বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
হজরত আবু হোরায়রা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, হজরত রাসূলে করিম (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘ধর্ম অতি সহজ ও সরল, যদি কেউ কঠোরভাবে ধর্মের ওপর গালেব (জয়ী) হতে চায় তা কস্মিনকালেও সে পারবে না, বরং ধর্মই তাকে পরাজিত করে ফেলবে। অতএব, (তুমি) সরল পথে চলবে, মাঝামাঝি পথের অনুসরণ করবে, সুসংবাদ গ্রহণ করবে এবং সকাল, বিকাল ও রাত্রের কিছু অংশ (আল্লাহর কাছে) সাহায্য প্রার্থনা করবে।’ (বোখারী) ‘ধর্ম সহজ ও সরল’ হুজুর (সা.) এর এই উক্তির অর্থ ঈমান ও ইসলাম উভয়ই হতে পারে। অন্তরে তওহীদ ও রেসালাতের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করার নাম ঈমান এবং ‘এতাআত’ বা আনুগত্য স্বীকার করার নাম ইসলাম। অর্থাৎ ইসলাম বলতে শরীয়তের সমস্ত ‘আহকাম’ পালন করাকেই বুঝায়। হাদীস বিশারদগণ বলেন যে, উপরে বর্ণিত হাদীসে ধর্ম (দীন) অর্থে ঈমান ও ইসলাম উভয়ই বুঝানো হয়েছে।
এখন ঈমান ও ইসলাম- এই দুই শব্দের সরলতার প্রতি লক্ষ করা যাক। প্রথমে ‘ঈমান সহজ’ এই কথার তাৎপর্য অনুধাবন করা আবশ্যক। এই সম্বন্ধে ‘জারিয়ার’ হাদীসটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। একদা নবী করিম (সা.) জনৈকা দাসীকে (জারিয়া) জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আল্লাহ তাআলা কোথায় অবস্থান করছেন?’ সে উত্তর করল, ‘আকাশে।’ হুজুর (সা.) আবার প্রশ্ন করলেন, ‘আমি কে?’ দাসী বলল, ‘আপনি আল্লাহর রসূল।’ এরপর হুজুর (সা.) তার মনিবকে নির্দেশ দান করলেন, ‘দাসীটিকে আজাদ করে দাও, সে মোমেনা’ (তওহীদ ও রেসালাতের ওপর বিশ্বাস করেছে)। এখানে ভেবে দেখার বিষয় এই যে, দাসীটির এ সংক্ষিপ্ত উত্তরে হুজুর তাকে ‘মোমেনা’ বলে আখ্যায়িত করেন। সুতরাং প্রমাণিত হচ্ছে যে, ঈমানের জন্য যখন এইটুকু স্বীকারোক্তিকে (জারিয়ার হাদীসে বর্ণিত) যথেষ্ট মনে করা হয়েছে তখন নিশ্চিতরূপে বলা যায়, বাস্তবিকই ঈমান সহজ ও সরল।
‘ইসলাম সহজ’-এ কথার তাৎপর্যও হজরত জেমাম ইবনে ছা’লবা (রা.) কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীস হতে উপলব্ধি করা যেতে পারে। জেমাম (রা.) হুজুর (সা.)-কে ইসলাম সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলে তিনি এরশাদ করলেন, ‘দিবা-রাত্রি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা।’ তিনি (জেমাম) জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এটা ব্যতীত আমার ওপর কি অতিরিক্ত আরো নামাজ আছে?’ হুজুর (সা.) বললেন, ‘না, তবে ইচ্ছা করলে তুমি অতিরিক্ত নামাজ পড়তে পারো।’ অতঃপর হুজুর (সা.) বললেন, ‘মাহে রমজানের রোজা রাখা।’ জেমাম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এটা ব্যতীত আমাকে কি অতিরিক্ত রোজা রাখতে হবে?’ হুজুর (সা.) বললেন, ‘না, তবে তুমি ইচ্ছা করলে রাখতেও পারো।’ তিনি আবার বললেন, ‘যাকাত আদায় করা।’ জেমাম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এটা ব্যতীত আমার ওপর আরো কি সদকা আছে?’ হুজুর (সা.) বললেন, ‘না, তবে তুমি ইচ্ছা করলে দান করতে পারো।’ অপর বর্ণনায় হজের উল্লেখও আছে। বর্ণনাকারী বলেন, অতঃপর উক্ত ব্যক্তি (জেমাম) এই বলতে বলতে চলে যান যে, ‘আল্লাহর কসম, আমি এটার অতিরিক্তও করব না, কমও করব না।’ একথা শ্রবণ করে হুজুর বললেন: ‘এই ব্যক্তি যদি তার কথায় সত্যবাদী হয় তাহলে সে কল্যাণপ্রাপ্ত হলো এবং এইরূপ ব্যক্তি আখেরাতে লক্ষ্যস্থলে পৌঁছাতে পারবে।’ ইসলামের জন্য যখন কেউ এই পরিমাণ কাজ ও স্বীকারোক্তিকে যথেষ্ট মনে করে তাকে কল্যাণ প্রাপ্ত বলে আখ্যায়িত করেছেন, তখন ইসলাম যে সহজ ও সরল তাই প্রমাণিত হচ্ছে।
এখানে এটাও স্পষ্ট হয়ে গেল যে, সকল লোক বিশেষত ওয়ায়েজ বা বক্তৃতাদানকারী মৌলবী সাহেবান ধর্মকে জনসাধারণের কাছে সহজ ও সরলভাবে পেশ না করে একে জটিল ও কষ্টকর হিসেবে প্রচার করেন, অন্তত তাদের পক্ষে এ সব ঘটনা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তবে এর অর্থ এই নয় যে, ধর্ম বলতে নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত ইত্যাদি ব্যতীত অন্য কোনো হুকুম এতে নেই। কেননা, এটা কেউই অস্বীকার করতে পারবে না যে, নামাজ পড়তে হলে প্রথমে অজুর প্রয়োজন এবং পবিত্রতা অপবিত্রতার মাসলা-মাসায়েলও অবগত হওয়া একান্ত আবশ্যক। তাছাড়া হারাম উপার্জনের পোশাক দ্বারা নামাজ আদায় করলে তাতে নামাজ আদায় হয় না। এরূপে হজ ও যাকাত বিত্তশালী-মালদার ব্যক্তিদের ওপর ফরজ। তাই সে সম্বন্ধেও যাবতীয় মাসলা জেনে রাখা বিশেষ প্রয়োজন। কিন্তু এগুলি অবগত হওয়া খুব কঠিন ব্যাপার নয়। আলেমগণের নিকট হতে এগুলো সহজেই অবগত হওয়া যায়। যদি এসব কাজকে জটিল বলা হয় তবে দুনিয়ায় এমন কোনো কাজ নেই যাকে সহজ বলা যেতে পারে, বরঞ্চ দুনিয়াদারী করা আরও কঠিন কাজ।
ইসলামের ভিত্তি যে পাঁচটি জিনিসের ওপর স্থাপিত, মূলত ঐগুলোর মধ্যেই ধর্ম বিদ্যমান। পূর্ণ বিশ্বাসের সাথে নামাজ, রোজা হজ, যাকাত নিয়মিত ও যথাযথভাবে পালন করলে একদিকে যেমন আল্লাহর আনুগত্য স্বীকার করা হয় এবং তাঁর নৈকট্য লাভের আশা করা যায়, অপরপক্ষে নৈতিক ও চারিত্রিক উন্নতি সাধন করাও সম্ভব। এতদ্ব্যতীত আমরা নিজেদের অন্তরকেও কুলষমুক্ত করে এতে পবিত্রতা আনয়ন করতে পারি। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, আমরা আল্লাহ ও রাসূলের আদিষ্ট আহকাম পর্যন্ত ঠিকমত কিছুই পালন করতে অভ্যস্ত নই। ফলে আমাদের মধ্যে ভাবধারা প্রবল হতে পারে না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।