বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
লোভ-লালসা মানুষের অন্তরের এক মারাত্মক ব্যাধি। লোভ ধ্বংস ডেকে আনে। সীমাহীন লোভ-লালসার দরুন মানুষের বিবেক-বুদ্ধি লোপ পায়। পরিচালিত হয় দুর্নীতি ও পাপের পথে। লোভ-লালসা হচ্ছে মানব চরিত্রের সর্বাধিক ক্ষতিকর রিপু। মানুষের মাঝে যখন তাকওয়া ও ইখলাসপূর্ণ ঈমানের স্বল্পতা দেখা দেয়, যখন সে পাপিষ্ট শয়তানের ওয়াসওয়াসায় পড়ে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়, তখনই জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষ প্রবৃত্তির এই অদৃশ্য শক্তিশালী চাহিদার শিকার হয়ে পড়ে। এ বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়ে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যা দিয়ে আল্লাহ তোমাদের কাউকে অপর কারো ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন, তোমরা তার লালসা করো না।’ (সূরা আন-নিসা: ৩২)।
পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম দ্ব›দ্ব ও হত্যার ঘটনাও এই কুপ্রবৃত্তি অতিলিপ্সার কারণেই ঘটেছিল। পৃথিবীতে মানুষ যত অনাসৃষ্টি করছে, তার অধিকাংশই লোভের বশবর্তী হয়েই করছে। অতিলোভের কারণেই মানুষ আজ বিবেকবর্জিত কাজ করছে, নিষ্ঠুর ও অত্যাচারী হচ্ছে, দুর্নীতিবাজ ও স্বার্থপর হচ্ছে। সুশিক্ষা ও সৎকর্মের বিস্তার রুদ্ধ হচ্ছে। মানুষ ধর্ম-কর্ম ভুলে, নাফরমান হয়ে, অশান্তি ও অস্বস্তিতে ভুগছে। আল্লাহ বলেন, ‘আমি তোমাদের জানিয়ে দেবো যে, শয়তান কার কাছে অবতরণ করে? তারা তো অবতরণ করে প্রত্যেক ঘোর মিথ্যাবাদী ও পাপীর কাছে।’ (সূরা শুয়ারা: ২২১, ২২২)।
সমীক্ষায় দেখা যায় যে, বেশিরভাগ সামাজিক অনাচারের পেছনে লোভ-লালসা ও কুপ্রবৃত্তির খারাপ প্রভাব রয়েছে। তাই পবিত্র কুরআনে এমন ঘৃণ্য লোভ-লালসাকে হারাম ঘোষণা করে ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি তোমার চক্ষুদ্বয় কখনো প্রসারিত করো না তার প্রতি, যা আমি তাদের বিভিন্ন শ্রেণিকে পার্থিব জীবনের সৌন্দর্যস্বরূপ উপভোগের উপকরণ হিসেবে দিয়েছি, এর দ্বারা তাদের পরীক্ষা করার জন্য; তোমার প্রতিপালকের প্রদত্ত জীবনোপকরণ উৎকৃষ্ট ও অধিক স্থায়ী।’ (সূরা ত্বাহা, আয়াত: ১৩১)। এ বিষয়ে বিশ্বনবী হুযুর পাক (সা.) এরশাদ করেন, ‘তোমরা লোভ-লালসা থেকে বেঁচে থাকো, কেননা এ জিনিসই তোমাদের পূর্ববর্তীদের ধ্বংস করেছে এবং পরস্পরকে রক্তপাত ঘটানোর ব্যাপারে উসকে দিয়েছে। লোভ-লালসার কারণেই তারা হারামকে হালাল সাব্যস্ত করেছে।’ (মুসলিম)।
লোভ-লালসা মানব চরিত্র গঠন ও সংশোধনের পথে অন্তরায়, দুশ্চিন্তা ও যন্ত্রণার উপকরণ। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ঈমান ও লোভ এক অন্তরে একত্র হতে পারে না। এর কারণ অত্যন্ত সুস্পষ্ট। কেননা, ঈমানের পরিণাম হচ্ছে ধৈর্য, সহনশীলতা ও অল্পে তুষ্ট থাকা। লোভ-লালসার পরিণাম অশান্তি, ধৈর্যহীনতা ও অস্বস্তিবোধ।’ (নাসাঈ ও তিরমিজি)।
লোভ-লালসা একটি মারাত্মক ব্যাধি। পাপিষ্ট শয়তানই এই অবৈধ প্রবৃত্তিকে মনুষ্য চরিত্রে লালন করতে ওয়াসওয়াসা দেয়। তাই মানুষের মধ্যে অনেকেই অজ্ঞতাবশত এই প্রবৃত্তির দাসত্বে আত্মসমর্পণ করে, বেখেয়ালে। এদের সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘তুমি কি দেখ না তাকে, যে তার কামনা-বাসনাকে ইলাহ রূপে গ্রহণ করে? তবুও কি তুমি তার কর্মবিধায়ক হবে? তুমি কি মনে করো যে, এদের অধিকাংশ শোনে ও বোঝে? এরা তো পশুর মতোই; বরং এরা অধিক পথভ্রষ্ট!’ (সূরা ফুরকান: ৪৩, ৪৪)।
মানুষের মাঝে যখন লোভ-লিপ্সা ভর করে, তখন সে বেশুমার নেয়ামতের অধিকারী হওয়া সত্তে¡ও হরহামেশা থাকে বেশোকর, অতৃপ্ত। যদি বৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনের পরও মানুষের মনে তৃপ্তি না আসে, তাহলে বুঝতে হবে সে লোভ-লালসার বশীভূত হয়ে পড়েছে। পবিত্র কুরআন বলছে, ‘একে অন্যের থেকে বেশি পাওয়ার লোভ বা প্রতিযোগিতা তোমাদের ভুলের মধ্যে ফেলে রেখেছে। এমনকি দুনিয়া পাওয়ার এ চিন্তা নিয়েই তোমরা কবরে পৌঁছে যাও।’(সূরা তাকাসুর: ১, ২)। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যদি কোনো মানুষের এক উপত্যকা ভরা স্বর্ণ থাকে, তবে সে তার জন্য দু’টি উপত্যকা (ভর্তি স্বর্ণ) হওয়ার আকাক্সক্ষা করে। তার মুখ মাটি ছাড়া (মৃত্যু) হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আর কিছুতেই ভরে না। আর যে ব্যক্তি তওবা করে, আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন।’ (সহিহ বোখারি)। অন্যত্র এরশাদ করেন, ‘দু’টি ক্ষুধার্ত নেকড়ে বাঘ ছাগলের পালে ছেড়ে দিলে যে ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, সম্মান লিপ্সা ও সম্পদের লোভ মানুষের দ্বীনের জন্য তার চেয়েও বেশি ক্ষতিকর।’ (তিরমিজি)।
লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। এই বহুল প্রচলিত প্রবাদ সম্পর্কে আমরা সবাই সম্যক অবগত। মানব চরিত্রের রিপুগুলোর মধ্যে লোভ-লালসা সর্বাধিক ক্ষতিকর। লোভকে পাপের আধার বলা যেতে পারে। কেননা লোভ মানুষকে পাপ কাজে নিয়োজিত হতে উদ্বুদ্ধ করে। মানবজীবনে লোভের পরিণাম পাপ আর সেই পাপের পরিণতি ধ্বংস। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ, ইদানিংকালে ঘটে যাওয়া শোবিজ জগতের কিছু তথাকথিত মডেল ও নায়িকাদের অশুভ পরিণাম। আর এই পরিণতির কারণ হলো নীতি-নৈতিকতা থেকে পদস্খলন, সীমাহীন উচ্চাকাক্সক্ষা-উচ্চাভিলাষ এবং উচ্ছৃঙ্খল, বেপরোয়া জীবনযাপন। আরেকটি অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় এখানে সতর্কতাস্বরূপ বলা যেতে পারে। বর্তমানে উচ্চাকাক্সক্ষা ও উচ্চাভিলাষের শিকার হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অসংখ্য অধিবাসী বোটযোগে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে নিজ জীবন হুমকির মুখে ফেলছে, কখনও কখনও মৃত্যুর সম্মুখীনও হচ্ছে। আর এসবই হচ্ছে অতিলোভের কুফল।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।