বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
কোরবানির ইতিহাস সুপ্রাচীন হলেও একে ‘পশু হত্যা’ বা ‘গো হত্যা’ নামে আখ্যায়িত করার ইতিহাস সৃষ্টি করা হয়েছে ভারতে ১৮৫৭ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের বহু পরে। মুসলমানদের গরু কোরবানিকে কেন্দ্র করে প্রথম হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল ১৮৫৭ সালে, আজমগড়ে। এ ঘটনার পরপরই প্রখ্যাত কংগ্রেস নেতা মি. তিলক কর্তৃক গরু জবাইবিরোধী সমিতি গঠন করা হয়। অতঃপর কংগ্রেসি নেতৃবর্গ সর্বদা গো রক্ষার জন্য চেষ্টা চালাতে থাকেন। এরপর মথুরায় একটি গো সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিষাণ রাজ্যের উজিরে আলার (মুখ্যমন্ত্রী) সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে গো হত্যা বন্ধের উপায় সম্বন্ধে বহু চিন্তা-ভাবনা করা হয় এবং তাতে বিভিন্ন প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাব অনুযায়ী একটি প্রতিনিধিদল পণ্ডিত মদন মোহন মালব্যের নেতৃত্বে ভারতের লাট বাহাদুরের সাথে সাক্ষাৎ করে গো হত্যা বন্ধের দাবি জানাবে বলে স্থির করা হয়। এই পদ্ধতিতে কামিয়াব না হলে ব্যাপক ‘সত্যাগ্রহে’র আয়োজন করা হবে বলে ঘোষণা করা হয়। এই উদ্দেশ্যে একটি ফান্ড খোলা হয়। জনৈক হিন্দু তৎক্ষণাৎ পঞ্চাশ হাজার টাকা নগদ প্রদানের কথা ঘোষণা করেন।
পাঠক এই সঙ্গে পূর্ব পরিস্থিতি সম্পর্কেও কিছুটা তথ্য জেনে নিন, যেখানে হিন্দুশাস্ত্রে গরুর গোশত ভক্ষণ করার বিষয় উল্লেখিত হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ ‘বেদে’র কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এতে আছে ‘হিন্দু সমাজ গরুর গোশত খাইত।’ পণ্ডিত অবিণাশ চন্দ্র দাশ, এমএ মহাশয় তার গ্রন্থ ‘ঋগবেদ’ ৯৮ পৃষ্ঠায় বলেছেন, ‘প্রাচীন আর্যদের মধ্যে গরুর গোশত খাওয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়।’ শ্রী চিন্তামণি রাউভেদী বলেন, ‘আদি যুগে ঋষি ব্যক্তিরা গরুর গোশত খাইতেন।’ বেদের বহু মন্ত্রে লেখা আছে যে, ‘গরুর গোশত খাওয়া উচিত।’
হিন্দু পণ্ডিত নেতৃবর্গ গো মাংস সংক্রান্ত তাদের ধর্ম গ্রন্থাবলির শিক্ষার কথা ভুলে যান এবং ইসলামবিদ্বেষী চিন্তা-চেতনাকে উত্তপ্ত করে সাম্প্রদায়িকতা উজ্জীবিত করতে থাকেন। পরবর্তীকালে হিন্দু পণ্ডিতগণ ‘গো হত্যা’ বন্ধ অভিযানকে ছড়িয়ে দেন এবং হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার এক অব্যাহত ধারা শুরু হয়ে যায়, যা নানাভাবে ভারতের বিভিন্ন স্থানে অহরহ এখনো ঘটছে এবং হিন্দুত্ববাদীদের ‘বলির পাঠা’ হচ্ছেন, ভারতীয় সংখ্যালঘু মুসলমানগণ। কেবল গো হত্যা নয়, মুসলমানদের বিভিন্ন ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনও উগ্র হিন্দুদের দ্বারা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ যাবত তাদের হাতে বিভিন্ন স্থানে কত মুসলমান শহীদ ও জখম হয়েছেন, সে পরিসংখ্যান দেয়া কঠিন।
মোগল সম্রাট আকবর তার হিন্দু প্রজাদের মনোরঞ্জনার্থে গরু জবাই বন্ধের যে ঘোষণা হয়েছিলেন, তাতে তাকে যথেষ্ট বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। উলামা সমাজ তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। এ সময় ইমাম রব্বানী মোজাদ্দেদে আলফেসানি (রহ.) লেখনীর মাধ্যমে এর বিরোধিতা করতে থাকেন। মোজাদ্দেদ সাহেব এ সম্বন্ধে তার এক পত্রে লিখেছেন : ‘হিন্দুস্থানে গরু জবাই করাকে ইসলামের বড় একটি রীতিনীতি (ঐতিহ্য) এবং ভারতীয় মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে একটি বিরাট পার্থক্য সাধনকারী নিদর্শন হিসেবে গণ্য করতে হবে।’ সুতরাং গরু জবাই করা ভারতীয় মুসলমানদের কেবল ধর্মীয় অধিকারই নয়, বরং এটা তাদের তমদ্দুনিক বা সাংস্কৃতিক অধিকারও বটে। কেবল মুসলমানদের মধ্যে গরুর গোশত খাওয়া সীমাবদ্ধ নয়। সেখানকার এক বিপুল সংখ্যক হিন্দুও গো মাংস ভক্ষণ করতে অভ্যস্ত, বস্তুত হিন্দু শাস্ত্রে গো হত্যা নিষিদ্ধ না হলেও ইসলামবিদ্বেষ তাদের বিরত রাখে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।