হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ

কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
আবদুল আউয়াল ঠাকুর
এদেশে দুর্নীতির ব্যাপ্তি কতটা তা বলে বোঝানোর কোনো প্রয়োজন নেই। এ জন্য কোনো গবেষণারও দরকার আছে বলে মনে হয় না, বরং কে বা কারা এর সাথে যুক্ত নয় তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে। তাহলে জনগণ দুর্নীতিমুক্তদের সম্পর্কে একটি ধারণা বা বিবরণ হয়তো পাবে। যদিও আজকের সমাজ বাস্তবতায় তাদের এ থেকে পুরস্কৃত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। উপরন্তু বিপদ আরো বাড়তে পারে। অর্থনীতির ভাষায় বলা হয়, ব্যাড মানি ড্রাইভস অ্যাওয়ে গুড মানি। মূল্যবোধের ভাষায় বলা হয়, সমাজে ভালো মানুষ খারাপ মানুষকে তাড়িয়ে দেয়। মনে করা হতো ফুলের সুবাসে মাটির ঢেলাও সুগন্ধিযুক্ত হয়। এখন অবস্থা দাঁড়িয়েছে তার উল্টো। দেখা যাচ্ছে সমাজে মন্দ মানুষের প্রভাব-প্রতিপত্তিতে ভালো মানুষের টিকে থাকাই দায় হয়ে পড়েছে। এই ভালো এবং মন্দের সুনির্দিষ্ট কারণ নির্নয় যেহেতু কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে তাই সব কিছু খোলসা করা হয়তো সম্ভব নয়। এতটুকু বলা যায়, সমাজ পীরামিডের শীর্ষ থেকে শুরু করে সর্ব নি¤œ পর্যন্তই এখন দুর্নীতিতে আচ্ছন্ন। দু-একটি ছোটখাটো উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। সাধারণত সমাজে ভিক্ষুকদের অবস্থানকে সর্বনি¤œ স্তরে বিবেচনা করা হয়। ভিক্ষা দিতে ইসলামে উদ্বুদ্ধ করা হলেও ভিক্ষাকে নিন্দনীয় বৈধ বলা হয়েছে। গত কিছু দিনে এই ভিক্ষাবৃত্তি নিয়ে যেসব বিবরণ দেখা যায় তাতে কারো পক্ষেই এটা বোঝা কষ্টকর নয় যে, ভিক্ষা এখন একটা লাভজনক পেশায় পরিণত হয়েছে। এই পেশাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এক বড় ধরনের সিন্ডিকেট। এখন যারা ভিক্ষা দেন তারাও কার্যত পরোক্ষভাবে এই চক্রকে সহযোগিতা করছেন। কারণ তারা ভিক্ষা দেন বলেই সমাজে এ পেশা টিকে রয়েছে। ভিক্ষা এখন কোনো কোনো ক্ষেত্রে জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ প্রসঙ্গে ছোট একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। ফার্মগেট এলাকায় পঙ্গু হাতের একজন ভিক্ষুককে একজন জিজ্ঞেস করেছিল, কাজ করতে অসুবিধা কোথায়? একটু দূরে গিয়ে একটা বাজে গালি দিয়ে সে বলল নিজেও ভিক্ষা দেবে না অন্যকেও দিতে দেবে না। আরেকজনের হাত ঝলসে গেছে। তার কাছে হাত ঝলসে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে সে অনেকটা যতমত খেয়ে বলল চুরি করতে গিয়ে তার এই দশা। নগরীর প্রায় সব রুটে এক ধরনের ভিক্ষুক দেখা যায় যারা অনেক দিন ধরে স্বামী, পিতা, মায়ের চিকিৎসার জন্য সাহায্যের নামে ভিক্ষা করছে। অন্যদিকে শবেবরাত, শবেকদর, প্রতি শুক্রবার নগরীর বিভিন্ন কবরস্থানে দেখা যায় সকাল থেকেই ভিক্ষুকদের জায়গা ভাগাভাগির কসরত। এরকম অনেক উদাহরণের পাশাপাশি এ ধরনের ছবিও প্রকাশিত হয়েছে যে, ভিক্ষুকের বাড়ি থেকে টাকার বস্তা পাওয়া গেছে। যাই হোক ভিক্ষুকের দুর্নীতি সমাজে বড় কোনো দুর্নীতি নয় বরং সেটা সমাজের উঁচু স্তরে চলমান দুর্নীতির চুইয়ে পড়া রূপ। যদি মনে করা হয় এসব দুর্নীতির সাথে আর্থসামাজিক বাস্তবতার কোনো সম্পর্ক রয়েছে তাহলে বোধকরি এ আলোচনার ব্যাপ্তি আরো কিছু দূর বেড়ে যাবে।
বিভিন্ন অফিস-আদালতে যারা কাজ করেন তাদের দুর্নীতি অনেকটাই দৃশ্যমান নয়। দৃশ্যমান নয় এ অর্থে যে, তারা কখনো স্বীকার করেন না এবং স্বীকার না করার জন্য কারো মুখোমুখি হন না। একটি উদাহরণ দেয়া যাক। বলা হয়, একজন রিকশা শ্রমিক সকালে রিকশা নিয়ে বেরুতেই সে হয় ট্রাফিক কনস্টেবলের মুখোমুখি। রিকশা আটক। অবশেষে কিছু দিয়ে চলে যাওয়ার জন্য দালালরা পরামর্শ দিলে একেবারে স্পষ্ট জবাব কেবলই বেরিয়েছি। হাতে একটা টাকাও নেই। শেষমেশ রফা হয় ঠিক আছে সকালবেলা খালি হাতে যাব। পীঠটা একটু চুলকিয়ে দাও। এখন যদি এই শ্রেণীর দুর্নীতি কথা আলোচনা করা যায় তাহলে বোধকরি দু-একদিনে বা দু-চার সপ্তাহ লিখে শেষ করা কঠিন হবে। এই শ্রেণীর দুর্নীতির নানা গল্প মুখে মুখে রয়েছে। মাঝেমধ্যে দু-একটা ধরা পড়লে তা নিয়ে বেশ তোলপাড় হলেও দু-একদিন পর সবশেষ। আবার যা তাই। এ থেকে কেউ শিক্ষা নিচ্ছে এমনটা মনে হওয়ার কোনো কারন নেই। তবে হাঁকডাক শোনা যায়। শেষ পর্যন্ত উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে ‘আইনের মানুষেরা’ ঠিকই বেঁচে যায়। এসব আলোচনা যে কেবল সাধারণ মানুষদের নিয়ে রয়েছে তা তো নয়, অনেক হোমরা-চোমরাও নাকি এসবের সাথে জড়িত। বলা হয়ে থাকে পদোন্নতি- বদলি- নিয়োগসহ নানা ব্যাপারেই নাকি এসব হয়ে থাকে। আইন অনুযায়ী বিভাগীয় তদন্ত হওয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত যা হওয়ার তা-ই হয়। হয়তো গুরু পাপে লঘু শাস্তি অথবা অন্য কিছু। পৃথিবীর কোথায় কী আছে সব কথা জানা নেই। আমাদের দেশে যারা মেধাবী, মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিকে কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল করে তারাই নাকি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হয়। এদের মধ্য থেকে যারা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে চাকরিতে নিয়োগ পায় তারাই দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পোস্টিং পেয়ে থাকে। বোধকরি ঘুষখোর নয় এমন একজন প্রকৌশলী সার্চ কমিটি করেও খুঁজে পাওয়া দায় হবে। সামর্থ্য না থাকলে প্রকৌশলে অধ্যয়ন করা সম্ভব নয়। তাহলে তারা কেন চাকরিতে গিয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। আর্থিক দুর্নীতির বিবেচনায় ভিক্ষুক আর এই শ্রেণীর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। কাজ না করে অথবা মানহীন কাজের সার্টিফিকেট দিতে গিয়েই এরা আর্থিক দুর্নীতি করছেন। এদের অধিকাংশেরই মুখে প্রায় একই কথা শোনা যাবে। দেখুন ভাই কি করব সবই বুঝি, ছেলেটার পড়ার খরচ, মেয়েটার বিয়ের খরচ ইত্যাদি জোগাতে গিয়েই এই-আর-কি। আর্থিক দুর্নীতির বিবেচনায় দেশের আমলাদের একসময়ে অনেকটাই সৎ মনে করা হতো। গত কিছু দিনে সেখানেও একই ধরনের দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হচ্ছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বছরওয়ারি দুর্নীতির যে তালিকা প্রকাশ করত তার সূচক তৈরি করা হতো পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত বিবরণ অনুযায়ী। এখন দেখা যাচ্ছে নানা আইনের খড়গে এ ধরনের খবর প্রকাশ করাই দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে। পরিস্থিতি কতটা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে তা প্রমাণিত হয় সরকারের একজন মন্ত্রীর কথাতেই। সরকারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এক আলোচনাতেই বলেছেন, আইনকানুন করেও দেশে দুর্নীতি কমানো যাচ্ছে না। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশ পরিস্থিতির কোনো হেরফের হয়নি। সংস্থাটি মনে করে বাংলাদেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতা এখনো উদ্বেগজনক। এ থেকে মনে করার কোনো কারণ নেই যে, দেশে চলমান ঘটমান দুর্নীতি কেবলই দেশের মানুষের মধ্যেই হচ্ছে। এসব দুর্নীতির সাথে আন্তর্জাতিক মহলও জড়িত। এখানে একটি মৌলিক বিষয় বলে রাখা দরকার যে, যারা মনে করেন বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক নিরাপত্তাবলয় না থাকার কারণেই অর্থিক দুর্নীতি হচ্ছে বা হতে পারছে তাদের এটা বিবেচনায় রাখা দরকার, সমাজে বড় ধরনের দুর্নীতির সাথে বিত্তবানরাই জড়িত। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যেসব দেশের নাগরিকদের আর্থিক নিরাপত্তা বলয় রয়েছে তারাও এ ধরনের দুর্নীতির সাথে জড়িত। এমন উদাহরণও রয়েছেÑ এক সরকারের আমলে দুর্নীতিমূলকভাবে চুক্তি করা হয়েছে, সরকার পরিবর্তনের পরেও ওইসব বিদেশি কোম্পানি তাদের অঙ্গীকারকৃত দুর্নীতির মূল্য বিদেশি ব্যাংকে পরিশোধ করেছে। এ ছাড়াও অর্থনৈতিকভাবে উন্নত অনেক দেশই কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে বা পাইয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে অবৈধ অর্থ ছিটান। সে বিবেচনায় যদি বাংলাদেশের দুর্নীতি-দুর্বৃৃত্তায়নকে বিবেচনায় নেয়া যায় তাহলে এর শেকড়, ডালপালা দেশের ভেতরেই নয়, বাইরেও পাওয়া যাবে।
সমাজ পীরামিডের চূড়ায় রয়েছে রাজনীতিবিদ। তারা দেশের মাথা। তারা দেশ পরিচালনা করেন। সকালের সূর্যকে যদি দিনের পূর্বাভাস বলা যায়, তাহলে একটি সমাজ কীভাবে চালিত হচ্ছে সেটা বোঝা যাবে রাজনীতিকদের দেখে। তাদের আচরণ- অভ্যাস- কর্মকা- সবকিছু মিলেই প্রতিভাত হবে দেশ ঠিকমতো চলছে কি চলছে না। বোধকরি আমাদের সমাজে দুর্নীতির আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুও তারাই। সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েই প্রতিবার প্রতিটি দল নির্বাচনের আগে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে। গত কয়েক বছরের এসব ইশতেহার যদি বিশ্লেষণ করা যায় তাহলে প্রতিটি দলের ঘোষণাতেই এটা পাওয়া যাবে। বাস্তবতা হচ্ছে, প্রতিবছরই দুর্নীতি বাড়ছে। বাড়ছে ঘুষের পরিমাণ। এ কারণে সমাজে সৃষ্টি হচ্ছে বৈষম্য। বাড়ছে অর্থনৈতিক ব্যবধান। এই দুর্নীতির সংক্ষিপ্ত পরিচয় হচ্ছে প্রভাবশালীদের দুর্নীতি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যারা ক্ষমতায় থাকছেন তারাও কিন্তু দুর্নীতিবাজদের গ্রেফতার করতে দৃঢ় অঙ্গীকার করেন এবং গ্রেফতারও করা হয়। বাস্তবতা হচ্ছে নিজের দলের কেউ দুর্নীতি করা হয় এটা স্বীকার করছে না। তাদের ভাষায় বিগত আমলে কী হয়েছে সেটা নিয়েই তাদের ভাবনা। গত কয়েক বছরে দেশের অনেক নীতিনির্ধারককে জড়িয়ে নানা ধরনের দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হয়েছে। এসবের মধ্যে মাদক থেকে শুরু করে নানা অপকর্মের প্রসঙ্গ রয়েছে। এদেরকে খুব একটা আইনের আওতায় আসতে হয়েছে এমন প্রমাণ পাওয়া ভার। অথচ সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করতেই একসময়ে গঠিত হয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন। যখন বিবেচিত হলো ব্যুরো দিয়ে সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করা সম্ভব নয় তখনই সমাজের সর্বস্তরে মানুষের আহ্বান ও আবেদনে সায় দিয়ে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করা হয়। জাতির দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এই কমিশন গঠনের পর দেশে রাজনৈতিক সরকারের পরিবর্তে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় থাকার ফলে এই কমিশন গঠনের মূল উদ্দেশ্যই ভ-ুল হয়ে যায়। উপরন্তু এই কমিশন দেশে বিরাজনীতিকরণের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। দেশের শীর্ষ রাজনীতিকদের এই সংস্থার করা মামলায় গ্রেফতার করা হয়। ফলে একটি স্বাধীন কমিশন যে মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে গঠন করা হয়েছিল, দেখা গেল, তা হীতে বিপরীত হয়ে গেছে। পরিস্থিতি আরো গুরুতর হয়ে গেছে। সমাজকে দুর্নীতিমুক্তকরার পরিবর্তে আরো বড় ধরনের দুর্নীতি সমাজকে আষ্টেপিষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। রাজনৈতিক বাধার মুখে অবশেষে সে বাস্তবতার অবসান হলেও আলোচ্য কমিশন নিয়ে বিতর্কের অবসান হয়নি বা হতে পারেনি। এই হতে না পারার একটি বড় কারণ আইনের সংস্কার। এ সম্পর্কে সাবেক একজন চেয়ারম্যান বলেছিলেন, দুদক এখন দন্তনকহীন বাঘে পরিণত হয়েছে। এই বাস্তবতায় এটা বিশ্লেষণ করার কোনো প্রয়োজন নেই যে, সমাজকে ব্যাপকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত করা বা দুর্নীতিবাজদের আড়াল করাই হয়তো এর পেছনের কারণ হয়ে থাকতে পারে। বোধকরি সমাজের বর্তমান চিত্রে হয়তো এ কথা অনেকেই স্বীকার করবেন একটি স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুপস্থিতিই এর প্রধান কারণ। সে সূত্র ধরে বলা যায়, অবশ্যই একটি স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন কার্যকরভাবে কাজ করতে পারলে হয়তো সমাজে দুর্নীতি সহনীয় পর্যায়ে আসত। এ কথা এ জন্য যে, অনেক হতাশার মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যানের বক্তব্য এবং কর্মপ্রক্রিয়া কিছুটা হলেও আশার সঞ্চার করেছে। তিনি ইতোমধ্যেই সমাজে বিদ্যমান অনেকগুলো দুর্নীতি সম্পর্কে মুখ খুলেছেন। কথার জন্য নয়, কারণ কথার ফুলঝুরি অনেকেই করছেন। বর্তমান চেয়ারম্যান কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন, যা বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে।
জনআকাক্সক্ষা অনুযায়ী একটি দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করা হলেও কার্যত প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরেই ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। সেই অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন শনাক্ত করেছে যে, অফিসের অন্তত পাঁচজন কর্মকর্তা এবং আটজন কর্মচারী দুর্নীতি ও নানা ধরনের অনিয়মের সাথে জড়িত রয়েছে। এই শনাক্তকরণকে অভিনন্দন জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, দুর্নীতি দমন কমিশন তাদের দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের কারণে জনগণের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে এই সংস্থার সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান একটি ইংরেজি দৈনিককে বলেছেন, শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া সংস্থার কর্মকা-কে এগিয়ে নেবে। তিনি মনে করেন ভালো কাজ পেতে হলে পুরস্কৃত করা এবং মন্দ কাজের জন্য সাজার ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। প্রকাশিত অন্যান্য খবরে বলা হয়েছে, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তুলনায় দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আর্থিক সচ্ছলতা বেশি। তাদের এত টাকা কোথা থেকে আসে, বেতনের বাইরে বাড়তি আয়ের পথ কী থাকতে পারেÑ এ প্রশ্ন তুলে ধরেছেন খোদ দুদকের এক কর্মকর্তা। দুর্নীতি দমন কমিশনের সেক্রেটারি আবু এম মুস্তফা কামাল জানিয়েছেন, সংস্থার তদন্তে কতিপয় কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে প্রাথমিক অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে। সন্দেহভাজনদের মধ্যে তিনজন উপ-পরিচালক, দুজন সহকারী পরিচালক, দুজন সহকারী পরিদর্শক, একজন ডাটা অন্তর্ভুক্তি অপারেটর, একজন পিয়ন এবং একজন নিরাপত্তা প্রহরী রয়েছে। এরা ঘুষ গ্রহণ, দুর্নীতিবাজদের নাম মুছে দেয়া, বদলি ঠেকাতে টাকা ও প্রভাবশালীদের কাজে লাগানোসহ অন্যান্য বেআইনি কাজ করেছেন। প্রকাশিত অন্য খবরে বলা হয়েছে, দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে একটি অভিযোগ অনুসন্ধানে গিয়ে অভিযুক্তের কাছ থেকে ৮ লাখ টাকা নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। চট্টগ্রাম অফিসের উপ-পরিচালক রইসউদ্দীনের বিরুদ্ধেও গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। এখনো চাকরিতে রয়েছেন এবং চাকরি থেকে অবসরে গিয়েছেন এমন অনেক কর্মকর্তাই দুর্নীতিবাজ হিসেবে পরিচিত। এটাও বলার অপেক্ষা রাখে না, যাদের নাম প্রকাশিত হয়েছে কেবলমাত্র তারাই এ ধরনের অপকর্মের সাথে জড়িত নাকি আরো কেউ কেউ রয়েছেন তা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত ছাড়া বলা সম্ভব নয়। একটি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের বিবেচনায় এ বাস্তবতা খুবই উদ্বেগজনক। যাদের দিয়ে সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করার কাজ করানো হবে তারাই যদি আকণ্ঠ দুর্নীতিগ্রস্ত থাকেন তা হলে সমাজ দুর্নীতিমুক্ত হবে কীভাবে? যে ধরনের অভিযোগের কথা বলা হয়েছে তা মূলত পুরনো। বর্তমানে এই সংস্থার ভূমিকা নিয়ে ভিন্নতর আলোচনা রয়েছে। এ কথাও সত্যি যে, সংস্থাটি সরকারি দলের অনেককে ডেকে ডেকে সাফাই সার্টিফিকেট দিয়েছে। অন্যদিকে অন্যদের বর্তমান চেয়ারম্যান যখন দুর্নীতি দমন কমিশনকে গতিশীল করতে চাচ্ছেন তখন তাকে অবশ্যই বিষয়টি সামগ্রিকতার বিবেচনাতেই দেখতে হবে। প্রথমত তাকে বিবেচনায় নিতে হবে সংস্থাটির নিরপেক্ষতাকে। কোনো বিবেচনাতেই যাতে কেউ হয়রানির শিকার না হন সেটি তাকে নিশ্চিত করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে ও মনিটরিং করতে হবে। দুর্নীতিবাজ এবং সুনির্দিষ্ট প্রমাণ থাকার পরেও যারা উৎকোচ দিয়ে এবং প্রভাব খাটিয়ে দায়মুক্ত হয়েছেন বা হওয়ার পথে রয়েছেন তাদের ব্যাপারে নির্মোহ হতে হবে। ভবিষ্যতে যাতে সংস্থায় দুর্নীতিবাজরা প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে উদাহরণযোগ্য সাজার ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যদিকে সংস্থাকে প্রভাবমুক্ত রাখার ব্যাপারেও সক্রিয় থাকতে হবে। এটা করা গেলে প্রকৃত বিবেচনায় যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ দুর্নীতির সাথে যুক্ত তাদের কাছে একটি বার্তা পৌঁছে যাবে, যা একটি সুস্থ সমাজ গঠনের অনুবর্তী হতে পারে।
একটি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনের ব্রত নিয়ে গঠিত দুর্নীতি দমন কমিশনকে দুর্নীতিমুক্ত করতে কমিশনের বর্তমান চেয়ানম্যান ইকবাল মাহমুদের উদ্যোগকে যারা দুর্নীতিমুক্ত সমাজ দেখতে চায় তারা অবশ্যই স্বাগত জানাবে। তিনি প্রমাণ করেছেন সদিচ্ছা এবং সাহস থাকলে কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টি কোনো অসম্ভব কিছু নয়। একজন দক্ষ আমলা হিসেবে এর আগেও তিনি স্বাক্ষর রেখেছেন। তার অভিজ্ঞতাও রয়েছে প্রচুর। তাকে কাজ করতে হবে চোখ-কান খোলা রেখে। সংস্থাটি ইতোমধ্যেই যাদের দুর্নীতিবাজ হিসেবে শনাক্ত করেছে তারা অনেক দিন থেকেই ঘাপটি মেরে ছিল। এদের কারণে অনেক নিরীহ নাগরিকও হয়রানির শিকার হয়েছে। এদের রয়েছে সংঘবদ্ধ চক্র। রাজনৈতিক হয়রানিতে সংস্থাটিকে ব্যবহারেরও গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্মকা-কে উচ্চতর আদালত অসাংবিধানিক বলে আখ্যায়িত করেছেন, সেই সরকারের করা আইনের আওতায় এই সংস্থার মামলায় এখনো হাজিরা দিচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ অনেকেই। বিদ্যমান বাস্তবতায় বর্তমান চেয়ারম্যান দায়িত্ব নেয়ার পর দুর্নীতি দমন কমিশন সম্পর্কে মানুষের মনে আশার সঞ্চার হয়েছে। সে আশা জাগিয়ে রাখাই সংশ্লিষ্টদের প্রধাণ দায়িত্ব। সেজন্যই সংস্থাটির ভূমিকা হতে হবে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হতে হবে সৎ ও দায়িত্বশীল।
সমাজে কখন দুর্নীতি প্রবেশ করেছে তা সুনির্দিষ্ট করা না গেলেও ভারতীয় উপমহাদেশের বেলায় এটা বলা যায়, ১৭৫৭ সালে পলাশীর আ¤্রকাননে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঘুষ প্রতারণা ও প্রবঞ্চনার মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে নেয়ার মধ্যেই রাজনীতি দুর্বৃত্তায়িত হয়েছে। চুরি করা মহাপাপ এ কথা এখন আর শিশুরা পড়ে না বরং বলা হয় চুরি বিদ্যা বড় বিদ্যা যদি না পড়ে ধরা। গোপনে গোপনে যে যা-ই করুক দলমত নির্বিশেষে জনত কিন্তু দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধেই । সকলেই প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা করেন। কার্যত জবাবদিহিতার অনুপস্থিতিতেই সমাজ দুর্বৃৃত্তায়িত হয়েছে। সমাজকে কখনো অপরাধমুক্ত করা বিদ্যমান বাস্তবতায় সম্ভব নয়। তবে সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসা কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। আজকের সময়ে সমাজকে দুর্নীতির কবল থেকে মুক্ত করা না গেলে সামাজিক অবক্ষয় রোধ করা অসম্ভব। সমাজকে সঠিক নিয়মে ফেরাতে দুর্নীতি দমন কমিশনের সাংবিধানিক ভূমিকা পালনের সুযোগ রয়েছে। তার এই ভূমিকা পালনে অটল থাকা সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
awalthakur@gmail.com
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।