Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাম্পার ফলনের আশা

বন্যা-বৃষ্টি আশীর্বাদ

প্রকাশের সময় : ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১১:৩৩ পিএম, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

হাসান সোহেল : বন্যার পর মৌসুম শেষের পরিমিত বর্ষণ কৃষির বাম্পার ফলনের আশা জাগিয়েছে। ফলে জিডিপিতে কৃষির অবদান বাড়ার সম্ভাবনা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এবারের বন্যা কৃষকের জন্য শুধু ক্ষতি নয়, বিপুল সম্ভাবনাও নিয়ে এসেছে। বানের পানিতে ভেসে আসা পলিমাটি জমির ওপর উর্বরা শক্তি বাড়িয়েছে। পাশাপাশি এবারের বর্ষা মৌসুমের পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরও আগামী দুই মাসের মধ্যে বড় কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বাভাস দেয়নি। পাশাপাশি সরকারের উদ্যোগের ফলে কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারও দিন দিন বাড়ছে। এসব কারণে আসন্ন রোপা আমন ও শীতকালীন ফসল ও সবজি আবাদে বাম্পার ফলন হবে বলে জানিয়েছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা।
অন্যদিকে অধিক বৃষ্টিপাতের কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পানির লবণাক্ততা কেটে গেছে। যা আগামী দিনে ফসল ফলনের জন্য ইতিবাচক। গত বছর এবং চলতি বছরে এ পর্যন্ত বৃষ্টির ধারাবাহিকতা ভালো। এখনো বৃষ্টি হচ্ছে দেশের অধিকাংশ জেলায় তাই এবার অন্যান্য বছরের তুলনায় আমনের ফলন এবং রবি শষ্যে (ডাল ও তেল জাতীয়) অধিক সাফল্য আসবে বলে মনে করছেন। এছাড়া বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য চারা, বীজ ও সারসহ কৃষি প্রণোদনা অনেক কাজে আসবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ড. মো. রফিকুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, বন্যায় বড় ধরনের কোন ক্ষতি হয়নি। এটা আমাদের জন্য আশীর্বাদ। একই সঙ্গে বৃষ্টি হওয়ায় ফসলি জমি ফাটে না। ফসলের জন্য উপযুক্ত পরিমাণ পানি থাকে ফলে ফলন ভালো হয়। এছাড়া বৃষ্টিতে জমিতে থাকা লবণসহ অন্যান্য ক্ষতিকর দ্রব্যাদি নদীতে চলে যায়। জোয়ারের মাধ্যমে নতুন পলি পড়ে। যা আমাদের ফসলের জন্য আশীর্বাদ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইংয়ের পরিচালক চৈতন্য কুমার দাস বলেন, গত বছর এবং এই বছরে এখন পর্যন্ত যে বৃষ্টি হয়েছে এটা আমাদের জন্য দরকার ছিল। তিনি বলেন, কয়েক বছর থেকে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবের কারণে আমাদের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গিয়েছিল, অনেকদিন স্থায়ী বৃষ্টি হওয়ায় এটা কিছুটা হলেও ব্যালেন্স হবে। একই সঙ্গে কিছু কিছু এলাকায় কিছুটা বন্যা দেখা দেয়ায় সাময়িক ক্ষতি হলেও পানিতে ভেসে আসা পলিমাটি জমির ওপর উর্বরা শক্তি বাড়িয়ে দিবে। তাই চলতি বছরে দেশে আমনের ফলন, রবি শষ্য ও শীতকালীন সবজিতে অধিক সাফল্য আসবে বলে জানান তিনি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা বলেন, বন্যা ও বৃষ্টির পর রবি ফসলের (ডাল, তেল, গম ও ভুট্রা জাতীয়) ফলন ১০ থেকে ৫০ শতাংশ বেড়ে যায়। তবে প্রথমবার যে ফসলের চাষ করা হবে সেই ফসলেই এই সুবিধা পাওয়া যাবে।
চৈতন্য কুমার দাস বলেন, প্রতিবছর সেপ্টেম্বরে খড়া শুরু হয়। দেশের উত্তরাঞ্চলের রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, কৃড়িগ্রাম, লালমনিরহাট এবং রাজশাহী এই সময়ে পানির অভাবে প্রচ- খড়া দেখা দিতো। শুকিয়ে চৌচির হয়ে যেত, যার বিরূপ প্রভাব আমাদের পরিবেশের উপর পড়ে। জলবায়ুজনিত এই প্রভাব থেকে উত্তরণে কিছুটা হলেও এবারের বৃষ্টি কাজ করবে বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, গত বছরের মতো এ বছরও এখন পর্যন্ত দেশের অধিকাংশ জেলায় বৃষ্টি হচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাত হওয়ায় এ মৌসুমে শীতকালীন সবজি শিম, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, লালশাক, মূলা, পেঁপে ও কলার আবাদেও ভালো সাফল্য আসবে।
কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেছেন, আজ বাংলাদেশ বিশ্বে সবজি উৎপাদনে তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে। কৃষি বিজ্ঞানীদের নতুন নতুন আবিষ্কারের ফলেই এ সাফল্য এসেছে। গত তিন বছরের কৃষিতে ভালো ফলাফলের কারণেই আমাদের প্রধানমন্ত্রী ‘সেরেস’ পদক পেয়েছেন।
কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী জানান, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া, তাদের পারিবারিক পুষ্টি নিশ্চিত, ধানের মোট উৎপাদনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এবং ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক পরিবারকে দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষম ও শক্তিশালী করে তোলাই সরকারের লক্ষ্য।
এদিকে এ বছর অতিবৃষ্টিজনিত বন্যার কারণে অধিক ক্ষতিগ্রস্ত ১৭ হাজার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক সরকারী সহায়তার প্রায় ৫৪ লাখ টাকার কৃষি উপকরণ পাচ্ছেন। একই সময়ে প্রণোদনা হিসেবে ৬৪ জেলার ৪ লাখ ১৮ হাজার ৫১১ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষককে ৪২ কোটি ৯ লাখ ৮২ হাজার ৮০০ টাকার কৃষি উপকরণ সরবরাহ করবে সরকার। যা কৃষকদের সাময়িক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে এবং নতুন উদ্যমে ফসল উৎপাদনে অনুপ্রেরণা যোগাবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এ বছর ধানের বাম্পার ফলন ও সবজি চাষে সাফল্য আসলে জিডিপিতে কৃষির অবদান আরও বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত ২৬ সেপ্টেম্বরও দেশের অধিকাংশ জেলায় বৃষ্টি হয়েছে। গতকালও কিছু কিছু জেলায় বৃষ্টি হয়েছে। এটা যদি আশ্বিনের শেষ পর্যন্ত (অক্টোবরের মাঝামাঝি) পর্যন্ত চলমান থাকে তাহলে সেচের মাধ্যমে ফসলের ক্ষেতে যে পানির প্রয়োজন হতো তা আর দরকার হবে না।
এসব কারণে এ বছর আমনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশা করছে কৃষি সম্পসারণ অধিদপ্তর।
অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, দেশে চালের প্রায় ৩৮ শতাংশ জোগান আসে আমন থেকে। বন্যায় ও বৃষ্টিতে ফসলের ক্ষেত ডুবে যাওয়ার পরও এ বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি রোপা আমন রোপণ করা হয়েছে। এবারে রোপা আমন চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ৫২ লাখ ৬১ হেক্টর। কিন্তু রোপণ করা হয়েছে ৫৩ লাখ ১৯ হাজার হেক্টর জমিতে। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ দশমিক ১১ শতাংশ বেশি। একই সঙ্গে গতবছর আমনে ফলন হয়েছিল ১ কোটি ৩৪ লাখ।
এখনো অনেক সময় বাকী থাকলেও আবহাওয়া ভালো থাকলে আমনের ফলন গত বছরের অধিক হবে বলে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান। এদিকে বোরোর ওপর চাপ কমাতে আমনের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য সরকার নানামুখী পদক্ষেপও নিয়েছে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল এনভায়রনমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক ও গবেষক প্রফেসর জহির বিন আলম ইনকিলাবকে বলেন, এ বছর ধারাবাহিকভাবে দেশে বৃষ্টি হচ্ছে। যা ধানসহ অন্যান্য রবি শষ্যের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। তিনি বলেন, পুরো জুন মাস থেকে এখনো এই বৃষ্টি আছে। এভাবে অক্টোবরেও বৃষ্টি বিরাজমান থাকলে দেশের অন্যান্য স্থানের মতো সুনামগঞ্জেও ধানের অধিক ফলন হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. হামিদুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে কৃষি সেক্টরের ধারাবাহিক অগ্রগতি আসছে। দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণ। আমরা খুবই আত্মবিশ্বাসী যে, এখন কেউ না খেয়ে মরবে না। বর্তমান সরকার নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে, তা মাঠে প্রয়োগে এবং কৃষকের চাহিদামত উপকরণের যোগান দিতে সর্বদা তৎপর। তিনি বলেন, কৃষি উন্নয়নের সব রকম আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ক্রমহ্রাসমান জমি থেকে সর্বোচ্চ ফলন নিশ্চিতে কাজ করা হচ্ছে। এ বছর আমনসহ অন্যান্য ফসলের বাম্পার ফলন হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
প্রফেসর ড. মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, গত জুন মাস থেকে ধারাবাহিকভাবে বৃষ্টি হচ্ছে। সেচের জন্য কৃষকের আলাদা খরচ কমে যাবে। অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত যদি বৃষ্টির এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকে তাহলে ধানের বাম্পার ফলন হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 



 

Show all comments
  • সাইফ ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০৮ পিএম says : 0
    মাননীয় মন্ত্রী কৃষকদের ঠিক মত সুযোগ সুবিধা দিলে বাংলাদেশ বিশ্বে সবজি উৎপাদনে তৃতীয় নয় প্রথম স্থান অধিকার কবে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাম্পার ফলনের আশা

১৩ অক্টোবর, ২০২১
২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ