Inqilab Logo

সোমবার, ০৮ জুলাই ২০২৪, ২৪ আষাঢ় ১৪৩১, ০১ মুহাররম ১৪৪৬ হিজরী

শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষা ব্যবস্থা

প্রকাশের সময় : ৪ অক্টোবর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

আফতাব চৌধুরী
মানব জীবনের একমাত্র লক্ষ্য অন্ধকার থেকে আলোয়, অজ্ঞতা থেকে জ্ঞানের জগতে উত্তরণ। আর এই উত্তরণ ঘটাতে পারেন সমাজের শিক্ষক-শিক্ষিকারাই। তাই শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বলা হয় সামাজিক প্রগতির দিশারি। মানুষের জীবনকে পর্যালোচনা করলে আমরা তিনটি স্তর দেখতে পাই। সেই তিনটি স্তর হচ্ছে অর্জন, অভিব্যক্তি ও সৃষ্টি। ছাত্রজীবনে কোনো কিছু অর্জন করতে না পারলে শিক্ষকতা জীবনে তার অভিব্যক্তি কী করে ঘটবে? সৃষ্টি তো অনেক দূরের ব্যাপার। সৃজনশীল প্রতিভা ছাড়া সৃষ্টি তো অসম্ভব।
রবীন্দ্রনাথের কথাগুলো আজও প্রাসঙ্গিক। ‘ছেলেরা বুদ্ধি ও জিজ্ঞাসা লইয়া বিদ্যালয়ে প্রবেশ করিল আর বাহির হইল পঙ্গু মন এবং জ্ঞানের প্রতি বিতৃষ্ণা লইয়া। তার কারণ, এ শিক্ষা প্রণালী কলের প্রণালী। এতে মন খাটে না। এরূপ শিক্ষা প্রণালীতে আমাদের মন যে অপরিণত থাকিয়া যায়, বুদ্ধি যে সম্পূর্ণ স্ফূর্তি পায় না, সে কথা আমাদের স্বীকার করিতে হইবে।’ বিদ্যানিকেতন থেকে পঙ্গু মন এবং জ্ঞানের প্রতি বিতৃষ্ণা নিয়ে অনেকেই বৃহত্তর জীবনে প্রবেশ করেন এবং বিভিন্ন পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু জীবিকার জন্য যারা শিক্ষকতার মতো পবিত্রতম পেশাকে বেছে নেন, তারা সমাজ ও মানুষের কাছে নিঃসন্দেহে শ্রদ্ধার পাত্র। তবে শিক্ষক হতে হলে শিক্ষার প্রতি ভালোবাসা, অনুরাগ ও শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে। জীবন সংগ্রামে নিজ নিজ লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে অনেকেই শিক্ষকতার পথে এসেছেন। কিন্তু শিক্ষকতাকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারেননি।
আমাদের অনেকের ধারণা এরকম, স্কুল-কলেজ থেকে যে মূলধন নিয়ে এসেছি তা দিয়ে আমাদের জীবন চলে যাবে যা শিখেছি তা নির্ভুল। ওই ধারণা নিয়েই আমরা শিক্ষকতা করছি এবং পরবর্তীতে নিজেদের শিক্ষাবিদ বলে জাহির করার চেষ্টা করছি। বলতে বাধা নেই, পড়াশোনা না করলে বিষয়ের উপর দক্ষতা আসে না। আর দক্ষতা না এলে শুদ্ধ ও সঠিক শিক্ষাদান অসম্ভব। ছাত্রজীবনে যাদের পড়াশোনা সঠিক হয়নি বা যে ঘাটতিগুলো নিয়েই শিক্ষকতা করতে এসেছেন, তাদের তো অসুবিধা হবেই। গভীর অধ্যয়ন ছাড়া সেই ঘাটতিগুলো সহজে পূরণ হওয়ার নয়। প্রশিক্ষণ নিলে কিছু মেথড শেখা যায় কিন্তু দক্ষতা অর্জন হয় না। দক্ষতা অর্জনের জন্য পড়াশোনা ছাড়া বিকল্প পথ নেই। স্নাতক বা স্নাতকোত্তর হওয়ার পর আমরা যদি নিয়মিত পড়াশোনা না করি, তা হলে আমাদের স্মৃতি থেকে অনেক কিছুই মুছে যায়। বলা যায়- ‘The man who graduates today and stops learning tomorrow is uneducated the day after.’ কথাগুলো কতটুকু যথার্থ আমাদের মধ্যে যারা শিক্ষক তারা যদি নিজেদের আত্মপরীক্ষা বা আত্মসমালোচনা না করেন, তা হলে কথাগুলোর যথার্থতা উপলব্ধি করতে পারবে না।
শুধু বিষয় বস্তুর উপর দক্ষতা থাকলেই শিক্ষক হওয়া যায় না। সেই সঙ্গে চারিত্রিক সদগুণাবলি আর গতিময় ব্যক্তিত্বের অধিকারী হতে হয়। নতুবা ওইসব গুণের অভাবে অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকাকে আজকাল ছাত্রছাত্রীদের কাছে নানাভাবে অপদস্থ হতে হয়। আসলে ছাত্রছাত্রীর পড়াশোনা তখনই সম্ভব হয়, যখন শিক্ষক-অভিভাবক সচেতন থাকেন। শিক্ষক-অভিভাবক সচেতন থাকলে ছাত্রছাত্রীদের মনে পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ জাগবে এবং আগ্রহ থেকে মনোযোগ ও একাগ্রতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। আর তা না হলে শুধু শিক্ষকদের দোষী সাব্যস্ত করে কোনো লাভ হবে না। কারণ, শিক্ষক ওসমান গণী হাত দিয়ে আলী আহসানের মতো ছাত্র বেরিয়েছেন। ওই রকম দ্বিতীয় কোনো ছাত্র ওসমান গণী কিন্তু বের করতে পারেননি। শিক্ষাদানে শিক্ষকের ভূমিকা যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক না কেন, ছাত্রছাত্রীদের সফলতার পিছনে অভিভাবকদের সচেতনতা ও সংশ্লিষ্ট ছাত্রছাত্রীর মনঃসংযোগ ও মেধার প্রশ্ন জড়িত। বিশিষ্ট চিন্তাবিদদের মতে, ঘরই হচ্ছে শিক্ষার প্রধান আধার। প্রবাদ আছে ‘Home is the seminary of all other institutions’ তারপর আসবে শিক্ষকদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন। ফরাসি লেখক Alphonse Dauded-i ÔThe Last LessonÕ প্রবন্ধে শিক্ষক গ. Hamel তাঁর ছাত্র Franz পড়া যখন ঠিকমতো বলতে পারেনি তখন তিনি ভারাক্রান্ত হৃদয়ে Franz-কে বলেছিলেন, I won’t scold you,…. You are not the worst, poor little Franz. We’ve all a great deal to reproach ourselves with.
Your parents were not anxious enough to have you learn. They preferred to put you to work on a farm or at the mills, so as to have a little more money. And I? I’ve been to blame also. Have I not often sent you to water my flowers instead of learning your lessons? And when I wanted to go fishing, did I not just give you a holiday?
শিক্ষক গ. halmel-i কথা থেকে একটা জিনিস পরিষ্কার, ছাত্রছাত্রীদের পড়া শেখা বা না-শেখার পেছনে মূলত শিক্ষক ও অভিভাবকরাই দায়ী। তাছাড়া আরও অনেক কারণ আছে, যে কারণ আমরা অনেকেই অনুসন্ধান করি না। বিশেষ করে সরকারি স্কুলের ছাত্রছাত্রী যেসব পরবিার থেকে আসে, সেসব পরিবারের বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীর আর্থিক অবস্থা খারাপ। পরিবারের লোকসংখ্যাও বেশি। পেট ভরে সবাই ভাত খেতে পারে না। তাছাড়া তাদের বেশিরভাগ অভিভাবক নিরক্ষর। পড়া দেখিয়ে দেওয়ার মতো কেউ নেই। অর্থাৎ, স্কুল থেকে যা শিখে যায় ঘরে গিয়ে সেটা চর্চা করতে পারে না। ধীরে ধীরে ওইসব পরিবারের ছেলেমেয়ে পড়াশোনার দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকরা তাদের পড়াশোনা থেকে সরিয়ে নেন এবং সামান্য টাকা রোজগারের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত করেন। পক্ষান্তরে, সচ্ছল পরিবারের চিত্রটা একটু অন্যরকম। বেশিরভাগ মা-বাবা, শিক্ষকও সচেতন। পরিবারের সদস্য সংখ্যাও কম। ছেলেমেয়েদের পিছনে পড়াশোনার জন্য অনেক সময় দিতে পারেন। খেয়াল রাখেন ছাত্র পড়া ঠিকমতো শিখতে পারছে কিনা বা টিউটর সঠিকভাবে পড়াচ্ছেন কিনা। এখানেই ছাত্রদের ফলাফলের পার্থক্য গড়ে ওঠে। ওইসব অভিভাবকের একমাত্র উদ্দেশ্য পরীক্ষায় যেনতেন প্রকারে সর্বোচ্চ নম্বর লাভ করা এবং খবরের কাগজের প্রথম পাতায় ছবিসহ চলে আসা। বিষয়ের উপর কতটুকু বোধ বা জ্ঞান হলো, সেটা তাদের ভাববার বিষয় নয়, এবং প্রকৃতপক্ষে সেটা তারা চানও না। বর্তমানে বেশিরভাগ অভিভাবকের মানসিকতা প্রায় এ রকমই।
হুমায়ুন কবীর যখন এমএসসি-তে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছিলেন, তখন ওই পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড হয়েছিলেন আবুল ফজল। তাঁর পরিবারে সেদিন বিষাদের ছায়া নেমে এসেছিল কিনা তা জানি না। পরীক্ষায় মার্কস দিয়ে তাঁদের মেধা আমরা কখনও পরিমাপ করতে পারব না। কারণ, পরীক্ষার মার্ক মেধা নিরূপণ করার সত্যিকার মাপকাঠি নয়। ওই দুই স্মরণীয় ব্যক্তি শিক্ষার জগতে স্বমহিমায় আজও উজ্জ্বল। বর্তমান সময়ে ছাত্রছাত্রীর ব্যর্থতার জন্য কতিপয় অভিভাবক সরাসরি শিক্ষকদের দায়ী করে থাকেন। তাদের এক কথা, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকরা ছাত্রদের পড়ান না। আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, সব ছাত্রছাত্রী শ্রেণিকক্ষ থেকে সবকিছু সমানভাবে গ্রহণ করে নিয়ে যেতে পারে না। কারণ, Intelligent Quotient সবার সমান নয়। গরিব পরিবারের কিছু ছেলেমেয়ে প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও গৃহশিক্ষক ছাড়াই পরীক্ষায় ভালো ফল করে। অবশ্য দু’-একটা উদাহরণ দিয়ে পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়া বেশিসংখ্যক সাধারণ ছাত্রছাত্রীর সমস্যা সমাধান করা যায় না।
ছাত্রছাত্রীদের সফলতা ও ব্যর্থতার কারণ যাই হোক না কেন, কতিপয় অভিভাবক পরীক্ষায় পাশের ছাত্রের খাতা দেখে লিখে নিতে নিজের ছেলেমেয়েদের উৎসাহিত করতে যেমন লজ্জাবোধ করেন না, ঠিক তেমনই অনেক শিক্ষকও আছেন চেয়ারে বসে ছাত্রছাত্রীকে পরোক্ষভাবে পরীক্ষায় নকল করার জন্য প্ররোচিত করতেও দ্বিধাবোধ করেন না। মানুষ তো শিক্ষা চায়। এ কেমন শিক্ষা! শিক্ষিত হওয়ার জন্য আমরা আজ কোন পথে হাঁটছি-সত্যই ভাবতে লজ্জাবোধ হয়। এ লজ্জা সভ্য জগতের সবার। জ্ঞান, বোধ, মনুষ্যত্ব, বিবেক বিসর্জন দিয়ে পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাওয়ার তাগিদ ও অবৈধ পথে পার্থিব ধনসম্পদ, ঐশ্বর্য ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের মোহ আমাদের মন, চেতনা ও সুকুমার প্রবৃত্তিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিয়েছে। তা থেকে মুক্তির পথ কী? এক্ষেত্রে আমাদের সমস্যার মূলে যেতে হবে। অসুস্থ পরিবেশ, পড়াশোনার প্রতি অভিভাবকদের সচেতনতার অভাব, দরিদ্র এবং শিক্ষাব্যবস্থায় ত্রুটিপূর্ণ পাঠ্যপুস্তক, নৈতিক শিক্ষার অভাব আর কতিপয় শিক্ষকদের উদাসীনতা ও অক্ষমতা ইত্যাদি ছাত্রছাত্রীদের জন্য প্রধান অন্তরায়।
অন্তরায়গুলো দূর করতে হলে সমাজের সভ্য ও শিক্ষিত মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে সবকিছু মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। মাধ্যমিক অথবা উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। মনে রাখতে হবে, ধর্মীয় শিক্ষা ছাড়া মানুষের মানবিক গুণ বা নৈতিক চরিত্রের উন্নয়ন কোনভাবেই সম্ভব নয়। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত নির্ধারিত পাঠক্রমে জাতীয় মূল্যবোধের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় পাস-ফেল প্রথা চালু রেখে সঠিক মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় উপরের ক্লাসে প্রমোশন দিতে হবে। তা না হলে আগামী প্রজন্মের জন্য এক অশুভ বার্তা বহন করে আনবে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা।
এটা ঠিক, সভ্যতার বিকাশ অনেকটা রাষ্ট্রব্যবস্থা ও পরিচালকদের উপর নির্ভর করে। রাষ্ট্রপরিচালকেরা যদি মেধাবী না হন বা শিক্ষক-অভিভাবকদের চেয়ে তাদের মেধার মান যদি নিচে থাকে, তা হলে তার প্রভাব সমাজে কোনো না কোনোভাবে বিস্তার লাভ করবেই করবে। এর থেকে পরিত্রাপের উপায় নেই। আমাদের জীবনে অন্ধকার থেকে আলোয় আসার লক্ষ্য যদি থেকে থাকে, তা হলে বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন একান্তভাবে প্রয়োজন।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট।



 

Show all comments
  • মোঃ সাব্বির আহমেদ শিহাব ৩০ জুলাই, ২০২২, ৮:২৮ এএম says : 0
    খুব ভাল লাগল
    Total Reply(0) Reply
  • Fazlul Karim ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১১:১৮ এএম says : 0
    The more you read the more you learn. Well well begun is half done .A Teacher is a helper, so, I am a helper
    Total Reply(0) Reply
  • মোঃ সাব্বির আহমেদ শিহাব ৩০ জুলাই, ২০২২, ৮:২৮ এএম says : 0
    ভাল
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শিক্ষক

১৪ অক্টোবর, ২০২২
৫ অক্টোবর, ২০২২
৫ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন