিন) মাসে দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর—পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণ—পূর্বাঞ্চলে আকস্মিক বন্যার আশঙ্কা রয়েছে।

নদ—নদীর প্রবাহ পরিস্থিতি ও পূর্বাভাসে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, ব্রহ্মপুত্র—যমুনা নদ এবং গঙ্গা—পদ্মা নদ—নদীসমূহের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা আগামী ২৪ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। কুশিয়ারা ব্যতীত উত্তর—পূর্বাঞ্চলে প্রধান নদীসমূহের পানি হ্রাস পাচ্ছে। যা আগামী ২৪ ঘণ্টায় অব্যাহত থাকতে পারে। আজ শুক্রবার উত্তর জনপদের কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, উত্তর—মধ্যাঞ্চলে জামালপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, মধ্যাঞ্চলে টাঙ্গাইল, পাবনা, মধ্য—দক্ষিণে মানিকগঞ্জ, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর ও ফরিদপুর জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে পারে। যমুনা নদের ৯টি পয়েন্টের সবক’টিতেই পানি বিপদসীমার ঊর্ধ্বে প্রবাহিত হচ্ছে এবং আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে ফুলছড়িতে বিপদসীমার ৫০, সাঘাটায় ৩২, বাহাদুরাবাদে ৬২, সারিয়াকান্দিতে ৬৫, কাজীপুরে ৫৯, সিরাজগঞ্জে ৬২, পোড়াবাড়ীতে ২৪, মথুরায় ও আরিচায় ২৬ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

বন্যা ও নদীভাঙন নিয়ে আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো প্রতিবেদন তুলে ধরা হলো।
রাজশাহী থেকে রেজাউল করিম রাজু জানান, পদ্মার পানিতে কিছুটা টান ধরেছে। একটু একটু করে পানি কমছে। রাজশাহীতে পদ্মার পানি বিপদসীমা ১৮ দশমিক ৫০ মিটার হলেও ১৮ মিটার পর্যন্ত উঠে ফের পানি নামতে শুরু করেছে। পানি কমার সাথে সাথেই নদীপাড়ের মানুষের মাঝে ভাঙন আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। উপদ্রব বেড়েছে রাসেল ভাইপারসহ নানা ধরনের সাপের। রোগ বালাইও বেড়েছে। বিশেষ করে বিশুদ্ধ পানির অভাবে ডাইরিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে পানিবন্দি মানুষ। বিশেষকরে শিশুরা। এবারো উজানের পানির ঢল ফারাক্কার গেট পেরিয়ে হু হু করে আসে। প্রথমেই আঘাত হানে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের দু’পাড়েই ভাঙন শুরু করেছে। ইতোমধ্যেই চরজগন্নাথপুর বাদশাপাড়া, পণ্ডিতপাড়া, মনোহরপুর বেশি হুমকির মুখে পড়েছে। ইতোমধ্যেই বিপুল পরিমাণ জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে।

বগুড়া থেকে মহসিন রাজু জানান, যমুনা ও বাঙ্গালী নদীতে পানি বৃদ্ধির কারণে তলিয়ে গেছে ১৭৭ হেক্টর জমির ফসল। ভেসে গেছে বেশকিছু পুকুরের মাছ। সর্বশেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী গত কয়েক দিনের বৃষ্টিপাতে এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানিতে বগুড়ার সারিয়াকান্দির নিকট যমুনা ও বাঙ্গালী নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত ও বন্যা পরিস্থির অবনতি হয়েছে।

কুড়িগ্রাম থেকে শফিকুল ইসলাম বেব জানান, সপ্তাহ ধরে ব্রহ্মপুত্র ও ধরলা নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে। এতেকরে দুর্ভোগে পড়েছে চর, দ্বীপচরসহ নদ—নদী অববাহিকার নিচু এলাকার অন্তত ৫০ হাজার পানিবন্দি মানুষ। এসব এলাকার কাঁচা সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় ভেঙে পড়েছে যোগাযোগব্যবস্থা। ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি পেয়ে চিলমারী পয়েন্টে ৪৮ ও ধরলা নদীর পানি ব্রীজ পয়েন্টে ৫ সেন্টিমিটার বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। টানা বন্যার কারণে জেলায় ২১ হাজার ৫০৫ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। এরমধ্যে রোপা আমন ২১ হাজার ১২৫ হেক্টর, শাকসবজি ২৭৫ হেক্টর এবং বীজতলা ১০৫ হেক্টর। গত ২৪ ঘণ্টায় উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের অনন্তপুর বাজারের কাছে বেড়ি বাঁধের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে নতুন করে ৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। অপর দিকে ধরলা ও তিস্তা নদীর পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে রাজারহাট উপজেলার গতিয়াশাম, খিতাবখা, কিংছিনাই ও সদর উপজেলার চর বড়াইবাড়িসহ ২৫টি পয়েন্ট নদীভাঙন তীব্র রূপ নিয়েছে। গৃহহীন হয়েছে আরো শতাধিক পরিবার।

লালমনিরহাট থেকে মো. আইয়ুব আলী বসুনীয়া জানান, তিস্তা নদীর ভাঙন কিছুতেই থামছে না। নদীভাঙনে দিশেহারা এ জেলার মানুষ। সর্বগ্রাসী তিস্তার ভাঙনের কবলে পড়ে সর্বহারা হয়ে কয়েক গ্রামের মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ভাঙন ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নেই কোনো কার্যকর পদক্ষেপ, এমন অভিযোগ ভাঙনের শিকার পরিবারগুলোর। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে জেলার হাতীবান্ধা ও আদিতমারী উপজেলায় প্রায় পাচঁ শতাধিক পরিবারের বসতবাড়ি তিস্তা নদীতে বিলীন হয়েছে। হুমকির মুখে পড়েছে শত শত ঘরবাড়ি, প্রাথমিক বিদ্যালয়, মসজিদ, মাদ্রাসা ও ফসলি জমি ও বিভিন্ন স্থাপনা। বসত—বাড়ি হারা মানুষ জন বর্তমানে পরিবার পরিজন নিয়ে খোলা আকাশের নিচে নিদারুণ কষ্টে দিবারাত্রি কাটাচ্ছে। তিস্তা নদী অববাহিকার নিম্নাঞ্চলের শত শত হেক্টর জমির রোপা আমন ক্ষেত পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে।

নীলফামারী থেকে মোশফিকুর রহমান সৈকত জানান, তিস্তা নদী হামার সবকিছু খেয়া ফেলাইছে। বাঁধের ওপর কোনোরকমে ছাওনি ঘর বানে (বানিয়ে) দিন কাটাইছি। এইবার সেটাও ভেঙে গেল। এলা থাকমো কোনঠে (কোথায়)। কথাগুলো বলছিলেন তিস্তা নদীর ভাঙনে নিঃস্ব নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার ঝুনাগাছ চাপানি ইউনিয়নের স্পার বাঁধ এলাকার বাসিন্দা শামসুল ইসলাম (৫৬)। তার মতো হাজারও মানুষ তিস্তার ভাঙনে দুর্ভোগে পড়েছেন। ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন অনেকে। ঝুনাগাছ চাপানি ইউনিয়নের ভেন্ডাবাড়িতে তিস্তার নদীর স্পার বাঁধ ভাঙনের মুখে পড়ছে। ডান তীর বাঁধের নিয়ন্ত্রক এই স্পার বাঁধটি রক্ষায় আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বালুর বস্তা ফেলেও কোনো লাভ হয়নি। রাতে বাঁধটির প্রায় ২০০ মিটার ভেঙে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এর ফলে উপজেলার ভেন্ডাবাড়ি এলাকার আড়াই হাজার পরিবার হুমকির মুখে পড়েছে।

টাঙ্গাইল থেকে আতাউর রহমান আজাদ জানান, যমুনা, ধলেশ্বরী ও ঝিনাইসহ অনান্য শাখা নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় টাঙ্গাইল জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় বৃহস্পতিবার যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ৫৯ সেন্টিমিটার, ধলেশ্বরী নদীর পানি বিপদসীমার ৬৪ সেন্টিমিটার এবং ঝিনাই নদীর পানি বিপদসীমার ৯১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে, সকল নদীর পানি বৃদ্ধি ও বিভিন্ন স্থানে বাঁধ, কাঁচা রাস্তা, ব্রীজ ও কালভার্ট ভেঙে নতুন নতুন এলাকা বন্যা কবলিত হয়ে পড়ছে। জেলার ৭টি উপজেলার নদী তীরবর্তীসহ শতাধিক গ্রাম বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। এসব এলাকায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ফলে বিশুদ্ধ খাবার পানি ও গো—খাদ্যের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। উপজেলাগুলো হচ্ছেÑ টঙ্গাইল সদর, গোপালপুর, ভূঞাপুর, নাগরপুর, কালিহাতী, বাসাইল ও মির্জাপুর উপজেলা। এদিকে পানি বৃদ্ধির সাথে দেখা দিয়েছে তীব্র ভাঙন। কালিহাতী উপজেলার আলীপুর ও ভৈরব বাড়ি এবং ভূঞাপুর উপজেলার ভালকুটিয়া, স্থলকাশি ও সদর উপজেলার চরাঞ্চলে নতুন করে গত কয়েকদিনে আরো অর্ধশতাধিক ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। হুমকিতে রয়েছে ফসলি জমি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থাপনা।

রংপুর থেকে হালিম আনছারী জানান, সর্বগ্রাসী তিস্তার ভয়াবহ ভাঙন কমছে না। দিনে দিনে তীব্র থেকে তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন। নদীর গতিপথ পরিবর্তনের কারণে প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা ভাঙছে। ভয়াবহ ভাঙনে জেলার মানচিত্র থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একের পর এক গ্রাম। ইতোমধ্যে জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলার পশ্চিম ইচলি ও বিনবিনার চর এবং পীরগাছা উপজেলার চর গাবুরা গ্রাম মানচিত্র থেকে মুছে যাওয়ার পথে বসেছে। করাল গ্রাসী তিস্তা ইতোমধ্যে এই গ্রাম ৩টির ঘর—বাড়ি, ফসলি জমি, মসজিদ—মাদ্রাসা, রাস্তা—ঘাটসহ সবকিছুই গিলে খেয়েছে। এছাড়া আরও ৫টি গ্রাম মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে।

মাদারীপুর থেকে আবুল হাসান সোহেল জানান, জেলার শিবচরে বিভিন্ন নদনদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি আড়িয়াল খাঁ নদীর পানি বৃদ্ধির ফলে তীব্র স্রোতে কলাতলা—শিরুয়াইল অংশে পুনরায় ব্যাপক ভাঙন শুরু হয়েছে। গত এক সপ্তাহ যাবৎ আড়িয়াল খাঁ নদীর তীব্র ভাঙনে দিশেহারা হয়ে পড়েছে ভাঙনকবলিত সাধারণ মানুষ। ভাঙনের কবলে পড়েছে রাস্তাঘাট, বসতভিটা ও ফসলি জমি। ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে প্রাথমিক বিদ্যালয়, বসতবাড়ি, মসজিদ ও কবরস্থানসহ হাটবাজার।

মানিকগঞ্জ থেকে শাহীন তারেক জানান, পদ্মা, যমুনা, কালিগঙ্গাসহ অভ্যন্তরীণ নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ফলে প্রতিদিন নতুন নতুন নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে। ইতোমধ্যে জেলার সাতটি উপজেলার মধ্যে দৌলতপুর, শিবালয়, ঘিওর ও হরিরামপুর উপজেলার নদী তীরবর্তী এলাকার নিম্নাঞ্চলে পানি প্রবেশ করেছে। চতুর্দিকে পানি থাকায় অনেক এলাকার লোকজন গৃহবন্দি হয়ে পড়েছে। গত কয়েক দিনে পানি বাড়ার সাথে সাথে নদীভাঙনে বিলীন হচ্ছে মানুষের ঘরবাড়ি, জমিজমা ও প্রতিষ্ঠান। পদ্মা যুমনার অব্যাহত পানি বৃদ্ধির ফলে পানির তোড়ে পদ্মার ভয়াল থাবার মুখে লন্ডভন্ড হচ্ছে মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের দুর্গম চরাঞ্চলের আজিমনগর ইউনিয়নের হাতিঘাটা, নুসরতপুর, ইব্রাহিমপুরসহ কয়েকটি গ্রাম। প্রতিদিনই গাছপালাসহ ভিটেবাড়ি গ্রাস করছে সর্বনাসী পদ্মা। ফলে ভাঙন আতঙ্কে যেন অসহায় হয়ে পড়েছে নদী পাড়ের হাজার হাজার মানুষ।

ফরিদপুর থেকে আনোয়ার জাহিদ বলেন, সদর থানার শহর রক্ষা বাঁধের বিপরীত পাশে বাড়ছে বন্যার বিস্তার। প্রতিদিন ডুবছে নতুন নতুন গ্রাম, বাজার, রাস্তা এবং ইটের ভাটা। গত ৪৮ ঘণ্টায় পূর্বের চেয়ে পদ্মা নদীতে ৯ সেন্টিমিটার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৬১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পদ্মার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টার মধ্য ফরিদপুর সদর থানার ডিক্রীরচর, নর্থচ্যানেল, অম্বিকাপুর, চরমাধবদিয়া এই ৪টি ইউনিয়ের সমস্ত নিম্নাঞ্চল বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। পানির তোড়ে ভেঙে গেছে চর আদমপুর ও মোহনের বাজার এলাকার একমাত্র সড়কটি।

ভোলা থেকে মো. জহিরুল হক জানান, উজানের পানির তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় ভোলা সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নে মেঘনায় ভয়াভহ ভাঙন দেখা দিয়েছে। গত কয়েক দিনে ভাঙনে বহু বসতঘর ও দোকানপাট, মাঠঘাট, মসজিদসহ প্রায় ৪০০ মিটার এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের আতঙ্কে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে শতাধিক ঘরবাড়ি। ভাঙন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে গোটা এলাকাজুড়ে। ভাঙনরোধে জরুরি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি স্থানীয়দের।

ইসলামপুর (জামালপুর) থেকে ফিরোজ খান লোহানী জানান, ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদ নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। অসময়ে বন্যায় হুমকিতে রয়েছে সাপধরী ইউনিয়নে স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত ইন্দুল্লামারী বাঁধটি। জেলার ইসলামপুর উপজেলার পশ্চিমে ৫টি ইউনিয়ন কুলকান্দি, বেলগাছা, চিনাডুলী, সাপধরী ও নোয়ারপাড়া ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে গেছে।

ভূঞাপুর (টাঙ্গাইল) থেকে আলীম আকন্দ জানান, টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরের যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে বন্যা পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অর্ধশতাধিক গ্রামের মানুষ। ক্ষতি হচ্ছে ফসল, কোনো কোনো গ্রামে দেখা দিয়েছে নদীভাঙন। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ। অনেক পরিবার বাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে বাঁধের ওপর।



 

Show all comments
  • Rubaid Samim ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৪:৩৪ এএম says : 0
    তোমার বাড়ি নদীতে গেছে তাতে সরকারের কি আসে যায়। ভালো লাগলে থাকো, না লাগলে পাকিস্তানে চলে যাও। কোনো কথা বলতে পারবা না। দেশে কোনো অরাজকতা সৃষ্টি করা যাবে না।
    Total Reply(0) Reply
  • Anisur Rahaman ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৪:৩৫ এএম says : 0
    মানুষের জন্য চিন্তা করার লোক নাই! হায় তাদের চিন্তা শুধু সুইস ব্যাংকে লুটপাটের টাকা রাখার!!
    Total Reply(0) Reply
  • Nazmul Hossen Raj ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৪:৩৬ এএম says : 0
    নদী ভাঙ্গন শুরু হলে তখন প্রশাসনের লোকজন ওখানে পিকনিক করার জন্য যায়। আর গিয়ে মুখস্থ যতো আশার বানী সেগুলো গড়গড় করে বলতে থাকে অমুক করা হচ্ছে ভাঙ্গন প্রতিরোধ করার জন্য হ্যান ত্যান আর কতো কি। ওখান যাওয়া-আসার সময় নিজ চোখে কতো বাড়িঘর দেখেছি এখন সেগুলো বিলীন। আর এরা বর্ষা মৌসুম শুরু হলে আসে বালুর বস্তা ফেলাতে।
    Total Reply(0) Reply
  • Md. Saiful Islam ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৪:৩৬ এএম says : 0
    নদী ভাংগনের কবলে যারা পড়ে, তারাই এ বোঝে এর নিদারুণ যন্ত্রণা। উপযুক্ত বাধ দিয়ে এর স্থায়ী সমাধান সম্ভব।
    Total Reply(0) Reply
  • Mahfuzur Rahman Khan ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৪:৩৭ এএম says : 0
    সত্যি এটি দুঃখ জনক,আসলে, ভাঙন,অথবা যে কোনো বিষয় হোক ঘটে যাওয়ার আগে, - যথাযথ ব্যবস্হাপনার মাধ্যমে,
    Total Reply(0) Reply
  • Sabbir Hossain ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৪:৩৭ এএম says : 0
    বর্ষাকাল এসে ভাঙন শুরু হলেই কেবল জিও ব্যাগ ফেলে দেখানোর চেষ্টা যে তারা কাজ করছে।অথচ শুকনো মৌসুমে কোন ব্যবস্থা নেওয়ার খবর নাই আর অবৈধ বালু উত্তোলন তো আছেই।
    Total Reply(0) Reply
  • Billal Hossen ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৪:৩৭ এএম says : 0
    বাংলাদেশের সবচেয়ে দূর্ণীতিগ্রস্থ প্রতিষ্ঠান পানি উন্নয়ন বোর্ড , এদের লাগাম টেনে না ধোরতে পারলে দেশের নদীভাঙন রোধ করা সম্ভব হবে না।।
    Total Reply(0) Reply
  • Nasreen Banu ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৪:৩৮ এএম says : 0
    হায়রে মানুষ। এতো দিনের গড়ে তোলা সংসার আজ নদী ভাঙ্গনে শেষ হয়ে গেল। এদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কি কেউ নেই ?
    Total Reply(0) Reply
  • Rimon Sarker ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৪:৩৮ এএম says : 0
    পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফিলতি । আর সরকারের সজাগ দৃষ্টি না থাকার ফলাফল , প্রতিবছর পানিতে গৃহহারা মানুষের আর্তনাদ ।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নদী

২৬ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ