Inqilab Logo

বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ০১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৬ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

বরগুনায় জমজমাট ক্লিনিক ব্যবসা

৯০টির ৫৩টিই চলছে অবৈধ পন্থায়

জাহাঙ্গীর কবীর মৃধা, বরগুনা থেকে : | প্রকাশের সময় : ৪ জুলাই, ২০২১, ১২:০১ এএম

চিকিৎসাসেবার নামে বরগুনার ৬টি উপজেলায় জমজমাট ব্যবসা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠছে প্রায় শ’খানেক প্রতিষ্ঠান। এর সিংহভাগই নিবন্ধনহীন। পরিচালিত হচ্ছে অবৈধ পন্থায়। আবাসিক বাড়িঘর, হাটবাজার, অলিগলিতে রয়েছে কথিত হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ছড়াছড়ি। ব্যাঙের ছাতার ন্যায় বেড়ে উঠা এসব সেবাপ্রতিষ্ঠানের অপচিকিৎসায় অগনিত নবজাতক, প্রসূতিসহ নানাধরণের রোগী হচ্ছেন লাশ। মাঝেমধ্যে হামলা-মামলা-অভিযান পরিচালিত হলেও প্রতিকার পরিলক্ষিত হয়নি কখনো। দীর্ঘদিন যাবৎ চিকিৎসাসেবার নামে অপচিকিৎসা অব্যাহত থাকলেও নিরব দর্শকের ভূমিকায় রয়েছে প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরগুনা জেলায় কথিত হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সিংহভাগই সম্পূর্ণ অবৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে। বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধনের মেয়াদ তিন-চার বছর পূর্বেই শেষ হয়েছে, নবায়ন না করেও সেসব হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার মহাসমারোহে চলছে কর্তৃপক্ষের চোখের সামনে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের কোনো নিবন্ধন না নিয়ে কোথাও কোথাও শুধু ট্রেড লাইসেন্স দিয়েও অসাধু ব্যবসায়ীরা চিকিৎসা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ লাইসেন্সের জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরে আবেদন পাঠিয়েই যত্রতত্র ব্যাঙের ছাতার মতো হাসপাতাল, ক্লিনিক, নার্সিং হোম খুলে বসেছেন। কেউ বা পরিচালনা করছেন রোগ নির্ণয়কারী ডায়াগনস্টিক সেন্টার। অবৈধ ভুঁইফোড় নামকাওয়াস্তে প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। কালেভদ্রে মামলা-হামলা-ঝটিকা অভিযান পরিচালিত হলেও সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েই বছরের পর বছর ধরে সচল থাকে চিকিৎসাসেবার নামে সাইনবোর্ড-সর্বস্ব এ প্রতিষ্ঠানগুলো।
জেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে অবস্থিত সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঘিরে গড়ে ওঠা দালালনির্ভর এসব নার্সিং হোম, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে সর্বশান্ত হচ্ছে নিরীহ মানুষ। বরগুনা সদরের এম বালিয়াতলী ইউনিয়নের বড় বালিয়াতলী গ্রামের সুখী নামের এক প্রসূতি মায়ের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে বরগুনাস্থ কুয়েত প্রবাসী হাসপাতালের হাতুড়ে ডাক্তারের অপচিকিৎসায়। তালতলী উপজেলার শিকারীপাড়ার মনির হোসেনের স্ত্রী সালমা পাথরঘাটার সউদী প্রবাসী হাসপাতালের কথিত ডাক্তারের অপচিকিৎসায় মারা যান। মারা যান নবজাতকসহ তাজেনুর বেগম। পাথরঘাটার শাপলা ক্লিনিকে ম্যানেজারের অপচিকিৎসায় প্রাণ হারান তাসলিমা। বরগুনার মডার্ণ ক্লিনিকে অনভিজ্ঞ ডাক্তারের চিকিৎসায় জরায়ু অপারেশনে একাধিক রোগী প্রাণ হারায়। বামনায় হাতুড়ে ডাক্তারের অপচিকিৎসায় মোসা. মাকসুদা বেগম নামে এক প্রসূতি ও নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনায় বামনা মাতৃসদন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারটি সিলগালা করে দেয় উপজেলা প্রশাসন।
তালতলী উপজেলায় হাতুড়ে চিকিৎসক মনিরুল ইসলামের অপচিকিৎসায় আলী আকবর নামক রোগীর মৃত্যু হয়। সার্জন না হয়েও ডা. নাইমা কবির আমতলী মাতৃসদন সাজিক্যাল ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গৃহবধূ খাদিজা বেগমের জরায়ু ও এপেন্টিসাইটিস ভুল অপারেশন করায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। বেতাগীর মাতৃছায়া জেনারেল হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সেবার নামে চলছে গলাকাটা অবৈধ রমরমা বাণিজ্য। প্রসূতি মায়েদের গর্ভের সন্তান সিজার করার সময় একাধিক শিশু ও মায়ের মৃত্যুর খবরও রয়েছে অনেক। একশ্রেণির দালাল ও সরকারি হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে সিন্ডিকেট করেই এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন। বিভিন্ন সময় র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত এসব অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ভুয়া ডাক্তারের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়, আটক করে জেলে পাঠায় এবং জরিমানার দন্ড জারি করে। অভিযুক্ত ক্লিনিকগুলো সিলগালাও করে দেয়া হয়। কিন্তু নানা কৌশলে প্রতিষ্ঠানগুলো সচলই থাকে বারোমাস।
এসকল ক্লিনিকের কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্য বিভাগের কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছে না। নেই কোন জরুরি বিভাগ, নেই রোগ নির্ণয়ের মানসম্মত যন্ত্রপাতি, পরীক্ষাগার বা ল্যাব টেকনোলজিস্ট। মাঝেমধ্যে ধার করা পার্টটাইম চিকিৎসক দিয়ে চলছে জটিল অপারেশনসহ নানারোগর চিকিৎসা। কম বেতনের অনভিজ্ঞ নার্স, আয়া ও দারোয়ানই হচ্ছে এ ক্লিনিকগুলোর একমাত্র ভরসা। কম্পিউটারাইজড, পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল ও অত্যাধুনিক নামে নামিদামী চিকিৎসকদের নাম সম্বলিত চোখ ধাঁধানো ব্যানারসহ ডিজিটাল সাইনবোর্ড সর্বস্ব এ ক্লিনিকগুলো জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের অসহায় মানুষ রোগ নিরাময়ের জন্য এসে অপচিকিৎসার জালে আটকা পড়ছেন। বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত সহজ-সরল অসহায় মানুষগুলো প্রতিনিয়তই তাদের পাতা ফাঁদে আটকে নিঃস্ব হচ্ছেন।
এসকল ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বসার কথা মাইকিং ও লিফলেট বিতরণ করে বলা হলেও তাদের কেউ কেউ মাসে দু-একবার এসে অপারেশন করে চলে যান। বেশিরভাগ ক্লিনিকেই নিয়মিত কোন চিকিৎসক থাকেন না। এসব বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের নাম ভাঙিয়ে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়ে রোগীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। জেলা কিংবা উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে পর্যাপ্ত মনিটরিং কিংবা জবাবদিহি না থাকায় অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। প্রশাসনের কঠোর নজরদারি না থাকার কারণে এ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো চালুর পর থেকে অবৈধ কর্মকান্ডের রীতিমতো প্রতিযোগিতায় মেতে উঠে।
বরগুনার সিভিল সার্জন ডা. মারিয়া হাসান বলেন, স্বাস্থ্য অধিদফতরের লাইসেন্স প্রাপ্তি ব্যতিত কোন ধরণের চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান চালু করার সুযোগ নেই। অবৈধ পন্থায় গড়ে উঠা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের এখতিয়ার প্রশাসনের।
এ ব্যাপারে বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, জেলায় নিবন্ধনহীন হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের তালিকা পেলে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ