Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ফেনীতে বন্যার কিছুটা উন্নতি, বেরিয়ে আসছে ক্ষতচিহ্ন রোপা আমনের ক্ষতির আশঙ্কা

ফেনী জেলা সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ২৮ আগস্ট, ২০২১, ১২:৫৭ পিএম

গত কয়েকদিন যাবত ভারতের উজানে অতিবৃষ্টি দেখা দিলে পাহাড়ী ঢলের পানি ফেনীর সীমানায় অবস্থিত ফুলগাজীর মুহুরী নদীতে প্রবেশ করতে থাকে। ফেনীতে বৃষ্টি না হওয়া স্বত্বেও নদীতে পানি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। গত বুধবার সকাল থেকে হঠাৎ নদীর পানি বিপৎসীমার ১৩ দশমিক ২০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে, পরে দুপুরের দিকে নদীতে পানি আরও বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ১৩ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকলে এক পর্যায়ে নদীর দুই তীরবর্তী বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের উপর দিয়ে পানি গড়ায়। ফলে ফুলগাজী বাজারের প্রতিরক্ষা গাইড ওয়ালের নিচ দিয়ে পানি প্রবেশ করে বাজারের ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান,দোকান পাট, রেস্টুরেন্ট ও ঔষুধের ফার্মেসী দোকানে পানি ডুকে পড়ে। মালামাল পানিতে ভিজে নষ্ট হওয়ার ফলে ব্যবসায়ীরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। পরে রাত ৮ টার দিকে ফুলগাজী সদর ইউনিয়নের জয়পুর এলাকায় নদীর বাঁধের পূর্বের ভাঙন স্থান (সংস্কার কাজ চলমান) পুনরায় পানির তীব্র ¯্রােতে ভেঙে যায়। ফলে রাতে পানি লোকালয়ে ডুকে পড়ে ৪ গ্রাম প্লাবিত হয়। ফুলগাজী-পরশুরামের আঞ্চলিক সড়ক ডুবে গিয়ে গাড়ি চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। বন্যার পানির নিচে ডুবে রয়েছে কৃষকের স্বপ্নের রোপা আমনের ক্ষেত,ভেসে গেছে অসংখ্য পুকুরের মাছ,রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গতকাল শুক্রবার থেকে মানুষের বাড়িঘর থেকে পানি নামতে শুরু করেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায় আজ নদীর পানি বিপৎসীমার ৯ দশমিক ৭০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি নেমে গেলে বাঁধ সংস্কারের কাজ শুরু হবে।
সরেজমিন পরিদর্শনে জানা যায়, গত জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলে মুহুরী নদীর বেড়িবাঁধের ৩ স্থানে ভাঙন দেখা দেয়। তখন ১০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছিল। পরে বাঁধ সংস্কার কাজের জন্য ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে ঠিকাদার নিয়োগ দেয়া হয়। গত দেড় মাস আগ থেকে তারা গত বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত তিনটি বাঁধের মেরামত কাজ করছিলেন । এর মধ্যে দুটি বাঁধ মেরামত কাজ শেষ করলেও জয়পুরে ভাঙা বাঁধটির সংস্কার কাজে গাফেলতি থাকায় এবং নিম্মমানের কাজ করায় বাঁধটি পুনরায় ভেঙে যায়।
স্থানীয়রা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান,জয়পুর এলাকায় মুহুরী নদীর বাঁধ ভরাটের কাজ খুব নিন্মমানের হয়েছে। শুরু থেকে তারা নদীর ভিতরে বাঁধের কাছ থেকে স্ক্যাবেটর দিয়ে বালি মিশ্রিত মাটি কেটে বাঁধ ভরাটের কাজ করে আসছিল। এলাকার কয়েকজন সচেতন নাগরিক নিম্মমানের কাজের প্রতিবাদ জানালে তাদেরকে বাঁধ সংশ্লিষ্ট মাটির ঠিকাদার জানান আপনারা যা বলার উপর মহলে বলেন আমাদেরকে কাজ করতে দিন। স্থানীয়রা আরও জানান,প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে মুহুরী নদীর বাঁধ ভাঙলে বন্যা পরবর্তী বাঁধ মেরামতের দায়িত্ব পান এ অঞ্চলের প্রভাবশালী ঠিকাদার বন্ধুয়ার কাসেম। সে ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের মনোনিত ঠিকাদার। তার বিরুদ্ধে অনেক অনিয়ম দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। তারা জানান, চলতি বছর বৃষ্টি কম হওয়ায় বাঁধের বাহিরে মাটি কাটার উপযোগী অনেক জমি ছিল। কিন্তু তিনি অন্যায় ভাবে নদীর ভিতরে বাঁধের খুব কাছ থেকে স্ক্যাবেটর মেশিন দিয়ে মাটি কেটে বাঁধ ভরটের কাজ করান। শুধু তাই নয় তিনি এর আগেও আরও অসংখ্য বাঁধ সংস্কারের কাজ করেছেন নিম্মমানের। তাঁর এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে সঠিক তদন্ত হওয়া দরকার বলে তারা মনে করেন। তাহলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে। এ বিষয়ে কাসেম ট্রেডার্সের স্বত্তাধিকারী আবুল কাসেম বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
এ অভিযোগের ভিত্তিতে ফেনী পাউবোর সাব-ডিবিশনাল ইঞ্জিনিয়ার আক্তার হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, গত জুলাই মাসে নদীর বাঁধের ভাঙন স্থান মেরামতের কাজ কাসেম ট্রেডার্সকে দেয়া হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সত্য নয়। আমরা সার্বক্ষনিক কাজের তদারকি করেছি। ঠিকাদার বাঁধের কাছ থেকে মাটি কাটেনি বরং বাঁধ থেকে ১০০ মিটার দুরুত্বে মাটি কেটে ভরাটের কাজ করেছেন। আমরা ভাঙনের দিন রাত পর্যন্ত সেখানে ছিলাম। তিনি বলেন, নদীর ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ সংস্কারের জন্য সরকারী ভাবে কোন বরাদ্দ হয়না। প্রাথমিক পর্যায়ে জরুরী ভিত্তিতে বাঁধ সংস্কার কাজের জন্য একটি লোকাল কমিটি করা হয়,পরে ঠিকাদার নিয়োগ দেয়ার পর কাজ শুরু হয়। এরপর কাজ শেষ হওয়ার পর ঢাকা থেকে একটি টিম এসে কাজের পরিমাপ দেখে টাকা বরাদ্দের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেন। পূর্বের তিনটি বাঁধ মেরামতের জন্য প্রাক্কলন ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪০ লাখ টাকা।

এদিকে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার আমন চাষীদের কপালে চিন্তার ভাজ লক্ষ্য করা গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকজন কৃষক জানান, তারা বিভিন্ন এনজিও থেকে চওড়া সুদে লোন নিয়ে এবার জমিতে আমনের চারা রোপন করেছেন। কিন্তু আকস্মিক বন্যায় তাদের স্বপ্ন চুরমার হতে চলেছে। তাদের অভিযোগ প্রতিবছর বন্যায় তাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়। এ ক্ষতি পূরণ করার ক্ষমতা তাদের নেই। খুব কষ্ট করে জীবন যাপন করতে হয়। তাদের দাবী নদীর টেকসই বাঁধ নির্মাণ করা হোক।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাসুদ রানা জানান, এ উপজেলায় চলতি মৌসুমে ৬ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়েছিল। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে আমনের চাষ হয়েছে ৬ হাজার ২৮০ হেক্টর ফসলি জমিতে। গত তিনদিন আগে আকস্মিক ভাবে মুহুরী নদীর বাঁধে ভাঙন দেখা দিলে এই এলাকায় প্রায় ১৫০-২০০ হেক্টর আমনের আবাদি জমি পানির নিচে ডুবে রয়েছে। তবে দুয়েকদিনের মধ্যে পানি না নামলে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন কৃষকরা।
ফুলগাজী সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বলেন, এ অঞ্চলের নদী ভাঙন এটি একটি জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবছর বর্ষামৌসুমে নদীর তীরবর্তী মানুষের দু:খ কষ্টের যেন শেষ থাকেনা। কোন প্রকারে নদীর বাঁধের ভাঙন ঠেকানো যাচ্ছেনা। তিনি বলেন, প্রতিবছর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন এ অঞ্চলের মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাদের ঘরবাড়ি, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষকের জমির ফসল ফলাদী,পুুকুরের মাছ,এলাকার রাস্তাঘাট। গত ৪০ বছর ধরে মানুষ এ কষ্ট সহ্য করে যাচ্ছে। এ অঞ্চলে সঠিক নদী শাসন জরুরী হয়ে পড়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বন্যা


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ