Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

করোনা: ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর হোক আমাদের ঈদ

| প্রকাশের সময় : ১৫ জুলাই, ২০২১, ১২:০২ এএম

ঘাতক ব্যাধি করোনার মরণ থাবায় বিশ্ব আজ দিশেহারা। তার অপ্রতিরোধ্য দাপটে অসহায় মানব জাতি। বোধ করি পৃথিবী সৃষ্টির পর এমন বিস্তৃত, মরণঘাতি ও আতংক সৃষ্টিকারী মহামারী আর কখনো দেখা দেয়নি। বিশ্বের কোন দেশ এই মহামারীতে আক্রান্ত হয়নি তা যে খোঁজে বের করতে হবে তা তো বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্বের অনেক ডাকসাইটে নেতা ও রাষ্ট্র প্রধানরাও করোনায় আক্রন্ত হয়েছেন এবং মারা গেছেন। প্রতিনিয়ত লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। চাকরী হারাচ্ছে অসংখ্য মানুষ। তীব্র দারিদ্রতার অনলে পুড়ছে অগণিত বনি আদম। এ ত্রাহি ত্রাহি অবস্থায় আসমানী ফায়সালার অপেক্ষা চলবে কেবল নিরবে সরবে। উদ্বেগ-আতংকসহ অসহায়ত্বের সকল বিশেষণ করোনা ভাইরাসের তান্ডবের কাছে নস্যি হয়ে গেছে। মানুষের একক, সংগঠিত, ভৌগলিক, জাতি স¦ত্তার তাবৎ শক্তিমত্তাকে ধূলিতে মিশিয়ে দিয়ে গোটা বিশ্বকে জিম্মি করে রেখেছে। ঠেলে দিচ্ছে ঘোর অন্ধকারে অনিশ্চিত যাত্রায়। এই পরিস্থিতিতে মুসলিম উম্মাহর এক বড় উৎসব ঈদুল আযহা সমাগত। মূলত ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা মুসলিম উম্মাহর সার্বজনীন ধর্মীয় উৎসব ও ইবাদত। পৃথিবীর প্রত্যেক জাতিরই কিছু জাতীয় ও ধর্মীয় উৎসবের দিন রয়েছে। যাতে তারা সে দিনগুলোতে স্ব স্ব রীতি অনুযায়ী আনন্দ-ফুর্তি করে। ভালো ভালো খাবারের আয়োজন করে এবং উন্নত মানের লেবাস-পোশাকের ইন্তিজাম করে। এটি মানুষের ফিতরতী চাহিদা। এর বাইরে কোনো কওম বা জাতিকে পাওয়া যাবে না। আম্মাজান আয়েশা রা. থেকে বর্র্ণিত, ঈদুল ফিতর বা ঈদুল আযহার দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর কাছে ছিলেন। সেখানে দুটি বাঁদী বুআছ যুদ্ধ সম্পর্কে আনসারীগণ যা বলতেন, তার আলোকে সংগীত-গজল পরিবেশন করছিল। এ অবস্থায় তাঁর পিতা আবু বকর সেখানে এলেন। সংগীত শুনে তিনি দু’বার বললেন, এ তো শয়তানের বাঁশি। তাঁর এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আবূ বকর! তাদেরকে গায়তে দাও। নিশ্চয় প্রত্যেক জাতির ঈদ আছে। এই দিন হলো, আমাদের ঈদ। [বুখারী, হাদীস: ৩৯৩১; মুসলিম, হাদীস:৮৯২] ইসলাম যেহেতু ফিতরাতের ধর্ম এবং এর প্রবর্তক অন্তরযামী আল্লাহ তাআলা। তাই ইসলামেও রয়েছে ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতর নামে এমন দু’টি দিন, যা আমরা পেয়েছি নবীয়ে রহমতের যবান মুবারক থেকে। সাহাবী আনাস রা.বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদীনায় আগমন করলেন, তখন মদীনাবাসীদের উৎসবের জন্য দু’টি দিন ছিল। যাতে তারা খেলা-ধূলা, আনন্দ-উৎসব করত। এ অবস্থা দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, এই যে দুই দিন, যাতে তোমরা আনন্দ-উৎসব করছো, এর বাস্তবতা ও মৌল কি? জবাবে তাঁরা বললেন, আমরা জাহিলী যুগ থেকেই এই উৎসব পালন করে আসছি। সেই রেওয়াজটিই এখনও চালু আছে। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে উৎসবের জন্য এই দুই দিনের পরিবর্তে এরচে উত্তম দু’টি দিন দিয়েছেন। এখন থেকে এই দুই দিনই হবে তোমাদের ধর্মীয় উৎসবের দিন। একটির নাম হলো ঈদুল আযহা। আপরটির নাম হলো ঈদুল ফিতর। (আবূ দাউদ, হাদীস: ১১৩৪) এখানে প্রণিধানযোগ্য বিষয় হলো, আমাদের উৎসবের এই দুই দিন আর অন্যান্য জাতির উৎসবের দিনগুলোর মাঝে রয়েছে বিস্তর ফারাক। অন্যান্য জাতির উৎসবের দিনগুলোর সিংহভাগই নিজেদের মনগড়া এবং সে দিনগলোতে যা হয় তারও সিংহভাগই ভিত্তিহীন ও নিজেদের বানানো এবং তা শ্রেফ একটি উৎসব। পক্ষান্তরে আমাদের উৎসবের এই দুই দিনের রয়েছে প্রামাণিক ভিত্তি এবং তা কেবলমাত্র উৎসবের দিনই নয়। এ দিনগুলোর রয়েছে বিশেষ ফযীলত এবং এ দিনগুলোতে আদায় করা হয় বিশেষ বিশেষ ইবাদত। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠা, সাজ-সজ্জা, সুগন্ধি ব্যবহার, মিসওয়াক করা, উত্তম পোষাক পরিধান, মিষ্টান্ন খাওয়া, ঈদের নামায আদায়, কুরবানী ইত্যাদির পাশাপাশি ঈদ উপলক্ষ্যে গরীব-আসহায় ও অভাবী মানুষকে সাহায্য-সহগোগিতা ও দান-সদকা করাটাও ঈদের সময়ের বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ আমল। সাহাবী ইবনে আব্বাস রা. বলেন, আামি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদের নামায পড়িয়েছেন খুতবার আগে। এরপর খুতবা দিলেন। এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মনে হলো তাঁর খুতবা মহিলাগণ শুনতে পান নি। তাই তিনি বেলাল রা.কে সাথে নিয়ে মহিলাদের কাছে গিয়ে তাদেরকে ওয়াজ-নছীহত করলেন এবং দান-সদকা করার নির্দেশ করলেন। বেলাল রা. কাপড় পাতলেন। মহিলাগণ হাতের আংটি, কানের দুল এবং অন্যান্য বস্তু সামগ্রী দান করলেন। [বুখারী, হাদীস:৯৭৯; মুসলিম, হাদীস:৮৮৪] সাহাবী সালামা ইবনে আকওয়া রা. বলেন, এক কুরবানী ঈদের সময় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করলেন, তোমাদের থেকে যারা কুরবানী দেয়, তারা যেন ৩ দিন পর্যন্ত কুরবানীর গোশত খায়। তিন দিনের পর কারো ঘরে যেন কোনো গোশত না থাকে। অবশিষ্ট সকল গোশত অভাবী মানুষের মাঝে দান করে দিতে বললেন। পরবর্তী বছর কুরবানীর সময় সাহাবায়ে কিরাম রা. মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দরবারে হাজির হয়ে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা কি গত বছরের ন্যয় এ বছরও তিন দিন খাওয়ার পর যে গোশত থাকে তা গরীব-দুঃখী ও অভাবী মানুষের মাঝে দান করে দিব? মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, না, বরং এ বছর তোমরা নিজেরা আহার কর। অন্যদেরকে আহার করাও এবং জমা রাখো। আগের হুকুমটি ছিল কেবল গত বছরের জন্য। কারণ গত বছর মানুষের মাঝে অভাব-অনটন দেখা দিয়েছিল। তাই অভাবী মানুষের সাহায্য-সহযোগিতার ইচ্ছায় আমি সেই নির্দেশ দিয়েছিলাম। [এ বছর সে অভাব আর নেই। তাই গত বারের মতো এবারও বিলিয়ে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।] [বুখারী, হাদীস:৫৫৬৯; মুসলিম, হাদীস:১৯৭১] পবিত্র এই হাদীস দু’টি প্রমাণ করে ঈদ কেবল আনন্দ-উৎসব ও নিজে ভোগ করার নাম নয়; বরং ত্যাগ স্বীকার করে অভাবী মানুষের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাদের মাঝেও ঈদ আনন্দ পৌছে দেওয়া ঈদের বিশেষ বৈশিষ্ঠ এবং একজন মুমিনের ঈমানী দায়িত্ব। সাহাবী আবূ হুরায়রা রা. এর বর্ণনায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার উপর কোনো জুলুম করে না। তার সাহায্য ত্যাগ করে না। যে তার মুসলিম ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণে থাকে, আল্লাহ তার প্রয়োজন পূরণে থাকেন। আর যে কোনো মুসলমানের একটি বিপদ দূর করবে, আল্লাহ তাআলা তার কিয়ামতের দিনের বিপদসমূহ থেকে একটি বিপদ দূর করে দিবেন। [বুখারী, হাদীস: ২৪৪২; মুসলিম, হাদীস: ২৫৮০] সুবহানাল্লাহ! আল্লাহ তাআলা যার প্রয়োজন পূরণ করে দিবেন এবং কিয়ামতের কঠিন দিনে বিপদ দূর করে দিবেন, তার চেয়ে সৌভাগ্যবান আর কে হতে পারে? সাহাবী আবূ হুরায়রা রা. এর বাচনিক মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, পরাক্রমশালী আল্লাহ তাআলা ততক্ষণ পর্যন্ত বান্দার সাহায্য করতে থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার অপর ভাইয়ের সাহায্য করতে থাকে। [মুসলিম, হাদীস: ২৬৯৯] (চলবে)

লেখক: সিনিয়র মুহাদ্দিস ও প্রধান মুফতী, জামিয়া মিফতাহুল উলূম, নেত্রকোনা



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাভাইরাস

৪ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ