বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
আরবী বার মাসের প্রথম মাস মুহাররম। এই মাসের ফজিলত ও মর্র্যাদা অনেক বেশি। এতদসম্পর্কে আল কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে : ‘আল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যা বারটি, আল্লাহর বিধান মোতাবেক যেদিন গগণমন্ডল ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, সেদিন থেকেই চারটি মাস সম্মানিত। এটাই স্থায়ী ব্যবস্থা, সুতরাং তোমরা এ সময়ে নিজেদের ওপর জুলুম করো না, আর তোমরাও সমবেতভাবে কাফেরদের সঙ্গে লড়াই করো, যেরূপ তারা তোমাদের সঙ্গে লড়াই করে। আর জেনে রেখো, আল্লাহ পরহেজগারদের সঙ্গে রয়েছেন।’ (সূরা তাওবাহ : ৩৬)।
এই আয়াতে কারিমার অর্থ ও মর্ম খুবই বিস্তৃত এবং সুদূরপ্রসারিত। নিম্নে এর কয়েকটি দিক সন্নিবেশ করা হলো : (ক) এই আয়াতের প্রথমেই বলা হয়েছে : নিশ্চয় আল্লাহ পাকের নিকট মাস গণনায় মাসের সংখ্যা হলো বারটি। এখানে উল্লেখিত ‘ইদ্দত’ শব্দের অর্থ হলো ‘গণনা’ আর ‘শুহুর’ শব্দটি হলো ‘শাহরুন’ শব্দের বহুবচন। এর অর্থ মাস। তারপর বলা হয়েছে, ‘ইন্দাল্লাহি’ অর্থাৎ আল্লাহর কাছে মাসের সংখ্যা বারটিই। এই সংখ্যাতাত্তি¡ক বিশ্লেষণের মর্ম হলো এই যে, আল্লাহ পাকের কাছে মাসের সংখ্যা হলো বারটি নির্ধারিত ও সুনির্দিষ্ট। এতে কমবেশি করার ক্ষমতা ও অধিকার কারো নেই।
(খ) তারপর বলা হয়েছে, ‘ফি কিতাবিল্লাহি’ অর্থাৎ আল্লাহর কিতাব বা বিধানে এরূপই স্থিরিকৃত হয়েছে। মোটকথা, রোজে আজলে সৃষ্টি প্রথম দিনেই তা লাওহে মাহফুজে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এই লিখন অপরিবর্তনীয়।
(গ) তারপর বলা হয়েছে, আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই। এতে একথার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে যে, রোজে আজলে এ বিষয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও এ মাসগুলোর গণণা ও ধারাবাহিকতা কার্যকর করা হয় নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের সৃষ্টি পরবর্তী মুহূর্ত থেকেই। কেননা, দিন-মাস-বছর গণনার বিষয়টি আসমান ও জমিনের নিয়মতান্ত্রিকতার সাথে বিজড়িত।
(ঘ) তারপর বলা হয়েছে : তন্মধ্যে চারটি মাস হলো ‘হুরুম’ অর্থাৎ নিষিদ্ধ বা সম্মানীত। আরবী ‘হুরুম’ শব্দটি তার উৎপত্তিগত দিক থেকে দু’টি অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই শব্দটি যদি ‘হারাম’ বা ‘হাররামা’ ক্রিয়া মূল হতে উৎপন্ন ধরা হয়, তাহলে তার অর্থ হবে নিষিদ্ধ। এতদর্থে, চারটি মাস হলো নিষিদ্ধ। অর্থাৎ এই চারটি মাসে যুদ্ধ বিগ্রহ ও রক্তপাত, দাঙ্গা-হাঙ্গামা নিষিদ্ধ বা হারাম। আর ‘হুরুম’ শব্দটির উৎপত্তি যদি ‘হুরমাতুন’ হতে ধরা হয়, তাহলে এর অর্থ হবে সম্মান ও মর্যাদা। এতে এর অর্থ দাঁড়াবে এই চারটি মাস অতীব সম্মানী ও বরকতময়। এ মাসগুলোর ইবাদতের সাওয়াব বহুগুণে বৃদ্ধি করে দেয়া হয়।
তবে নিষিদ্ধ বা হারাম শব্দটি ইসলামে রহিত ও মানসুখ করা হয়েছে। আয়াতের শেষাংশে বলে দেয়া হয়েছে যে, মুশরিকদের সাথে তোমরা সমবেতভাবে যুদ্ধ করো, যেমন তারাও তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে সমবেতভাবে। আক্রান্ত হলে, মুসলমাদের এ মাসগুলোতে যুদ্ধ করার অনুমতি আছে। তবে ‘হুরুম’ শব্দটির অর্থ হবে, সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শন এবং ইবাদত-বন্দেগিতে মগ্ন হওয়ায় হুকুমটি ইসলামে জারি রয়েছে এবং তা অব্যাহত থাকবে।
(ঙ) পিয়ারা নবী মোহাম্মাদুর রাসুললুল্লাহ (সা.) হিজরি দশম সালে বিদায় হজের প্রাক্কালে, মীনা প্রান্তরে প্রদত্ত খুতবায় চারটি সম্মানীত মাস চিহ্নিত করে বলেন : এর তিনটি মাস হলো ধারাবাহিক, যা পরপর আগমন করে। তা হলো- জিলক্বদ, জিলহজ ও মুহাররম। আর অপরটি হলো রজব। রজব শব্দটি উচ্চারণ করে রাসুলুল্লাহ (সা.) সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, রজব হলো জমাদিউস সানী ও শাবানের মধ্যবর্তী মাস। এ মাস সম্পর্কে অন্য কোনো রকম জল্পনা-কল্পনার অবকাশ আদৌ নেই।
(চ) তারপর বলা হয়েছে: এটিই হলো ‘সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান (দ্বীনুল কায়্যিম)। অর্থাৎ সম্মানীত মাসগুলোর ধাবাহিকতা নির্ধারণ এবং এগুলোর সাথে সম্পৃক্ত আল্লাহ পাকের হুকুম আহকামকে সৃষ্টি জগতের ঐশী নিয়মের সাথে চিরকাল সঙ্গতিপূর্ণ রাখাই হলো দ্বীনুল কায়্যিম বা সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। এতে কোনো মানুষের কমবেশি করা বা পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করার প্রয়াস চালালেও মূলত তার বিবেক-বিবেচনা অসুস্থ হওয়া ও মন্দ স্বভাব এবং দুর্দশাগ্রস্ত হওয়ারই আলামত বহন করে।
(ছ) তারপর এরশাদ হয়েছে : ‘সুতরাং তোমরা এ মাসগুলোতে নিজেদের ওপর জুলুম ও অবিচার করো না।’ অর্থাৎ এই সম্মানিত মাসগুলোর যথাযথ আদব-মর্যাদা ও ফজিলত উপলব্ধি না করে এবং এ মাসগুলোতে ইবাদত-বন্দেগিতে আত্মনিয়োগ না করে, অবহেলা ও অবজ্ঞার রোজাকে যারা ভারি করে তুলবে, তারা প্রকৃতই নিজেদের ক্ষতিসাধন করবে, এতে কোনওই সন্দেহ নেই। যে বা যারা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি সাধনে তৎপর হবে- তাদের মুক্তি, নিষ্কৃতি ও সফলতা লাভের আশা করা একান্ত বৃথা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।