বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
দোয়া ও মোনাজাত মহান আল্লাহ তায়া’লার নিকট অতীব পছন্দনীয় একটি আমল। মহান রাব্বুল আলামীনের সাথে বান্দার নিবিড় সম্পর্কের সেতুবন্ধন হলো দোয়া ও মোনাজাত। মানব জীবনে দোয়া ও মোনাজাতের গুরুত্ব অপরিসীম। আভিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে শব্দদ্বয়ের মাঝে কিঞ্চিৎ পার্থক্য থাকলেও পারিভাষিক অর্থে শব্দ দুটি একে অপরের সম্পূরক। দোয়া ও মোনাজাতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ তায়া’লার নিকট বান্দা হতে পারে অতি আপন। পৌঁছতে পারে মনজিলে মকসুদে। তবে শর্ত হচ্ছে, দোয়া ও মোনাজাত হতে হবে খুশু-খুজু, আদবের সাথে ও শিরিক-বেদয়াত মুক্ত।
এই বিশ্ব চরাচরের একচ্ছত্র অধিপতি এবং তামাম মাখলুকের একক স্রষ্টা ও প্রতিপালক মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। এই নশ্বর ধরনীর কোনো কিছুই তাঁর কাছে গোপন নয়। তিনি বান্দার প্রয়োজন ও অভাব-অভিযোগ সম্পর্কে সর্বদা সর্বোজ্ঞ। পবিত্র কোরআনের সূরা আনয়ামের ৫৯ নং আয়াতে মহান আল্লাহপাক বলেন, ‘অদৃশ্যের কুঞ্জি তাঁরই নিকট আছে, তিনি ব্যতীত অন্য কেউ তা জানে না। জলে ও স্থলে যা কিছু আছে তা তিনিই অবগত, তাঁর অজ্ঞাতসারে একটি পাতাও পড়ে না। মৃত্তিকার অন্ধকারে এমন কোনো শস্যকণাও অঙ্কুরিত হয় না বা রসযুক্ত কিংবা শুষ্ক এমন কোনো বস্তু নেই যা সুস্পষ্ট কিতাবে নেই।’
এর থেকে প্রতীয়মান যে মহান আল্লাহ বান্দার প্রতি মুহতাজ নন বরং বান্দাই আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফজল ও করমের প্রতি হামেশা মুহতাজ। তাই, বান্দার আবশ্যিক কর্তব্য হলো, দোয়া-মোনাজাতের মাধ্যমে আল্লাহর শোকর গুজার করা। এই প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন, ‘সুতরাং তোমরা আমাকেই স্মরণ করো, আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করব। তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও আর অকৃতজ্ঞ হয়ো না।’ সুরা বাকারার ১৮৬ নং আয়াতে মহান আল্লাহ তায়ালা প্রিয় নবীজিকে বলেন, ‘যখন আমার বান্দারা আপনার কাছে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে, তখন আপনি বলে দিন, আমি নিকটে আছি; আমি দোয়া কবুল করি, যখন সে আমার কাছে দোয়া করে।’
মহান আল্লাহ বান্দাকে দিতে ভালোবাসেন। বান্দা যত চায় আল্লাহ তায়ালা তাঁর রহমতের ভাণ্ডার থেকে বান্দাকে তারও বেশি দান করেন। হজরত সালমান ফারসি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালার সত্ত্বার ভেতর অনেক বেশি লজ্জাশীলতার গুণ রয়েছে। তিনি না চাইতে অনেক বেশি দানকারী। যখন মানুষ চাওয়ার জন্য আল্লাহ তায়ালার সামনে হাত ওঠায়, তখন সেই হাতগুলো খালি ও ব্যর্থ হিসেবে ফিরিয়ে দিতে তার লজ্জা হয়।’ (তিরমিজি : ৩৫৫৬)।
দোয়া ও মোনাজাত আমাদের উত্তরাধিকার। যুগে যুগে আম্বিয়ায়ে কেরাম (আ.) নিজেরা দোয়া ও মোনাজাত করেছেন এবং তাদের উম্মতদেরকেও এ জন্য নসীহত করেছেন। মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে এর বহু নজির রয়েছ। হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে হযরত নূহ (আ.), হযরত হুদ (আ.), হযরত ইব্রাহিম (আ.), হযরত ইউসুফ (আ.), হযরত শুয়াইব (আ.), হযরত মুসা ও ঈসা (আ.)-সহ আরো অনেক নবীদের দেয়া পবিত্র কোরআনে উল্লেখিত আছে।
আদিপিতা হযরত আদম (আ.) আল্লাহর কাছে বিনীতভাবে দোয়া ও মোনাজাত করেছেন। বলেছেন, ’হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করেছি, যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি দয়া না করেন, তবে আমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হব’। সূরা আরাফ: ২৩। একইভাবে সকল নবী রাসূল আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে দোয়া করেছেন। তার মধ্যে থেকে কিছু নজির সংক্ষিপ্ত আকারে পেশ করা হলো। যেমন হযরত নূহ (আ.) দোয়া করেছেন, হে আমার প্রতিপালক আপনি আমাকে ক্ষমা করুন, আমার পিতা-মাতা এবং যারা মুমিন হয়ে আমার ঘরে প্রবেশ করে এবং সকল মোমেন নর-নারীকে ক্ষমা করুন। সূরা নূহ: ২৮। হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর আল্লাহর সমীপে পেশ করা অনেক দোয়া পবিত্র কোরআনে উল্লেখ আছে। তন্মধ্যে কয়েকটি এরূপ:
তিনি মক্বা নগরীর নিরাপত্তা এবং তার মুমিন অধিবাসীদের জন্য জীবিকার ফরিয়াদ জানিয়ে দোয়া করেন: ’হে আমার রব! আপনি মক্কাকে নিরাপদ শহর করুন এবং এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী তাদেরকে ফল-মূল জীবিকা প্রদান করুন।’ সূরা বাকারাহ: ১২৬।
প্রবল প্রতাবান্বিত জালিম বাদশা নমরুদ হযরত ইবরাহিম (আ.)-কে পুড়িয়ে মারার জন্য ভীষণ অনলকুণ্ডে নিক্ষেপ করেছিল। তাঁর ঈমান ও আত্মবিশ্বাসের শক্তি দেখে মহান আল্লাহ সেই ভয়াল অগ্নিকুণ্ডকে কুসুম কাননের মতো শান্তিপূর্ণ ও আরামদায়ক করে দিয়েছিলেন। সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাআলার ক্ষমতা সীমাহীন।
এছাড়াও, যখন সুবিশাল মাছ হযরত ইউনূস (আ.)-কে গ্রাস করল। তিনি মাছের পেটে বসে পাঠ করলেন, ‘লা-ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জলিমিন’। সূরা আম্বিয়া: ৮৭। অর্থাৎ (হে রব) আপনি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই; আপনি পবিত্র মহান! আমি তো সীমালঙ্ঘনকারী। আল্লাহ তাঁর কাতর মিনতি শুনলেন এবং তাঁকে উদ্ধার করলেন। আল্লাহর ভাষায়: ‘ফাস্তাযাবনা লাহু ওয়া নাজ্জাইনাহু মিনাল গাম্মি ওয়া কাজালিকা নুনজীল মু’মিনিন।’ (আল্লাহ বলেন) তখন আমি তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছিলাম এবং তাকে উদ্ধার করেছিলাম দুশ্চিন্তা হতে এবং এভাবেই আমি মুমিনদেরকে উদ্ধার করে থাকি। সূরা আম্বিয়া: ৮৮। মোট কথা, দোয়া ও মোনাজাত উম্মতে মোহাম্মদীর একক কোনো আমল নয়। আল্লাহ তাঁর নিকট দোয়া ও মোনাজাত করার আহ্বান করেছেন, নিজে দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন। আদম (আ.) থেকে সব নবী রাসূল নিজেরা দোয়া মোনাজাত করেছেন, তাদের উম্মতদেরও দোয়া করার উপদেশ দিয়েছেন।
পাপি শয়তানের ওয়াসওয়াসায় পড়ে, কুপ্রবৃত্তির তাড়নায়, পরিবেশ পারিপার্শ্বিকতার অশুভ প্রভাবে বান্দা গুনাহ করবেই, কম কিংবা বেশি, সগীরা কিংবা কবীরা। এটা বান্দার স্বভাব। কেবলমাত্র নবী-রাসুলগণই মাসুম-নিষ্পাপ। আর আল্লাহ তায়া’লা রাহমানুর রাহীম। তিনি দয়ার সাগর, ক্ষমাশীল দাতা-দয়ালু। তাই, বান্দার কর্তব্য হলো, তাওবা-ইস্তেগফারের মাধ্যমে দোয়ার শর্ত আদব রক্ষা করে কায়মনোবাক্যে আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করা, মোনাজাত করা। হাদিসের মধ্যে দোয়া করাকে স্বতন্ত্র একটি ইবাদত হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। দোয়া হলো তামাম ইবাদতের সার বা মগজ। সূরা আল মু’মিনের ৬০ নং আয়াতে এসেছে, ‘তোমাদের প্রতিপালক বলেন, ‘তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব। যারা অহংকারবশে আমার ‘ইবাদতে বিমুখ, এরা অবশ্যই জাহান্নামে প্রবেশ করবে লাঞ্ছিত হয়ে।’
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।