বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
দোয়া-মোনাজাত সকল যুগে সব নেক লোকেরা করে এসেছেন, করতে থাকবেন। তবে এক শ্রেণির পথভ্রষ্ট লোক আগেও বলেছে, বলে এখনও ‘তকদিরে যা আছে তা তো হবেই, কোনো চেষ্টা-তদবির, দোয়া-মোনাজাত দ্বারা ভাগ্য বদলাবে না।’ নাউযুবিল্লাহ। হযরত সাওবান (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নেককাজ ব্যতীত অন্য কিছুতেই আয়ু বৃদ্ধি পায় না এবং দোয়া ব্যতীত তাকদীর তথা ভাগ্য পরিবর্তন হয় না। আর পাপাচারের কারণেই মানুষকে তার জীবিকা থেকে বঞ্চিত করা হয়। (ইবনে মাজা)।’ অন্যত্রে ইরশাদ হয়েছে, হযরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা). বলেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি বিষয় বলে দেব না, যা তোমাদেরকে তোমাদের শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করবে এবং তোমাদের রিজিক বৃদ্ধি করবে? আর তা হচ্ছেÑ তোমরা দিন ও রাতে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকবে। কারণ দোয়া মুমিনের অস্ত্র সমতুল্য। (মুসানাদে আবু ইয়ালা)।’
দোয়া কবুলের শর্ত : দোয়া মোনাজাত শুধু করলেই হবে না, দোয়া মকবুল হওয়ার জন্য রয়েছে কিছু শর্ত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন: ‘যখন কোনো মুমিন ব্যক্তি দোয়া করে, যে দোয়াতে কোনো রূপ গুনাহ কিংবা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করার বিষয় না থাকে তখন আল্লাহ তিন পদ্ধতির কোনো এক পদ্ধতিতে তার দোয়া কবুল করেন।
(১) যেই দোয়া করেছে তা তাৎক্ষণিক কবুল করে নেন, (২) অথবা তার দোয়া আর প্রতিদান আখেরাতের জন্য সংরক্ষণ করেন, (৩) কিংবা দোয়ার মাধ্যমে তার কোনো কষ্ট বা বিপদ দূর করে দেন। সাহাবীগণ বললেন, আমরা যখন বেশি বেশি দোয়া করব (তখন কি এরূপ প্রতিদান দেয়া হবে?) নবী (সা.) ইরশাদ করেন, আল্লাহ তো বেশি দানকারী। (তিরমিযি)।’ রাসূলুল্লাহ (সা.) আরো বলেন, ‘আল্লাহর কাছে দোয়ার চেয়ে উত্তম কোনো ইবাদত নেই’ (তিরমিযি)।’
(২)
দোয়াকারীর পানাহার, পোশাক-পরিচ্ছেদ, বাসস্থান হালাল হতে হবে। কেননা রাসূলে আকরাম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কোনো ব্যক্তি দীর্ঘ সফর করে এলোমেলো চুল ও ধূসর দেহ নিয়ে আসমানের দিকে দুই হাত উত্তোলন করে বলতে থাকে, হে আমার রব। অথচ তার পানাহার, পোশাক-পরিচ্ছেদ সবই হারাম। তাহলে তার দোয়া কীভাবে কবুল হবে? (মুসলিম)।’ দোয়া কবুল হতে বিলম্ব হওয়ায় অধৈর্য হওয়া যাবে না। কেননা রাসূলে আকরাম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের দোয়া কবুল হবে যদি তোমরা তাড়াহুড়া না করো এবং একথা না বলো যে, আমি দোয়া করলাম কিন্তু কবুল হলো না। (মুসলিম)।’
মুনাজাতে প্রার্থিত বিষয় অবশ্যই জায়েজ হতে হবে। রাসূলে আকরাম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কোনো মুসলমান যখন দোয়া করে আল্লাহ তায়ালা তার কাক্সিক্ষত সেই বস্তু দান করেন অথবা তার থেকে অনুরূপ অনিষ্টতা দূর করেন। যদি সে গোনাহের এবং আত্মীয়তা ছিন্ন করার দোয়া না করে। (তিরমিজি)।’ দোয়া কবুল হওয়ার জন্য এটাও শর্ত যে, মুসলিম উম্মাহের মাঝে সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধ জারি থাকা। না হলে দোয়া কবুলের প্রতিশ্রুতি বলবৎ থাকে না। নবী কারিম (সা.) ইরশাদ করেন, ’হে লোক সকল! আল্লাহপাক তোমাদের বলেছেন, তোমরা সৎ কাজের আদেশ করো এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করো। এমন সময় আসার আগে যখন তোমরা আমাকে ডাকবে কিন্তু আমি সাড়া দেব না। তোমরা আমার কাছে চাইবে কিন্তু আমি পূর্ণ করব না। তোমরা শত্রুর বিরুদ্ধে আমার কাছে সাহায্য চাইবে; কিন্তু আমি সাহায্য করব না। (ইবনে হিব্বান)।’
অন্য এক হাদীসে আছে, হযরত জাবির (রা.) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, আল্লাহপাক হযরত জিব্রাঈল (আ.)-কে অমুক অমুক জনপদ তার অধিবাসীসহ উল্টে দিতে হুকুম করলেন। ’জিব্রাঈল (আ.) বলেন, ‘হে প্রতিপালক, সেখানে তাদের মধ্যে আপনার এমন একজন বান্দা রয়েছে যে, জীবনে এক মুহূর্তের জন্যও আপনার নাফরমানি করেনি। তাকেসহ কি এলাকাটি ধ্বংস করে দেব? আল্লাহ বললেন, হ্যাঁ, তুমি তাকেসহই জনপদটি ধ্বংস করে দাও। কেননা সে এমন এক বান্দা যার চেহারা এলাকাবাসীর নাফরমানি দেখে কখনো বিবর্ণ ও মলিন হয়নি।’ বায়হাকী শরীফ।
কবর দেশে শায়িত মোর্দেগানদের জন্যও একমাত্র পাথেয় হলো দোয়া ও মোনাজাত। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. এরশাদ করেন, ‘মানুষ যখন মারা যায়, তখন তার সমস্ত আমলের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি আমলের দরজা বন্ধ হয় না। ক. সদকায়ে জারিয়া, খ. যদি কেউ এমন সন্তান রেখে যায়, যে সন্তান বাবা-মায়ের জন্য দোয়া করবে, ও গ. এমন দীনি শিক্ষা রেখে যায়, যার দ্বারা মানুষ উপকৃত হতে থাকে। (মুসলিম শরিফ)
দোয়া-মোনাজাতের জন্য কোরআনে বর্ণিত সুনির্দিষ্ট ৪টি আদব ও নিয়ম রয়েছে। প্রথমটি হলো নিজের অপরাগতা ও অক্ষমতা এবং বিনয়-নম্রতা প্রকাশ করে দোয়া করা, দ্বিতীয়টি হচ্ছে চুপিচুপি ও সংগোপনে দোয়া করা। তৃতীয় ও চতুর্থটি হলো যথাক্রমে ভয় ও আশান্বিত হয়ে আল্লাহ তায়ালাকে ডাকা। কোরআনুল কারীমের সূরা আল আরাফের আয়াত নং ৫৬ এ বলা হয়েছে, ‘এবং পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার পর তাতে অশান্তি বিস্তার করো না এবং (অন্তরে তাঁর) ভয় ও আশা রেখে তাঁর ইবাদত করো। নিশ্চয়ই আল্লাহর রহমত সৎকর্মশীলদের নিকটবর্তী।’
এছাড়াও, একমাত্র আল্লাহর কাছেই দোয়া করা; নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করবেন এমন বিশ্বাস নিয়ে দৃঢ়তার সাথে দোয়া করা; বিনয় ও একাগ্রতার সাথে দোয়া করা, দোয়ার পূর্বে আল্লাহর প্রশংসা ও রাসূলে পাক (সা.) এর প্রতি দরূদ পড়া; সমস্ত পাপ ও অপরাধ থেকে খালিস তাওবা করা, নেক আমলের উসিলা দিয়ে দোয়া করা; বার বার দোয়া করা, দোয়ার শেষে আমীন বলা।
পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ তামাম পৃথিবীর প্রতিটা ইঞ্চি আজ করোনাভাইরাসের ভয়াল থাবায় বিপর্যস্ত। এ মহামারির ভয়াবহতার সামনে সমগ্র বিজ্ঞান প্রযুক্তি আজ ব্যর্থ। জনজীবন আজ বিপন্ন, প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ হচ্ছে আক্রান্ত। যাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের দাপটে পৃথিবী অস্থির সবচেয়ে উন্নত সেসব দেশে এর প্রকোপ আরো বেশি। এই বালা থেকে রেহাই পাবার একমাত্র পথ রব্বুল আলামীনের নিকট শরণাপন্ন হয়ে ফরিয়াদ জানানো। খালেস দিলে তওবা করে একনিষ্ঠভাবে সবিনয়ে সেই মহান রাব্বে করিমের দরবারে দোয়া ও মোনাজাত করা।
‘রাব্বানা, শোনো শোনো মোদের মোনাজাত
যদি ভুল করি-ভুলে যাই চাই যে মাগফিরাত’
আগের দিনের লোকেরা তোমার
বহন করেছে যেই গুরুভার
সে ভার মোদের মাথায় আবার দিও না হে পাক-জাত।
দিও না সে ভার- যে ভার বহিতে শক্তি মোদের নাই
কমজোর মোরা- মাফ করো তুমি তোমার করুণা চাই।
তুমি আমাদের মাওলা হে প্রভু
এই কথা যেন ভুলি নাকো কভু
কুফরী হইতে বাঁচাও মোদের- ধরো আমাদের হাত।
সূরা বাকারা : ২৮৬।
কাব্যনুবাদ : গোলাম মোস্তাফা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।