হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
কামরুল হাসান দর্পণ : বহুদিন ধরেই দেশে সুষ্ঠু রাজনীতি অনুপস্থিত। সুষ্ঠু রাজনীতি বলতে সেই রাজনীতিকে বুঝায়, যে রাজনীতিতে জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকে। সরকার ও বিরোধী দল একে অপরের ভুলভ্রান্তি, ত্রুটি-বিচ্যুতি তুলে ধরে সমালোচনা করবে এবং জাতীয় স্বার্থে একমত পোষণ করবে। সংসদে কার্যকর বিরোধী দল থাকবে এবং তারা সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের সমালোচনা ও প্রতিবাদ করবে। জনসাধারণের বিভিন্ন স্বার্থ, সমস্যা ও দাবি-দাওয়া নিয়ে রাজপথেও মিছিল-মিটিং করবে। জনগণও পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তুলবে। ক্ষমতাসীন দলের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কারণে বিরোধী দল একটু ব্যাকফুটে থাকবে, সুযোগ-সুবিধা কম পাবে। ক্ষমতাসীন দল একচেটিয়া দাবড়ে বেড়াবে না। ক্ষমতার একটা চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স থাকবে। স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর এ ধারায়ই আমাদের দেশের রাজনীতি প্রচলিত ছিল। এ ধারা সুষ্ঠু ছিল কি ছিল না, এ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও সচেতন মহল তা মেনে নিয়ে শোধরানোর নানা পরামর্শ দিতেন। রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের কথা বলতেন। এ ধারাটা মোটামুটি ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত চলে আসছিল। তারপর থেকেই রাজনীতির চেহারা বদলে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত রাজনীতি অনেকটা উধাও হয়ে গেছে। সংসদের বাইরের বিরোধী দল থেকে শুরু করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেককে বলতে শোনা যায়, দেশে বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া চলছে। তাদের অভিযোগ ক্ষমতাসীন দলের একচেটিয়া আধিপত্য এবং ধমকের রাজনীতির কারণে বিরোধী দলের রাজনীতি করার সুযোগ এক প্রকার নিঃশেষ হয়ে গেছে। বৃহত্তম বিরোধী দলের অভিযোগ, তাদের রাজনীতি করতে দেয়া হচ্ছে না। সরকার তাদেরকে মেরেকেটে একাকার করে ফেলছে। রাস্তায় নামতে দেয়া দূরে থাক ঘরেও রাজনীতি করতে দিচ্ছে না। বিরোধী দলের এ অভিযোগের ভিত্তিতেই হোক বা ক্ষমতাসীন দলের কঠোরভাবে শাসনের কারণেই হোক, দেশে যে এক ধরনের রাজনীতিহীন পরিবেশ চলছে, তা সচেতন মানুষ মাত্রই উপলব্ধি করছেন। অবশ্য বিরাজনীতিকরণের এ অভিযোগ ক্ষমতাসীন দল থেকে জোরালোভাবে অস্বীকারও করা হয় না। তার কথাবার্তা ও আচার-আচরণে এ মনোভাবই প্রকাশিত হয় যে, যেটুকু রাজনীতি করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে, তাই যথেষ্ট। এর বেশি রাজনীতি করার দরকার নেই। সাধারণ মানুষও সরকারের এ বার্তা বুঝতে পারে। ফলে তারা এখন আর আগের মতো রাজনীতি নিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হয় না। রাজনীতির প্রতি তারা বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছে। এর একটা কারণ হচ্ছে, ভয়। ভয়টা মূলত ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে। তাদের কঠোর শাসন-বারণের কারণে সাহস করে কেউ উচ্চকণ্ঠ হতে চায় না। কারণ একটি বৃহৎ বিরোধী দলকে কীভাবে চিড়েচ্যাপ্টা করে ফেলা যায় এবং দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত কীভাবে হেনস্থা ও দৌড়ের ওপর রাখা যায়, তাদের সামনে এ দৃষ্টান্ত রয়েছে। এ বিবেচনায় সাধারণ মানুষ তো নস্যি। কেউ কিছু বলতে গেলেই দেখা যাবে পিঠে এসে কিল-কনুই পড়ছে। কাজেই এখন পিঠ বাঁচিয়ে চলাই তাদের মূল কাজ হয়ে পড়েছে। আপনি বাঁচলে বাপের নাম, প্রবাদটি তারা ভালোভাবেই মেনে চলছে। ক্ষমতাসীন দল তো বুঝিয়েই দিচ্ছে, রাজনীতি নিয়ে তোমাদের মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই। তোমাদের উন্নতির জন্য সরকার যা করার দরকার তার সবই করছে। দেশ তরতর করে উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কাজেই এত রাজনীতি করার দরকার কি! চুপচাপ বসে থাক! সুখে থাকতে কি ভূতে কিলায়? জনসাধারণের সামনে যখন এমন বুঝ তুলে ধরা হয়, তখন কার সাধ্য, সমালোচনার তীরটি সরকারের দিকে তাক করে? যেখানে রাজনীতিকে ডা-া মেরে ঠা-া করা হয়, সেখানে রাজনীতি নিয়ে সাধারণ মানুষের আলোচনা করার কোনো কারণ থাকতে পারে না।
দুই.
আমাদের দেশের মানুষের স্বভাবই হচ্ছে খেয়ে হোক না খেয়ে হোক রাজনীতি নিয়ে আলাপ করা, কথা বলা। কেউ আলাপ করলে কাজ ফেলে সেখানে কান দেয়া। আলোচনা মনঃপূত হলে মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়া, না হলে তর্কে জড়িয়ে পড়া। তারা ডেমোক্রেসির জনক এথেন্সের ক্লিসথেনিসের নাম বা পরবর্তীতে বিশ্বখ্যাত মনীষীদের দেয়া ডেমোক্রেসির সংজ্ঞা জানা দূরে থাক, নিজেরাই যে ন্যায়-অন্যায় বা যুক্তিতর্কের মধ্যে লিপ্ত হয়ে ডেমোক্রেসির মধ্যে থাকত, এটাও জানত না। অজান্তেই তারা ডেমোক্রেসির সংজ্ঞার মধ্যে বিচরণ করত। নীতি-নৈতিকতার মাধ্যমে একের মতামতকে গুরুত্ব দেয়া বা যৌক্তিক মতামত গ্রহণ করা তাদের চিরকালের অভ্যাস। তারপর যার যার পছন্দ মতো রাজনৈতিক দলগুলোর নীতি-আদর্শ ধারণ করে রাজনীতি করা বা গণতন্ত্র চর্চা করার বিষয়টি গ্রহণ করে। এটা অনেকটা আবাহনী-মোহামেডানকে সাপোর্ট করার মতো। যেদিন প্রিয় দলের খেলা থাকে, সেদিন ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে গ্যালারিতে উপস্থিত হওয়ার মতো প্রিয় রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশে তারা হাজির হতো। তারপর প্রতিযোগিতায় হেরে গেলে কষ্ট পাওয়া আর জিতে গেলে আনন্দ পাওয়ার মধ্যেই তাদের রাজনীতি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ত। হেরে যাওয়া নিয়ে নানা হিসাব মেলানো এবং জিতে যাওয়া নিয়ে আনন্দ প্রকাশের পাশাপাশি আরও বেশি ব্যবধানে কীভাবে জেতা যেত, এ নিয়ে বিস্তর তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হতো। মূলত এভাবেই আমাদের দেশের রাজনীতির ধারাটা বহু বছর ধরে প্রচলিত ছিল। এখন তাতে যেন ছেদ পড়েছে। রাজনীতি বলতে কিছু নেই। টেবিলে চাপড় দিয়ে এক হাতে তালি বাজানোর মতো হয়ে পড়েছে। এমন একটা পরিবেশেই দেশকে বিরাজনীতিকরণ করার অভিযোগ উঠেছে। দেশের মানুষ কবে সরকার ও বিরোধী দলের স্বতঃস্ফূর্ত জনসভা দেখেছে, তা মনে করা তাদের পক্ষে একটু কঠিনই বটে। শীর্ষ নেতাদের সামনাসামনি দেখার জন্য বা তার কথা শোনার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে কষ্ট করে অতি সাধারণ মানুষের জনসভায় উপস্থিত হওয়ার বিষয়টি হারিয়ে গেছে। ধারাবাহিকভাবে জেলায় জেলায় রাজনৈতিক দলগুলোর বিশেষ করে বিরোধী দলের কবে বড় জনসভা হয়েছে, তা মনে করতে পারবে কিনা সন্দেহ। পত্র-পত্রিকায় জনসভার বিশাল ছবি ও প্রতিবেদনের পাশাপাশি আলাদাভাবে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের কথাও এখন আর চোখে পড়ে না। জনসভা করা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা হয় না। কার জনসভা কত বড় এবং কত মানুষের উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায়, এ নিয়ে কোনো চ্যালেঞ্জ দেখা যায় না। পাল্টাপাল্টি জনসভা করা নিয়ে যে উৎসবমুখর ও সুস্থ প্রতিযোগিতার রাজনীতি দেখা যেত, এখন তা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। রাজনীতি সচেতন সাধারণ মানুষ হয়তো অগোচরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, কোথায় গেল সেই রাজনীতি! আমরা কেন আর আগের মতো মিটিং-মিছিলে হাজির হতে পারি না! তারা যে আর আগের মতো মিটিং-মিছিলে হাজির হতে পারে না, এ বিষয়টি দেশ-বিদেশের সকলেরই জানা। তা না হলে এ অভিযোগ উঠত না, দেশকে বিরাজনীতিকরণ করা হয়েছে এবং বিরোধী দলগুলোকে রাজনীতির ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত স্থান করে দেয়া হচ্ছে না। অবশ্য সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, বিরোধী দলের মিটিং-মিছিল, সভা-সমাবেশ নিয়মিতই হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের এ কথার সাথে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী অনেকেই একমত নন। তারা অনেক আগে থেকেই বলে আসছেন, দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে। স্বাভাবিক রাজনীতির স্পেস সীমিত করা হয়েছে। তাদের এ কথায় ক্ষমতাসীন দল কর্ণপাত না করেই তার ইচ্ছামতো শাসন করে চলেছে। গণতন্ত্রকে পেছনে ফেলে উন্নয়নকে সামনে তুলে ধরছে। সরকারের বদ্ধমূল ধারণা, মানুষের সামনে উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরতে পারলে গণতন্ত্র আছে কি নেই এ নিয়ে তারা খুব বেশি মাথা ঘামাবে না। তবে সরকারের এ নীতির সাথে বেশির ভাগ সচেতন মানুষই দ্বিমত পোষণ করেন। তারা মনে করছেন, সুষম ও টেকসই উন্নয়ন এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় গণতন্ত্রের বিকল্প নেই। উন্নয়ন ও গণতন্ত্র একটি আরেকটির পরিপূরক। একটি বাদ দিয়ে আরেকটি খুব বেশি দিন চলতে পারে না। একটি সফল ও দক্ষ সরকারের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে উন্নয়ন এবং গণতন্ত্রকে সমানতালে এগিয়ে নেয়া। এর যে কোনো একটিকে বাদ দিলে তা তার অদক্ষতা হিসেবেই বিবেচিত হয়।
তিন.
দেশে চলমান বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ার মধ্যেই রাজনীতি সাবলীল হওয়ার একটা ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। এ ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে। ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচনটি হবে। এ হিসেবে নির্বাচনের বাকি প্রায় সোয়া দুই বছর। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে ক্ষমতাসীন দল ও দেশের বিরোধী দলগুলো বেশ সরব হয়ে উঠেছে। তারা প্রস্তুতিও শুরু করেছে। বিশেষ করে কোণঠাসা হয়ে পড়া বৃহত্তম বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচন নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছে। তারা যে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে এটা নিশ্চিত। তাদের কথাবার্তা এবং কার্যক্রমে তা বোঝা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে দলটি সার্বিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা, নির্বাচনী ইশতেহারসহ গুরুত্বপূর্ণ কাজে হাত দিয়েছে। নির্বাচনের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে জনমত তৈরিতে মাঠে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারের ওপর চাপ বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। পাশাপাশি নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থীর ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেছে। প্রতিটি সংসদীয় আসনে কমপক্ষে তিনজন করে সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকা করার পাশাপাশি প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা ও বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু তা নিয়ে জরিপ চালাচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন মাথায় রেখে প্রস্তুতি নিচ্ছে। সরকারি-বেসরকারিভাবে গোপনে জরিপ চালিয়ে দলের অবস্থান নির্ণয়ের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। নির্বাচনে কোন আসন নিশ্চিত কোন আসন অনিশ্চিত এ নিয়ে কাজ চলছে। প্রতিটি আসনে জনপ্রিয়তা যাচাই করে একাধিক প্রার্থীর নাম সংগ্রহ করা নিয়ে কাজ চলছে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী দলীয় সংসদ সদস্যদের এলাকামুখী হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সরকারের গৃহীত উন্নয়ন কাজ জনগণের সামনে তুলে ধরার জন্য নেতা-কর্মীদের দল থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সরকার ও সংসদে থাকা জাতীয় পার্টিও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। অন্যান্য দলের নির্বাচনের প্রস্তুতির কথা শোনা না গেলেও তারা নিজেরা জোটবদ্ধ হয়ে বা বড় দুই দলের জোটভুক্ত হওয়ার মাধ্যমে যে নির্বাচন করবে, তাতে সন্দেহ নেই। আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তুতি শুরু থেকে বোঝা যায়, নির্বাচনের আগে বিরাজনীতিকরণের যে প্রক্রিয়া চলছে তার অবসান ঘটবে বলে আশা করা যায়। রাজনীতির অস্বাভাবিক ও গুমোট যে পরিবেশ চলছে এবং এতে আবদ্ধ সাধারণ মানুষ রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে মুক্তভাবে তাদের চিন্তা-চেতনা এবং স্বাধীন মতামত প্রকাশের সুযোগ পাবে। তবে এ সবকিছুই নির্ভর করছে ক্ষমতাসীন দলের সদিচ্ছা ও গণতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার ওপর। কারণ এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ার সিংহভাগ দায় তাকেই নিতে হবে। অন্যদিকে প্রধান রাজনৈতিক বিরোধী দলের প্রজ্ঞাহীন সিদ্ধান্তও ক্ষমতাসীন দলকে কঠোর-কঠিন হয়ে বিরাজনীতিকরণের সুযোগ করে দিয়েছে। দেরিতে হলেও তারা এটা বুঝতে পেরেছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে অংশগ্রহণ করা থেকেই বোঝা যায়, দলটি বিনা চ্যালেঞ্জে ক্ষমতাসীন দলকে ছাড় দিতে চায়নি বা তাকে নির্বাচনের বাইরে রাখতে ক্ষমতাসীন দলের কৌশলকে কাজে লাগতে দেয়নি। আগামী একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত থেকেও বোঝা যাচ্ছে, দলটি দেশের বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া ঠেকিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে চায়।
চার.
সীমিত, নিয়ন্ত্রিত বা খর্বাকৃতির গণতন্ত্র স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা থেকেও ভয়ংকর। স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা নিয়ে জনসাধারণ এই বলে সান্ত¦না পেতে পারে যে, তারা স্বৈরতন্ত্রের অধীনে আছে। তবে গণতন্ত্রের লেবাসে শাসন ব্যবস্থায় জনগণ না পারে কিছু বলতে না পারে সইতে। গণতন্ত্র আছে গণতন্ত্র নাইÑ এমন এক গোলক ধাঁধার চক্করে পড়ে হতোদ্যম হয়ে পড়ে। এ ধরনের শাসন ব্যবস্থা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। আমাদের দেশের মানুষও কখনো তা মানেনি। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, তারা দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নিয়ে হলেও গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে, জীবন দিয়েছে। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। এ আন্দোলনে যে রাজনৈতিক দলই নেতৃত্ব দিক না কেন, তাতে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে। এমনকি স্বচ্ছন্দে থাকলেও যারাই গণতন্ত্র ব্যাহত করেছে, তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ আমাদের দেশের মানুষের কাছে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বা উন্নয়নই বড় কথা নয়, তাদের কাছে প্রথম অগ্রাধিকার গণতন্ত্র। এক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর জনসাধারণের চিন্তাভাবনার সাথে তাদের মিল রয়েছে। এর মাধ্যমে তারা এই মেসেজই দেয়, দেশ শাসন এবং উন্নয়ন দুটোই করতে হবে গণতন্ত্রকে ধারণ করে। এর বাইরে গণতন্ত্রের নামে কোনো ধরনের চালাকিতন্ত্র মানা হবে না। দেশের জনগণের চিরায়ত এই বৈশিষ্ট্যকে সাময়িকভাবে অনেক শাসক দমিয়ে রাখতে পারলেও শেষ পর্যন্ত তারা জনগণের ইচ্ছার কাছে পরাস্ত হয়েছে। জনগণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত রাজনীতি জনগণের কাছেই ফিরিয়ে দিতে হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে একাধিকবার এ নজির স্থাপিত হয়েছে। গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষ যে কোনো আপস করে না, তারা রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে চায়, ক্ষমতাসীন দলসহ এখন যেসব রাজনৈতিক দল রাজনীতি করছে, তারা নিশ্চয়ই জানে। কাজেই যারাই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, বাংলাদেশের মানুষের এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য উপলব্ধি করে দায়িত্বশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েই দেশ শাসন করতে হবে। বিরাজনীতিকরণ, এক দলের আধিপত্যবাদ, কর্তৃত্ববাদ বা গণতন্ত্রকে বিকৃত করে শাসন ক্ষমতা প্রলম্বিত করা গেলেও তার পরিণতি সুখকর হয় না। এক্ষেত্রে জনগণের অংশগ্রহণভিত্তিক গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত ও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দেয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই এবং এর বাইরে চিন্তা করারও সুযোগ নেই। এ বাস্তবতা মেনে নিয়েই গণতন্ত্রকে উন্মুক্ত ও বিকশিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। জনগণকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। আমরা আশাবাদী, আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলো যে প্রস্তুতি শুরু করেছে, তাতে সব দল অংশগ্রহণ করে দেশকে বিরাজনীতিকরণ থেকে মুক্ত করবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।