Inqilab Logo

সোমবার ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পুঁজিবাজারে অস্থিরতা বাড়াবে

প্রতিদিন ব্যাংকের বিনিয়োগের তথ্য জানাতে বিবি’র চিঠি মাসিক ভিত্তিতে নেয়ার প্রস্তাব বিএমবিএ’র

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ১৭ আগস্ট, ২০২১, ১২:০০ এএম

 

অনিয়ম, দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনায় আর্থিকখাতের বিভিন্ন সূচকের নাজুক অবস্থা। দেশি-বিদেশী বিনিয়োগে ভাটা, রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় কমছে। তখন একমাত্র আশার আলো হয়ে রয়েছে দেশের শেয়ারবাজার। দীর্ঘদিনের অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা কাটিয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) আইনের শাসন এবং জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করায় পুঁজিবাজারে ক্রমান্বয়ে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। যার কারণে দীর্ঘদিন থেকে পুঁজিবাজার ঊর্ধ্বমুখী। বিএসইসি’র প্রচেস্টায় দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের উপযোগী বাজার তৈরির চেস্টা চলছে। বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে ফিরতে শুরু করেছেন। দীর্ঘদিন পর পুঁজিবাজার নিয়ে সবাই খুশি। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্পবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেছেন, গত এক বছর ধরে পুঁজিবাজারে নতুন ‘ধরন’ দেখছি। বিএসইসি চেয়ারম্যান প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামের নেতৃত্বাধীন নতুন কমিশন অনেকগুলো ভালো পদক্ষেপ নিয়েছে। এখানে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরেছে।
আর তখন ব্যাংক ও আর্থিকখাতের তদারকি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংক বিনিয়োগকারীদের কাছে ভুল বার্তা দিয়ে শেয়ারবাজারে আতঙ্ক বা অস্থিরতা তৈরির প্রচেষ্টা করছে। গত বৃহষ্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে সব ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের কাছে এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। এতে পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর নিজস্ব ও সাবসিডিয়ারি কোম্পানিসহ কোন খাতে অর্থ বিনিয়োগ করা হচ্ছে, সে তথ্য দৈনিক ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে প্রতিদিন বিকাল ৫টার মধ্যে ব্যাংকগুলোকে এ তথ্য জানাতে বলা হয়েছে। এই চিঠির পর থেকেই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শেয়ারবাজার নিয়ে এক ধরণের আতঙ্ক বিরাজ করছে।
এদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের তথ্য প্রতিদিন না নিয়ে মাসিক ভিত্তিতে নেয়ার প্রস্তাব জানিয়েছে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ) প্রেসিডেন্ট ছায়েদুর রহমান।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন পর পুঁজিবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরতে শুরু করেছে। বিশেষ করে ব্যাংক খাত ঘুরে দাড়াতে শুরু করেছে। এই সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ ধরণের অবাস্তব সিদ্ধান্তে পুঁজিবারের প্রতি মানুষের বিরুপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে। তাদের মতে, তদারকি ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে না পারায় দীর্ঘদিন থেকে বিপর্যস্ত দেশের ব্যাংক ও নন ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। দুর্নীতি-অনিয়মে দেশের প্রায় অর্ধেক ব্যাংকের ভিত্তি দুর্বল, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশই দেউলিয়ার পথে। সেদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নজর নেই। দেশের ব্যাংকিং প্রতিদিন ব্যাংকের কয়েক হাজার কোটি টাকার ট্রেড হয় যা কোনভাবেই দিনের মধ্যে প্রদান করা সম্ভব নয়। শেয়ারবাজারে থাকা ব্যাংকগুলোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নির্দেশ একটি ভুল বার্তা। তাই দ্রুত এ বার্তা পরিবর্তনের কথা জানিয়েছেন আর্থিকখাতের বিশ্লেষকরা।
অর্থনৈতিক রিপোর্টারদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, দীর্ঘদিন পর পুঁজিবাবাজারে ব্যাংকগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা ফিরেছে। নতুন করে বাংলাদেশ ব্যাংকের এই বার্তা পুঁজিবাজারে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। তিনি এই বার্তাকে প্রতিদিন না করে যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার কথা বলেন।
বিএসইসির কমিশনার প্রফেসর শেখ সামছুদ্দিন আহমেদ বলেছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে। আমরা কেউ কারও প্রতিযোগী নই; বরং সহায়ক ভ‚মিকা রাখলে দেশের অর্থনীতি ভালো হবে, কর্মসংস্থান বাড়বে। গত এক বছরে বিভিন্ন সংস্কারের ফলে পুঁজিবাজারে সাফল্য এসেছে, বিনিয়োগকারীদের আস্থাও বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকেরও উচিত ঋণ বিতরণ, প্রণোদনা, খেলাপিসহ বিভিন্ন কোর এরিয়ায় মনোযোগী হওয়া।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিশ্লেষক বাংলাদেশ ব্যাংকের সমালোচনা করে বলেন, শেয়ারাবাজারে ব্যাংকের ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের যে বিশেষ তহবিল, তা ঠিক আছে কিনা। ব্যাংকের মূলধনের পরিমাণ ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১৫ শতাংশ আছে কিনা, এসব তদারকি করার কথা থাকলে অযাচিত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যা শেয়ারবাজারকে আবার অস্থির করার চেষ্টা বলে উল্লেখ করেন তিনি।
আর্থিক খাতের এক বিশ্লেষক বলেন, ব্যাংক ও আর্থিক খাত নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না, অথচ শেয়ারাবাজারে ছড়ি ঘোড়ানের চেষ্টা। ঋণ জালিয়াতি, অর্থ পাচার ও নানা অনিয়মে জর্জরিত দেশের ব্যাংকিং খাতের এসব অনিয়ম রোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভ‚মিকা খুব একটা চোখে পড়ে না। এমনকি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান তদারকির দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও রয়েছে নানা অভিযোগ। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের কাজে ক্ষোভ জানিয়েছেন উচ্চ আদালত। আর তখন নিজেদের স্বাভাবিক কাজ বাদ দিয়ে দীর্ঘদিন পর উড়তে থাকা শেয়ারবাজারে নজর পড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। শেয়ারবাজারের স্বাভাবিক গতিকে বাধাগ্রস্ত করতে প্রতিদিন পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগের তথ্য চেয়ে ব্যাংকগুলোর কাছে দেয়া হয়েছে এই বার্তা বলে মনে করেন তিনি।
সূত্র মতে, জবাবদিহিতার অভাবে গত ১০ বছরেও বাংলাদেশের শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। বিশেষ করে ব্যাংকগুলোর অবস্থা ছিল খুবই নাজুক। তবে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) নতুন চেয়ারম্যান প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম এবং কমিশনাররা দায়িত্ব নেয়ার পর নানামুখী পদক্ষেপে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে। বাজারের বর্তমান চিত্রও তাই বলছে। দীর্ঘদিন পর বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজারে ফিরছে।
ব্যাংকগুলোতে পাঠানো চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, মুদ্রাবাজারে দৈনিক লেনদেনের তথ্য সংযুক্ত ছক অনুযায়ী পাঠাতে হবে। দৈনিক ভিত্তিতে বিকেল ৫টার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের অফসাইট সুপারভিশন বিভাগে এ তথ্য দিতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিদিনের নিজস্ব বিনিয়োগের তথ্য পাঠাতে হবে। যেখানে নতুন বিনিয়োগ, মোট বিক্রয়মূল্য (সেল ভ্যালু) ও নেট এক্সপোজার পাঠাতে হবে। প্রতিদিনের মার্জিন ঋণের পরিমাণ, স্থিতি ও সমন্বয় জানাতে হবে। এছাড়া নিজস্ব ও সাবসিডিয়ারিতে প্রতিদিনের ঋণসীমা, তহবিল ছাড়, তহবিল সমন্বয় এবং নেট এক্সপোজারের তথ্য দিতে হবে।
অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, করোনা সংক্রমণের প্রভাব মোকাবেলায় সরকারি প্রণোদনার আওতায় কম সুদের ঋণের একটি অংশ পুঁজিবাজার, জমি, ফ্ল্যাট কেনাসহ অনুৎপাদনশীল খাতে চলে যাওয়ার তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ কারণে গত ২৫ জুলাই সব ব্যাংককে চিঠি দিয়ে সতর্ক করা হয়। এছাড়া প্রণোদনার আওতায় ঋণের ব্যবহারসহ বিভিন্ন তথ্য চেয়ে পরবর্তী সময়ে আরো একটি চিঠি দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ঋণের সঠিক ব্যবহার যাচাইয়ের জন্য মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সর্বশেষ দৈনিক ভিত্তিতে মুদ্রাবাজারে লেনদেন ও বিনিয়োগের তথ্য সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের তথ্য প্রতিদিন না নিয়ে মাসিক ভিত্তিতে নেয়ার প্রস্তাব জানিয়েছে মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ)। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে চিঠি দিয়ে এ প্রস্তাব জানিয়েছে বিএমবিএ। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিএমবিএর প্রেসিডেন্ট ছায়েদুর রহমান। তিনি বলেন, আমরা লেনদেনের তথ্য দিতে প্রস্তুত। কিন্তু প্রতিদিনের ডাটা প্রতিদিন দেয়া সম্ভব না। এটা এই সময়ের মধ্যে প্রস্তুত করা যায় না। তাই আমরা মাসিক ভিত্তিতে তথ্য নেয়ার প্রস্তাব করেছি। তিনি বলেন, কিছুদিন ধরে আমাদের পুঁজিবাজার গ্রোয়িং মুডে আছে। পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের তথ্য প্রতিদিন দেয়ার নির্দেশনায় পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। পুঁজিবাজারের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবশ্যই পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনের সাথে আলোচনা করা উচিত।
চিঠিতে বলা হয়, প্রতিদিনের লেনদেনের ডাটা সঠিকভাবে বিকেল পাঁচটার মধ্যে দেয়া বাস্তবসম্মত নয়। প্রতিদিন লেনদেন শেষ হয় দুপুর ২টা ৪৫ মিনিটে। এর এক ঘণ্টা পর স্টক এক্সচেঞ্জগুলো লেনদেনের ডাটা তৈরি করে ব্রোকারেজ হাউসগুলোকে পাঠায়। এরপর ব্রোকার হাউসগুলো তথ্য যাচাই-বাছাই করে গ্রাহকদের কাছে পাঠায়। এরপর প্রকৃত তথ্যের ডাটা তৈরি করতে ৫টা থেকে ৬টা বাজে। তাই আমরা মনে করি, দৈনিক ভিত্তিতে ডাটা দেয়া বাস্তবসম্মত নয়। এমতাবস্থায় দৈনিকের পরিবর্তে মাসিক ভিত্তিতে লেনদেনের তথ্য নিলে কোনো প্রকার জটিলতা কিংবা আতঙ্ক হবে না।#



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পুঁজিবাজার

২৪ নভেম্বর, ২০২২
১০ নভেম্বর, ২০২২
১১ অক্টোবর, ২০২২
২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২
২২ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ