Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উলিপুর খাদ্য গুদামে ধান-গম দিলো ভুতুড়ে কৃষক

ভুয়া এনআইডি দিয়ে বিল উত্তোলন

কুড়িগ্রাম জেলা সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ১৮ আগস্ট, ২০২১, ৯:৪৫ এএম

কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুরে ভুতুড়ে কৃষকের কাছ থেকে চলতি বোরো মৌসুমে ধান-গম সংগ্রহ করার অভিযোগ উঠেছে। খাদ্য গুদামের কতিপয় কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী মিলে তৈরী হয়েছে সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট চক্রের মাধ্যমে লটারীতে নাম ওঠা প্রকৃত কৃষকের জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতি করে ধান-গম ক্রয় করে ৫৯লাখ ৯৬হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে উলিপুর খাদ্য গুদামের ইনচার্জ শাহীনুর রহমান। আর ব্যবসায়ীরা হাতিয়ে নিয়েছে কোটি টাকার লাভ। ফলে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান-গম ক্রয়ে সরকারের মহৎ উদ্দেশ্য ভেস্তেগেছে। এ ঘটনায় স্থানীয় ব্যবসায়ী ও কৃষকরা উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করলেও মেলেনি প্রতিকার। অনিয়ম ও দুর্নীতির সত্যতা নিশ্চিত করে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার দাবী তুলেছেন স্থানীয় সাংসদ অধ্যক্ষ এমএ মতিন

কুড়িগ্রাম-৩ আসনের সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ এমএ মতিন বলেন,আমাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করার কথা ছিল সেই চেষ্টা ওসিএলএসডি’র দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তা করেনি। তার অবহেলা আর অনিয়মের কারণে এখানকার বরাদ্দ ৫শ মে.টন ধান কেটে কুড়িগ্রাম এলএসডিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ফলে এখানকার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটি আমার জন্য অত্যন্ত অপমানকর কারণ আমি জনপ্রতিনিধি হয়েও তা জানতে পারিনি। এছাড়াও মৃত ব্যক্তিকে কৃষক দেখিয়ে ধান নেয়া হয়েছে। কৃষকের ভুয়া এনআইডি বানিয়েও ধান,গম সংগ্রহ করা হয়েছে। এছাড়াও অভিযোগ পেয়েছি ধানের পরিবর্তে চাউল দেখিয়ে ধানকে গোডাউনে রেখেই সেটাকে ডেলিভারি দেখিয়ে আবার ক্রাস করে চাউল হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। ধান, চাল, গম সংগ্রহে উৎকোচ গ্রহণেরও অভিযোগ রয়েছে। এই ধরনের অভিযোগ সরকারের বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র। সরকার চাচ্ছেন যারা কৃষক তাদেরকে সহযোগিতা করা এবং আমাদের খাদ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলা। কিন্তু কতিপয় কর্মকর্তা ও ব্যক্তির দুর্নীতির কারণে সরকারের ভালো উদ্দ্যোগ গুলো ম্লান হয়ে যাচ্ছে। একটি কুচক্রি মহল এবং কিছু সরকারি কর্মকর্তার যোগসাজসে সরকারকে ব্যর্থ এবং লক্ষ্য উদ্দেশ্য ব্যাহত করার জন্য এই কাজ গুলো করছেন তার তীব্র প্রতিবাদ জানাই এবং উর্দ্ধতন মহলকে অনুরোধ করবো সুষ্ঠু তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক।

কৃষক মোহসীন আলী, আকবর আলী, সাইফুল ইসলাম ও বাবুল লিখিত অভিযোগে বলেন, খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা শাহীনুর রহমান উলিপুরে যোগদানের পর থেকে সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে সীমাহীন দুর্নীতির মাধ্যমে চলতি বছরে বোরো ধান-চাল ও গম সংগ্রহের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। আর তাকে এ কাজে সহযোগীতা করার জন্য গড়ে তুলেছেন একটি সিন্ডিকেট চক্র। খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা শাহীনুর রহমানের যোগসাজশে মিল মালিক সমিতির আহবায়ক মাহফুজার রহমান বুলেট, সাবেক উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক হেমন্ত বর্মনের কথিত ভাগ্নে গাইবান্ধা জেলার বাসিন্দা সুমন মিয়া ও মিল মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি আব্দুল মজিদ হাড়ির ভাতিজা ধামেশ্রনী ইউনিয়নের স্বাস্থ্য সহকারী সরকারি চাকুরীজীবি মিজানুর রহমানসহ কয়েকজনকে নিয়ে সিন্ডিকেট চক্র গড়ে তুলেছেন। অভিযোগকারীদের তথ্য মতে, ওসিএলএসডি শাহিনুর রহমান প্রতি টন ধানে ২হাজার, গমে দেড় হাজার এবং চালে টন প্রতি ২হাজার টাকা উৎকোচ নেন। এ হিসাবে ধানে ৩০লাখ ৮৬হাজার টাকা, গমে ৪লাখ ১৭হাজার টাকা এবং চাল ক্রয়ে ২৪লাখ ৯০হাজার টাকা অর্থাৎ ৫৯লাখ ৯৩হাজার টাকা আয় করেন। তারা আরও বলেন, প্রকৃতপক্ষে ৬শ মে. টন ধান খাদ্য গুদামে মজুদ থাকলেও কাগজে কলমে ১৫শ ৪৩ মে. টন দেখানো হচ্ছে। বাকী ধান কয়েকটি মিলের সঙ্গে ছাটাইয়ের চুক্তি করে অগ্রিম বিল প্রদানের মাধ্যমে তাদের কাছ থেকে চাল সংগ্রহ করা হচ্ছে।

সিন্ডিকেট চক্রের সক্রিয় সদস্য মিল মালিক সমিতির আহবায়ক মাহফুজার রহমান বুলেটের নিজস্ব নামে কোন মিলের লাইসেন্স নেই। তিনি তার পিতার মালিকাধীন পৌরসভার নাড়িকেল বাড়ি গ্রামের সরকার চাল কলের প্রতিনিধিত্ব করেন। অপর সদস্য সুমন মিয়া কুড়িগ্রাম জেলার বাসিন্দা নন। তিনি পান্ডুল ইউনিয়নে থাকা চাঁন চাল কল, মালিক চাঁন মিয়ার মিল ভাড়ায় নিয়ে তার প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করেন। এছাড়া মিজানুর রহমান মেসার্স আছমত চাল কলের প্রতিনিধিত্ব করেন।
সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, ধান সংগ্রহের লটারীতে উপজেলার বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের ৯৬ নং ক্রমিকে পানাতিপাড়া গ্রামের ভেলু মামুদের ছেলে খেলু মামুদ নামে এক কৃষক গত ১৮ জুন উলিপুর খাদ্য গুদামে ১ মেঃ টন ধান দিয়ে বিল উত্তোলন করেছেন (গুদামের রেজিষ্ট্রারে ৪১২ নং ক্রমিকে বিল নম্বর-৫৫৫)। অথচ খেলু মামুদের স্ত্রী লতিফা বেওয়া দাবী করে বলেন, তার স্বামী চলতি বছরের ১৯ মার্চ মৃত্যুবরণ করেছেন। এদিকে ওই মৃত কৃষকের নাম ও পিতার নাম ঠিক রেখে জাতীয় পরিচয় পত্র নম্বরে ১২ সংখ্যা ব্যবহার করে ছবি, মাতার নাম, গ্রামের নাম পরিবর্তন করে ভূয়া জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করা হয়। এরপর ওই ভূয়া জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে সরকারি গুদামে ধান প্রদান ও বিল উত্তোলন করা হয়।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, উপজেলার বজরা ইউনিয়নে ৪ জন কৃষকের কাছ থেকে গত ১০ জুন ৪ মেঃ টন ধান সংগ্রহ দেখিয়ে ব্যাংক থেকে বিল উত্তোলন করা হয়েছে। তারা হলেন, মুন্সিপাড়া গ্রামের জব্বার আলীর ছেলে আলম মিয়া (বিল নং-২৯৪), মমফার আলীর ছেলে মনজু মিয়া (বিল নং-২৯৩), বাহার প্রধানের ছেলে আনোয়ার হোসেন (বিল নং-২৯২) এবং নাপিতপাড়া গ্রামের আব্বাস আলীর ছেলে মকবুল হোসেন (বিল নং-২৯১)। এই ইউনিয়নেও কৃষকের নাম ও পিতার নাম ঠিক রেখে জাতীয় পরিচয় পত্র নম্বরে ১২ সংখ্যা ব্যবহার করে ছবি, মাতার নাম, গ্রামের নাম পরিবর্তন করে ভূয়া জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করা হয়। এরপর ওইসব ভূয়া জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে সরকারি গুদামে ধান প্রদান ও বিল উত্তোলন করা হয়। বজরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম আমীন ওই ইউনিয়নে মুন্সিপাড়া ও নাপিতপাড়া নামে কাগজ কলমে কোন গ্রামের অস্তিত্ব নেই বলে নিশ্চিত করেছেন।
লটারীতে নাম থাকা ধামশ্রেণীর ইউনিয়নের ভদ্রপাড়ার গ্রামের কৃষক উপেন চন্দ্র বর্মন বলেন, আমি ৪০মণ ধান বিক্রি করেছি বাজারে। উলিপুর খাদ্য গুদামে কোন ধান দেই নাই। অথচ তার নাম ব্যবহার করে খাদ্য গুদামে ধান সংগ্রহ দেখিয়ে বিল উত্তোলনের মতো উদ্বেগজনক তথ্য প্রমাণ পাওয়াগেছে।।
জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম রাকিব জানান, ১২ সংখ্যা দিয়ে জাতীয় পরিচয় পত্র হয় না। ভোটার নং হয়ে থাকে। অভিযুক্ত জাতীয় পরিচয়পত্র গুলো পরীক্ষা করে দেখলাম। এ সব গুলোই ভূয়া।

উপজেলা খাদ্য গুদাম সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে প্রতি কেজি ২৭ টাকা দরে ২৬শ ৩৫ মে. টন ধান, প্রতি কেজি ২৮ টাকা দরে ২শ ৭৮ মে. টন গম ও প্রতি কেজি ৪০ টাকা দরে ১৪শ ৩৫ মে. টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়।

কিন্তু গুদাম কর্মকর্তা শাহীনুর রহমানের সীমাহীন দুর্নীতির কারণে ধান ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। ধান ক্রয়ের শেষ তারিখ ১৬ আগস্ট থাকলেও দুর্নীতি ও অনিয়মের কারনে বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ হলে ২ আগস্ট থেকে ধান সংগ্রহ বন্ধ হয়ে যায়। ২ আগস্ট পর্যন্ত ৯শ ৬২ জন কৃষকের কাছ থেকে মাত্র ১হাজার ৫৪৩ মে. টন ধান সংগ্রহ করা হয়। অপরদিকে জুন মাসে ২শ ৭৮ জন কৃষকের কাছ থেকে ২৭৮ মে. টন গম সংগ্রহ করা হয়। উপজেলার ৭২টি মিল মালিকের কাছ থেকে ১হাজার ৪৩৫ মে. টন চাল লক্ষ্যমাত্র থাকলেও সংগ্রহ হয়েছে ১হাজার ২৪৫ মে. টন। অভিযোগ রয়েছে, অধিকাংশ মিল মালিকের চাতাল গুলি পরিত্যক্ত। তারা গুদাম কর্মকর্তার সাথে যোগসাজশে গুদাম থেকে অগ্রিম বিল উত্তোলন করে বাহিরের জেলা থেকে চাল ক্রয় করে গুদামে সরবরাহ করেছেন।
মিল মালিক সমিতির আহবায়ক মাহফুজার রহমান বুলেটের সাথে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, নিউজ করেন আপনি। তবে আমি সাক্ষাতে বসে আলাপ করবো।

এই বিষয়ে ওসিএলএসডি শাহিনুর রহমানের বক্তব্য নিতে গেলে তিনি কয়েকজন ভাড়াটে লোক ডেকে এনে সাংবাদিকদের ছবি ও ভিডিও করতে বলেন। এসময় তিনি তথ্য দিলেও কোন বক্তব্য দিতে রাজি হননি। কথোপকথনের এক সময় তিনি বলেন, মিল চাতাল মালিকের সাথে চুক্তি বিষয়টি আমার দেখার বিষয় নয়। জাল এনআইডি,মৃত কৃষকের নিকট হতে ধান,গম সংগ্রহের বিষয়ে তিনি বলেন এটি মিথ্যা বানোয়াট। এগুলো হচ্ছে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার জন্য।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নূর-এ-জান্নাত রুমি জানান, অভিযোগ হাতে আসেনি। অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে আইনানুগ ব্যাবস্থা নেয়া হবে।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আবু বকর বলেন,জাল এনআইডি কিংবা ভূয়া কৃষকের নিকট হতে ধান,গম সংগ্রহের কোন লিখিত বা মৌখিক অভিযোগ পাইনি। পেলে বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়াও মিলচাতাল নিয়ে আমি মৌখিক একটি অভিযোগ পেয়েছিলাম। সামগ্রিক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের প্রেক্ষিতে মঙ্গলবার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: অভিযোগ


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ