বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
বিশুদ্ধ বাংলায় একে বলা হয় স্তূতিবাক্য, অতিরঞ্জন ইত্যাদি। ফার্সিতে বলা হয় খোশামোদ, তোশামোদ ইত্যাদি।
এটিকে হাদীসে বলা হয়েছে, আপন ভাইয়ের গলাকাটা। সমাজে এ গলাকাটা প্রথা বন্ধ করার সেই নামটা বিনা খরচে সহজেই ব্যবহার করা যায়, প্রয়োজন শুধু সৎ সাহসের এবং সত্য প্রতিষ্ঠার মানসিকতার। এ স্তূতিবাক্য তথা চাটুকারিতা মানব সমাজের একটি প্রাচীনতম ব্যাধি। যুগে যুগে জাতিতে জাতিতে এ ব্যাধির প্রাদুর্ভাব লক্ষ করা যায়। বিশেষত দুনিয়ার প্রভাব প্রতিপত্তি, শান শওকতপূর্ণ ও রাজ দরবারগুলো এ ব্যাধিতে আক্রান্ত থাকার বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। চাটুকারিতার বিষাক্ত ছোবল হতে দুনিয়ার কোনো রাষ্ট্র কখনো মুক্ত ছিল না। মহাকবি শেখ সাদী (রহ.) তার যুগের রাজদরবার সম্পর্কে একটি সত্যভাষণ রেখে গেছেন। তিনি বলেছেন:
‘আগার শাহ রোজরা গুয়াদ শবাস্তইঁ,
বে বায়াদ গুফত ইঁনক মাহও পারভিঁ।’
অর্থাৎ বাদশাহ যদি দিবসকে রজনী বলেন, তখন দরবারের সবাই বলে উঠে, ‘এই যে, আকাশে তারকারাজি ঝক ঝক করছে।’
দুনিয়ার সব ভাষা সাহিত্যেই স্তূতিবাক্য তথা চাটুকারিতা গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে রেখেছে। সেকালে এক শ্রেণির কবি, সাহিত্যিক, লেখক তাদের স্তূতিবাক্য বিতরণ করে রাজদবার হতে বহু নামি-দামি এনাম-পুরস্কার লাভ করে ধন্য হতেন। রাজা বাদশাহগণও তাতে আত্মতৃপ্তি লাভ করতেন। তাদের উত্তরসুরিগণ সেই উত্তরাধিকার আজো নানা আঙ্গিকে ধরে রেখেছে।
ইসলামের ইতিহাস এ স্তূতিবাক্য হতে মুক্ত না হলেও কিন্তু ইসলাম ধর্মে তার কখনো প্রশ্রয় দেয়া হয়নি, বরং এটাকে গলাকাটা অর্থাৎ হত্যা করার তুল্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে। অতিরিক্ত প্রশংসা, চাটুকারিতা যেমন প্রশংসাকারী বা চাটুকারের চরিত্রহীনতা ও মানসিক দুর্বলতা হয়ে উঠে, তেমনি যার প্রশংসা করা হয় তারও সর্বনাশ সাধিত হয়ে থাকে।
হুজুর (সা.) এর সময়ের একটি ঘটনা প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখযোগ্য যে, তাবুক যুদ্ধ হতে যখন হুজুর (সা.) মদীনা তাইয়েবায় প্রত্যাবর্তন করেন, তখন হজরত আব্বাস (রা.) আরজ করলেন যে, ‘হে আল্লাহর রসূল! আমাকে অনুমতি দান করুন, আমি আপনার প্রশংসায় কিছু বলতে চাই।’ যেহেতু হুজুর (সা.) এর প্রশংসা খোদ এতাআত বা আনুগত্য, তাই তিনি বললেন: ‘বল, আল্লাহতাআলা তোমার মুখের নিরাপত্তা বিধান করুন।’ অতঃপর হজরত আব্বাস (রা.) কয়েকটি কবিতা পাঠ করেন, যেগুলো হজরত থানভী (রহ.) তার ‘নাশরুত্তীব’ পুস্তকে উদ্ধৃত করেছেন। এসব কবিতায় তাঁর জন্মবৃত্তান্তের সূক্ষ্ম বর্ণনা রয়েছে, যা বিভিন্ন হাদীসে খোদ হুজুর (সা.) ব্যক্ত করেছেন, অতিরঞ্জনের গন্ধও তাতে নেই। অথচ, আল্লাহর পরেই তাঁর স্থান এবং স্বয়ং আল্লাহই তাঁর প্রশংসা করেছেন।
খলিফা হজরত ওমর (রা.) এর সময় চাটুকারদের প্রতি কঠোর শাস্তি প্রয়োগের ব্যবস্থা ছিল। অতিরিক্ত প্রশংসা বা চাটুকারিতা বক্তৃতা-বিবৃতি সাহিত্যে, গদ্যে, পদ্যে উভয়ভাবে প্রাধান্য পেতে থাকে। চাটুকারেরা বিশেষ পার্থিব উদ্দেশ্য সাধনে ‘জাহেলিয়াতের’ যুগে এই পেশা অবলম্বন করত, যা সকল সমাজে আজও বহাল ও বিরাজমান। এহেন চাটুকারদের সম্বন্ধে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা যখন কোনো এনাম-পুরস্কারের উদ্দেশ্যে আগমন করে কাসিদাখানি আরম্ভ করবে, তখন তাদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করে দেবে।
রসূলুল্লাহ (সা.) এর সম্মুখে এক ব্যক্তির প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছিল। সেইস্থলে অপর এক ব্যক্তি যে অত্যন্ত প্রশংসা করতে আরম্ভ করে দিলো। তখন হুজুর (সা.) বললেন: ‘হায়! আক্ষেপ, তুমি তোমার বন্ধুর গলাকেটে ফেললে।’ তিনি পুনঃরায় ঐ ব্যক্তিকে এই কথা বললেন, ‘কারো প্রশংসা করতে হলে এইটুকু বললে হয় যে, আমি এইরূপ অনুমান করি। কিন্তু সাবধান খোদার চেয়ে কারো অধিক প্রশংসা করবে না।’ (বোখারী মুসলিম)। রসূলুল্লাহ (সা.) আরো বলেছেন: ‘যখন তোমরা চাটুকারকে দেখতে পাও, তখন তার মুখে মৃত্তিকা নিক্ষেপ কর।’ (মুসলিম)। রসূলুল্লাহ (সা.) এক ব্যক্তিকে অপর এক ব্যক্তির অতিরিক্ত প্রশংসা করতে শুনে বলেছিলেন, ‘তুমি যাকে (যার প্রশংসা করেছ) ধ্বংসের মুখে ফেলে দিলে এবং তার (কটিদেশ) ভেঙে ফেললে।’
আবু মোয়াম্মর বলেছেন যে, এক ব্যক্তি কোনো একজন ধনবানের সম্বন্ধে অতিরিক্ত প্রশংসা করছিল, এমন সময় মেকদাদ তার মুখে মৃত্তিকা নিক্ষেপ করলেন এবং বললেন; রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন যে, ‘তোমরা যখন চাটুকার দেখতে পাও তখন তার মুখে মৃত্তিকা নিক্ষেপ কর।’ (আদবুল মোফরাদ)। হজরত ইবনে ওমর (রা.) এর সম্মুখে এক ব্যক্তি কারো প্রশংসা আরম্ভ করেছিল, (তাতে) তিনি তার মুখে মৃত্তিকা নিক্ষেপ করতে আরম্ভ করলেন এবং বললেন যে, হজরত রসূলে করিম (সা.) বলেছেন, ‘যখন তোমরা চাটুকারকে দেখতে পাও, তখন তার মুখে মৃত্তিকা নিক্ষেপ কর।’
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।