বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির সেরা জীব। মানুষ কখনো বিচ্ছিন্নভাবে একা বসবাস করতে পারে না। সমাজবদ্ধভাবে থাকতে গেলে ক্ষমা, দয়া-মায়া ও ভালোবাসা থাকতে হয়। সমাজে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সহাবস্থানের জন্য সহনশীলতা ও সবর তথা ধৈর্য গুণটি অপরিহার্য।
একজন প্রকৃত মানুষের মাঝে যে বিশেষ গুণাবলি থাকা প্রয়োজন ‘সবর তথা ধৈর্য’ তার মধ্যে অন্যতম। সবর একজন শক্তিশালী মনের মানুষের প্রধান গুণ। ধৈর্য গুণটি মানুষকে সব বিপদ আর দূরাবস্থার মধ্যে আশা করার শক্তি যোগায়। যার মাঝে ধৈর্যের অভাব রয়েছে, সে আসলে পাপিষ্ঠ শয়তানের দলভুক্ত। কারণ, হাদীসের ভাষ্যমতে, ‘তাড়াহুড়া শয়তানের কাজ’। একজন মানুষের ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করার ক্ষমতা তার সামনে থেকে যে কোনো বাধাকে অপসারণ করতে পারে। যে কোনো কঠিন কাজকে সহজতর করে দেয় এই মহৎ গুণটি। ধৈর্য বা সবরের প্রয়োজনীয়তা বুঝার জন্য মহান রাব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনের অসংখ্য জায়গায় অগণিত আয়াত নাযিল করেছেন। সূরা আল-ইমরানের ২০০ নং আয়াতে মুমিনদেরকে ধৈর্য ধারণ ও ধৈর্যের প্রতিযোগিতা করার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য ধারণ করো, ধৈর্যের প্রতিযোগিতা করো এবং সুসম্পর্ক স্থাপনে আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রামে অবিচল থাক, আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো।’
ধৈর্যের গুরুত্ব সম্পর্কে সূরা আসরে আল্লাহ বলেন, ‘মহাকালের শপথ, মানুষ অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত; কিন্তু তারা নয়, যারা ইমান আনে ও সৎকর্ম করে এবং পরস্পরকে সত্যের উপদেশ দেয় ধৈর্যের উপদেশ দেয়।’ (আয়াত: ১-৩)। এই সূরার শেষে ধৈর্যকে সাফল্যের নিয়ামকরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ বলেন, ‘আমি (আল্লাহ) যখন আমার মুমিন বান্দার কোনো আপনজনকে মৃত্যু দিই, আর সে সবর করে, তখন আমার কাছে তার একমাত্র প্রতিদান হলো জান্নাত।’ (বুখারি)।
ধৈর্যশীলতা একটি কল্যাণকর গুণ। এই গুণটি অর্জন করার জন্য প্রয়োজন প্রবল ইচ্ছাশক্তির। তার সঙ্গে প্রয়োজন দৃঢ় ঈমান ও খালেস তাওয়াক্কুল। রাসূলুল্লাহ সা. একবার আনসারদের কিছু লোককে বললেন, ‘আর যে ব্যক্তি ধৈর্য ধরে তিনি (আল্লাহ) তাকে ধৈর্যশীলই রাখেন। আর যে অমুখাপেক্ষী হতে চায়, আল্লাহ তাকে অভাবমুক্ত রাখেন। ধৈর্যের চেয়ে বেশি প্রশস্ত ও কল্যাণকর কিছু কখনো তোমাদের দান করা হবে না।’ (বুখারি)।
ধৈর্য বা সবর শব্দের প্রকৃত অর্থ হলো কোনো উদ্দেশ্য অর্জন করতে অটলভাবে সমস্ত কিছু সহ্য করা। যে কোনো ধরনের বাধা-বিপত্তি, কষ্ট-যন্ত্রণায় হতাশ না হয়ে সুদৃঢ় থেকে সার্বিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। একাগ্রচিত্তে লক্ষ্যে অবিচল থাকাই হলো সবর। ধৈর্য বা সবর ইসলামের সৌন্দর্য। মানব চরিত্রের উত্তম গুণাবলির অন্যতম হলো সবর বা ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা। পবিত্র কোরআনে স্থানে স্থানে মহান আল্লাহ নিজেকে ধৈর্যশীল ও পরম সহিষ্ণু হিসেবে পরিচয় প্রদান করেছেন। বলেন, ‘এবং আল্লাহই তো সম্যক প্রজ্ঞাময়, পরম সহনশীল।’ (সূরা হজ, আয়াত: ৫৯)।
মানুষের ধৈর্য শক্তি বৃদ্ধির পেছনে ধর্মীয় জ্ঞান ও ইচ্ছাশক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখে। মহান রাব্বে কারীমের পক্ষ থেকে মানবজীবনে আপতিত বিপদাপদ ও বালা-মুসিবত মানুষের জন্য পরীক্ষাস্বরূপ। মহান আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত কোরআন মাজিদে বলেন, ‘আমি তোমাদিগকে অবশ্যই পরীক্ষা করব কিছু ভয়, ক্ষুধা এবং ধনসম্পদ, জীবন ও ফল-ফসলের ক্ষয়ক্ষতি দ্বারা। তুমি শুভ সংবাদ দাও ধৈর্যশীলগণকে যারা তাদের ওপর বিপদ আপতিত হলে বলে, ‘আমরা তো আল্লাহরই এবং নিশ্চিতভাবে তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তনকারী।’ (সূরা বাকারা : আয়াত ১৫৫-১৫৭)।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, মানবতার অগ্রদূত বিশ্বনবী হুযূর পাক (সা.) হলেন ধৈর্যের মূর্ত প্রতীক। নবুয়াত প্রাপ্তির পর যখন তিনি ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করলেন ঠিক তখনই জ্বলে উঠলো কাফেরদের জুলুম-অত্যাচার, ঠাট্টা-বিদ্রæপ, শারীরিক নির্যাতনের লেলিহান শিখা। শিষ্যদের ওপর নেমে আসে পৈশাচিক নির্যাতনের স্টিম রোলার, অনেকে শহীদও হয়েছেন। তিনি ও তাঁর পরিবারকে বয়কটের মতো দুঃসহ যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে। তায়েফে আঘাতে আঘাতে রক্তাক্ত হয়েছেন। এমন কোনো নিপীড়ন নেই যা মক্কী জীবনের ১৩ বছরে তাঁর উপরে চালানো হয়নি। শেষ পর্যন্ত নিজ জন্মভ‚মি থেকে হিজরত করেছেন। কিন্তু এক মহূর্তের জন্যও ধৈর্যচ্যুত হননি। কর্তব্য পালন করে গেছেন অটল অবিচল থেকে, পরম নিষ্ঠার সাথে। মদিনা হিজরতের পরেও তাঁর ওপর যুদ্ধের পর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে মক্কার কাফের-মুশরিকরা। তিনি পরম ধৈর্যের সাথে তার মোকাবিলা করেছেন। এর ফলশ্রæতিতে অবশেষে এসেছে ফতহে মুবিন-মক্কা বিজয়।
মহান আল্লাহ তায়া’লা তাঁর প্রিয় হাবীব (সা.) কে সবরের নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘হে নবী! সেভাবে ধৈর্য অবলম্বন করুন, যেভাবে উচ্চ সংকল্প সম্পন্ন রাসূলগণ করেছেন। আর এই লোকদের ব্যাপারে তাড়াহুড়া করবেন না।’ (সূরা আহকাফ : আয়াত ৩৫) অন্যত্র এরশাদ হয়েছে, ‘হে মুহাম্মদ! সা. আপনার পূর্বেও অসংখ্য রাসূলকে অমান্য করা হয়েছে। কিন্তু এই অস্বীকৃতি ও যাবতীয় জ্বালাতন নির্যাতনের মোকাবেলায় তাঁরা ধৈর্য অবলম্বন করেছেন। অবশেষে তাঁদের প্রতি আমার সাহায্য এসে পৌঁছেছে সুতরাং আপনিও ধৈর্য অবলম্বন করুন।’ (সূরা আনয়াম : আয়াত ৩৪)।
মানুষ স্বভাবতই সুখে, উল্লাসে আল্লাহকে ডাকে, স্মরণ করে। কিন্তু যখন সীমাহীন কষ্ট, বালা-মুসিবত, বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয় তখন সে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে সক্ষম কি-না এটাই আল্লাহ তায়া’লা দেখতে চান। এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ সা. বলেন, ‘আল্লাহ যার কল্যাণ চান তাকে বিপদে আক্রান্ত করেন।’ (বুখারি)।
অন্য হাদিসে আরও স্পষ্টভাবে এরশাদ করেন, ‘আল্লাহ যখন তাঁর বান্দার কল্যাণ চান তখন দুনিয়াতে তার শাস্তি ত্বরান্বিত করেন, আর যখন কোনো বান্দার অকল্যাণ চান তখন তার পাপগুলো রেখে দিয়ে কিয়ামতের দিন তার প্রাপ্য পূর্ণ করে দেন।’ (তিরমিজি)।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।