হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
মুনশী আবদুল মাননান
আরেকটি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ কি আসন্ন- এ প্রশ্ন অনেকেরই। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা দিন দিন বাড়ছে। ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের উরির সেনা ঘাঁটিতে হামলার ঘটনার পর দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক লড়াই জোরদার হওয়ার পাশাপাশি সামরিক লড়াইয়ের প্রস্তুতিও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। উরির সেনা ঘাঁটিতে হামলার দুই দিন পর ওই সেক্টরে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়েছে। গোলাগুলি বিনিময় ২০ মিনিট স্থায়ী হয় বলে খবরে উল্লেখ করা হয়েছে। একই দিনে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর দুই দফা অভিযানে কথিত ১০ অনুপ্রবেশকারী নিহত হয়েছে। অনুপ্রবেশকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে একজন নিরাপত্তা রক্ষী নিহত হয়েছে বলেও জানানো হয়েছে।
সীমান্তে দুই দেশের সামরিক সাজসজ্জা ও লড়াচড়া দেখে পর্যবেক্ষকদের কাছে প্রতীয়মান হচ্ছে, দেশ দুটি সংক্ষিপ্ত কিংবা দীর্ঘমেয়াদি কোনো সংঘাত-সংঘর্ষের দিকেই যেন এগিয়ে যাচ্ছে। খবর বেরিয়েছে, ভারতের সেনাবাহিনী সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় ক্রমশই সরে আসছে। পাকিস্তানও বসে নেই। সেও সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। যে কোনো হামলা মোকাবেলায় তার পূর্ণ প্রস্তুতির কথা ইতোমধ্যেই সে জানিয়েছে। দুই দেশের পরমাণু অস্ত্রের প্রস্তুতির কথাও শোনা যাচ্ছে।
পাকিস্তানে হামলা চালাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ওপর চাপ বাড়ছে, এমন খবর পত্র-পত্রিকায় এসেছে। উরির সেনা ঘাঁটিতে হামলার ঘটনার পর ভারত পাকিস্তানকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং পাকিস্তানকে ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’ বলে অভিহিত করেছেন। ভারতীয় রাজনীতিকদের অনেকেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কড়া ভাষা প্রয়োগ করেছেন। কেউ কেউ ‘সমুচিত জবাব’ দেয়ার হুমকি দিয়েছেন। ক্ষমতাসীন বিজেপির অন্যতম শীর্ষ নেতা রাম মাধব বলেছেন, ‘তথাকথিত কৌশলগত কারণে সহ্য করার সময় শেষ হয়ে গেছে।’ ভারতের সাবেক সেনা কর্মকর্তারাও কঠোর মনোভাব প্রকাশ করেছেন। পাল্টা আঘাত হানা উচিত বলে তারা মত দিয়েছেন। পাকিস্তানের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার পক্ষে ভারতীয় মিডিয়াগুলোও সোচ্চার। ভারতের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ ভারতের ‘নমনীয় নীতি’র সমালোচনা করেছেন। এদেরই একজন হলেন সি ক্রিস্টিন ফেয়ার। তার মতে, কৌশলগত সংযমের নীতি ভারতের কোনো উপকারে আসছে না। তিনি বলেছেন, ‘ভারতের উদ্দেশ্য যদি হয় পাকিস্তানের সন্ত্রাসী তৎপরতা বন্ধ করা তাহলে এটা কাজে দিচ্ছে না। ভারত নীরব ভূমিকায় থাকলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কি ভারতের পাশে দাঁড়ানোর বাধ্যবাধকতা অনুভব করছে?’ অজয় শুক্লা নামের আরেক নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ মোদি সরকারের সমালোচনা করে বলেছেন, সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নানা রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম রেখেছে। কিন্তু কোনো সন্ত্রাসী হামলার কড়া জবাব দেয়ার মতো সামরিক শক্তি ও পরিকল্পনা তৈরি করেনি। বলাবাহুল্য, এসব বক্তব্য ও অভিমত মোদি সরকারের আক্রমণাত্মক নীতি গ্রহণে প্ররোচনার নামান্তর। পিউ রিসার্চের এক জরিপের বরাত দিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, ভারতের ৭৮ শতাংশ মানুষ মোদির পাকিস্তান নীতি সমর্থন করছে না। ভারতের এক সাবেক সেনাপ্রধান এককাঠি এগিয়ে গিয়ে বলেছেন, পাকিস্তানে হামলার জন্য ‘আত্মঘাতী দল’ বানানো উচিত।
উরি সেনাঘাঁটিতে হামলার ঘটনায় পাকিস্তানকে দায়ী করার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেছে পাকিস্তান। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা সারতাজ আজিজ বলেছেন, কাশ্মীরের মানবাধিকার পরিস্থিতি থেকে দৃষ্টি অন্যদিক সরাতে পাকিস্তানের ওপর অযথা হামলার দায় চাপাচ্ছে ভারত। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও একই অভিমত ব্যক্ত করা হয়। এই সঙ্গে এও বলা হয় যে, তদন্ত ও প্রমাণ ছাড়াই উরিতে হামলার ঘটনার দায় পাকিস্তানের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে ভারত। ভারতে কোনো হামলা হলেই পাকিস্তানের ওপর আঙুল তোলে ভারত।
এ কথা কারো অজানা নেই, ভারত ও পাকিস্তান একে অপরের আজন্ম শত্রু। দেশদুটির মধ্যে এই শত্রুতার সবচেয়ে বড় কারণ কাশ্মীর সমস্যা। কাশ্মীর সমস্যাকে কেন্দ্র করে দেশ দুটির মধ্যে একাধিকবার যুদ্ধ হয়েছে। এ ছাড়া সীমান্তে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা ও সংঘাততো রীতিমতো সাধারণ ঘটনা। এও লক্ষ্য করা গেছে, দুই দেশের অভ্যন্তরে কোনো সংকট দেখা দিলে তা ধাপাচাপা দেয়ার জন্য তারা বাগ্্যুদ্ধে লিপ্ত হয়। কখনো কখনো সীমান্তে উত্তেজনা বাড়ায়, এমন কি সীমান্তযুদ্ধেও জড়িয়ে পড়ে। তিন মাস ধরে ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তা থেকে সহসা বেরিয়ে আসা ভারতের পক্ষে অসম্ভব। পরিস্থিতি ক্রমাগত ভারতের বিপক্ষেই চলে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় উরির সেনা ঘাঁটিতে হামলার ঘটনা কাজে লাগিয়ে ভারত জনদৃষ্টি ও বিশ্বদৃষ্টি কাশ্মীর থেকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতে পারে। ভারত কি সেই সুযোগটিই নিতে চাচ্ছে?
শেষ পর্যন্ত ভারত পাকিস্তানে হামলার ঝুঁকি নেবে কিনা সেটা একটা গুরুতর প্রশ্ন। ভারতের বিভিন্ন মহল থেকে যে ধরনের প্ররোচনা দেয়া হচ্ছে, সেটা উপেক্ষা করতে মোদি সরকার পারবে কিনা তা অবশ্যই দেখার বিষয়। অন্যদিকে ভারতে এমন অভিমতও আছে যে, এ মুহূর্তে কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া সমীচীন হবে না। এ জন্য আরো প্রস্তুতির প্রয়োজন যা সময়সাপেক্ষ। পর্যবেক্ষকদের অনেকের ধারণা, ভারত হয়তো এখনই যুদ্ধে জড়াবে না; তবে যুদ্ধের প্রস্তুতি এগিয়ে নেবে। এই অবকাশে সে পাকিস্তানের বিপক্ষে কূটনৈতিক লড়াই জোরদার করবে। ইতোমধ্যে পাকিস্তানকে একঘরে করার কৌশল অবলম্বন করেছে ভারত। পাকিস্তানকে ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’ হিসাবে চিহ্নিত করতে কূটনৈতিক তৎপরতা সে শুরু করেছে। এ নিয়ে বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ আরম্ভ করেছে। এর মধ্যেই খবর পাওয়া গেছে, দুইজন মার্কিন এমপি পাকিস্তানকে ‘সন্ত্রাসের মদদাতা ‘রাষ্ট্র’ হিসাবে ঘোষণা করার জন্য মার্কিন কংগ্রেসের নি¤œকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে একটি বিল উত্থাপন করেছেন। তারা দু’জন সেখানকার প্রধান দুই দলের সমন্বয়ে গঠিত এক কমিটির সদস্য। এটা কাকতালীয় না কি এর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের ভরতীয় লবির কোনো ভূমিকা আছে তা জানা যায়নি। ওয়াকিবহাল মহলের অজানা নেই, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক আগের চেয়ে অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ হয়েছে। ভারতের দক্ষিণ এশিয়া নীতি ও যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া নীতি এখন অনেকটাই অভিন্ন রূপ নিয়েছে। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোকে ভারত তার প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে চায়। যুক্তরাষ্ট্র চায় এ অঞ্চলে তারও প্রভাব বজায় থাক। চীনকে মোকাবিলার যে নীতি দু’দেশের রয়েছে সেই নীতিগত ঐক্যই তাদের অভিন্ন অবস্থান গ্রহণে উদ্বুদ্ধ ও বাধ্য করছে। ভারত মনে করছে, চীনের মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র তার পক্ষে থাকলে তার লাভ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে, চীনকে মোকাবিলার জন্য ভারতই হতে পারে তার সবেচেয়ে কার্যকর মিত্র। তাই ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া নীতির মধ্যে এখন আর তেমন ফারাক নেই। ইতোপূর্বে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বলে দেয়া হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় দু’দেশ একসঙ্গে কাজ করবে। সম্প্রতি দু’দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত যে চুক্তি হয়েছে তার আওতায় দু’দেশ তাদের সামরিক ঘাঁটি পরস্পরকে ব্যবহার করতে দেবে। এই চুক্তির প্রধান লক্ষ্য চীন, তাতে পর্যবেক্ষকদের মধ্যে কোনো মতপার্থক্য নেই। একথা কে না জানে, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র। কিন্তু সম্প্রতিক বছরগুলোতে সেই মিত্রতা আর আগের মতো পরিলক্ষিত হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র ভারতমুখী হয়ে যাওয়ায় দু’দেশের সম্পর্কে একটা টানাপোড়েন চলছে। বিভিন্ন ঘটনায় তা প্রমাণিত। তিন মাস ধরে কাশ্মীরে ভারতীয় বাহিনীর হত্যা, নির্যাতন ও নির্বিচার মানবাধিকার লংঘনের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের তেমন কোনো জোরালো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রের কাশ্মীর নীতি বরাবরই পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। এখন আর সেই অবস্থায় আছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না।
দেখা গেছে, উরির সেনা ঘাঁটিতে হামলার ঘটনায় ভারতের অবস্থানের পক্ষে রাশিয়া, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশ কথা বললেও আর কোনো দেশ তেমন এগিয়ে আসেনি। অন্যদিকে কাশ্মীর প্রশ্নে চীন, সউদী আরব প্রভৃতি দেশ পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। ওআইসিও কাশ্মীরে হত্যা-নির্যাতন ও মানবাধিকার লংঘন বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। এমতাবস্থায়, পাকিস্তানকে একঘরে করার ভারতীয় চেষ্টা প্রথমেই বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। অতঃপর পাকিস্তানের বিপক্ষে ভারতের আকাক্সিক্ষত কূটনৈতিক বিজয় অর্জন কতটা সম্ভব হবে সেটাই বিবেচ্য ও এবং আগামীতে দেখার বিষয়। কূটনৈতিক দিক দিয়ে পাকিস্তানকে বড় রকমে চাপে ফেলাতে পারলে পাকিস্তানে ভারতের কথিত পাল্টা হামলা চালানো অনেকটা সহজ হতে পারে। শেষাবধী ভারতের এই উদ্যোগ যদি সফল না হয় তবে অনেকে মনে করেন, অভ্যন্তরীণ চাপের কারণে ভারত একটি ‘সীমিত পরিসর’ যুদ্ধের ঝুঁকি নিলেও নিতে পারে। সীমিত পরিসর যুদ্ধের ঝুঁকি নেয়াটাও কতটা সমীচীন হবে সেটা সঙ্গত কারণেই ভাববার বিষয়। দুটি দেশের আজন্ম বৈরিতা এতটাই প্রবল যে, সীমিত যুদ্ধ বড় যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়ে যেতে পারে। দুদেশই পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী। কোনো কারণে যুদ্ধ বিস্তৃত ও স্থায়ী হলে শেষ পর্যন্ত দু’দেশই পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার করে ফেলতে পারে। তেমন অবস্থায় পরিস্থিতি কি হবে এবং কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা সহজেই অনুমেয়। অনেকে মনে করেন, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধকে কেন্দ্র করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধও লেগে যেতে পারে। আশঙ্কার এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে ভারত বা পাকিস্তান কোনো দেশেরই যুদ্ধের পথে হাঁটা উচিত নয়। তাদের উচিত হবে সর্বদা সংযম প্রদর্শন করা, যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়া এবং সংলাপের মাধ্যমে বিরোধ বা সদস্যা মিটিয়ে ফেলা। যুদ্ধ কখনোই শান্তি ও সমাধান এনে দেয় না, এ কথাটি দু’দেশকেই স্বীকার ও কবুল করতে হবে। আলোচনা, সংলাপ-সমঝোতা যে কোনো বিরোধ বা সমস্যার সমাধান এনে দিতে পারে। ইতিহাসে এর নজিরের অভাব নেই।
কাশ্মীর সমস্যাই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধ-বৈরিতার প্রধান কারণ। এ সমস্যার শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য সমাধান হলে দু’দেশের মধ্যে সখ্য ও সহযোগিতা যেমন গড়ে উঠতে পারে, তেমনি গোটা দক্ষিণ এশিয়া হয়ে উঠতে পারে শান্তি ও নিরাপত্তা, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির অনুকরণীয় অঞ্চল। কাশ্মীর সমস্যার সূত্রপাত ভারত বিভক্তির সময়। মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা পাকিস্তান ও হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা ভারতভুক্ত হবে, এই নীতিতে ভারত বিভক্ত হয়। ওই সময় ভারতে এমন কিছু রাজ্য ছিল যাদের ‘প্রিন্সলি স্টেট’ বলে অভিহিত করা হতো। তাদের ব্যাপারে এই নীতি অবলম্বিত হয় যে, তারা ইচ্ছে করলে পাকিস্তান বা ভারত ডোমেনিয়নে যোগদান করতে পারে অথবা স্বাধীনও থাকতে পারে। ওই সময় লর্ড মাউন্টব্যাটেন ও নেহেরুর যোগসাজশ ও চাপের মুখে বেশ কিছু রাজ্য ভারতে যোগদান করতে বাধ্য হয়। কাশ্মীরের অধিকাংশ মানুষ মুসলমান হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই ধারণা করা গিয়েছিল, কাশ্মীর হয় স্বাধীন অথবা পাকিস্তানভুক্ত হবে। কাশ্মীরের রাজা ছিলেন অমুসলিম। নাম হরি সিং। তিনি জনগণের ইচ্ছার কোনো তোয়াক্কা না করে ভারতে যোগদান করেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। সংক্ষেপে বলা যায়, কাশ্মীরী জনগণ পাকিস্তানে যোগদানের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। এ নিয়ে ’৪৭-৪৮ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হয়। পরবর্তীতে ১৯৬৫ সালেও দু’দেশের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই দুই যুদ্ধ কাশ্মীর সমস্যার কোনো সুরাহা দিতে পারেনি। নেহেরু যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী তখন এই ইস্যু ভারতের তরফে জাতিসংঘে নিয়ে যাওয়া হয়। জাতিসংঘ এর সমাধানে গণভোটের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত ভারত এই গণভোট দেয়নি। কাশ্মীর এখন দ্বিধা বিভক্ত। এর একাংশ পাকিস্তানে, যা আজাদ কাশ্মীর নামে পরিচিত। অন্য অংশ জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের নিয়ন্ত্রণে। যদি জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুযায়ী গণভোট অনুষ্ঠিত হতো তাহলে অনেক আগেই শান্তিপূর্ণভাবে এই সমস্যার নিষ্পত্তি হয়ে যেতো।
ভারত কাশ্মীরকে তার অঙ্গীভূত করতে চায়। হরি সিং কিংবা কাশ্মীরের বাঘ হিসেবে খ্যাত শেখ আবদুল্লাহর শর্ত বা দাবী কোনো কিছুই ভারত তোয়াক্কা করেনি। শেখ আবদুল্লাহ স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ও যোগাযোগ, এই তিনটি বিষয় ভারতের কর্তৃত্বে রেখে কাশ্মীরের স্বাতন্ত্র্য সুরক্ষায় প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু এই প্রস্তাব মানা হয়নি। বন্ধু নেহেরুর সঙ্গে মতবিরোধের ফল হিসাবে শেখ আবদুল্লাহকে কারাগারে যেতে হয় এবং দীর্ঘদিন কারাভোগ করতে হয়। পরবর্তীকালে কাশ্মীরী নেতাদের সঙ্গে ভারতের যত আলাপ-আলোচনা হয়েছে, তাতে কাশ্মীরী নেতারা কাশ্মীরের স্বাতন্ত্র্য ও বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের ওপরই জোর দিয়েছেন। ভারত তাদের অভিপ্রায়-অভিমত গ্রাহ্যে আনেনি। ভারতের সংবিধানের ৩৭০ ধারায় যে বিধান রাখা হয়েছে, সে বিধান অব্যাহত রাখতে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে বর্তমানে ক্ষমতাসীন বিজেপি রাজী নয়। ভারতের নীতি ও অবস্থান এ থেকে মোটেই অস্পষ্ট থাকে না। ভারত কাশ্মীরের স্বাধীনতা তো দূরের কথা স্বায়ত্তশাসন পর্যন্ত দিতে চায় না। কাশ্মীরের জনগণের অতীত, সকল দাবি-দাওয়া ও প্রত্যাশা বেতোয়াক্কা করে কাশ্মীরকে ভারতের অঙ্গীভূত করতে চায়। এই লক্ষ্য অর্জনে ভারত কাশ্মীরে দীর্ঘ ৬৯ বছর ধরে এক চ-নীতি অনুসরণ করে আসছে। হত্যা, অপহরণ, গুম, অত্যাচার-নির্যাতনের তা-ব চালিয়ে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত ভারতের সেনা, পুলিশ ও মিলিশিয়া বাহিনীর হাতে কত কাশ্মীরী মুসলমান নিহত হয়েছে, কত মানুষ অবর্ণনীয় নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয়েছে, কত মা-বোন ইজ্জত-সম্ভ্রম হারিয়েছে, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। বিগত তিন মাসে কাশ্মীরে হত্যা-নির্যাতন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক প্রকার ‘মহোৎসব’ চলছে। এ সময়ে শতাধিক কাশ্মীরী নিহত হয়েছে। অন্তত অর্ধশত যুবক অন্ধ হয়ে গেছে। ইসরাইল থেকে আনা অস্ত্র প্রয়োগের ফলে তাদের এ অবস্থা হয়েছে। ধরপাকড়-নির্যাতনের তো কোনো সীমাই নেই। দীর্ঘ কারফিউ, নির্বিচার হত্যা, গ্রেপ্তার ও অকথ্য নির্যাতন চালিয়েও বিক্ষুব্ধ কাশ্মীরীদের বশে আনা সম্ভব হয়নি। বস্তুত, কাশ্মীর ভারতের নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্বের অনেকটাই বাইরে চলে গেছে। কাশ্মীরকে ভারতের ভূগোলের মধ্যে রেখে শান্তি ও সমাধানের পথ প্রায় রুদ্ধ হয়ে গেছে। দু’তিন বছর আগেও কাশ্মীরী নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের যে সুযোগ ছিল এখন তা হাতের বাইরে। এ কথা ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক কূলদীপ নায়ারও স্বীকার করেছেন। বলেছেন, নতুন প্রজন্মের কাশ্মীরীরা স্বাধীনতার পথে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। ভারতের বিশ্বখ্যাত লেখিকা অরুন্ধুতী রায় স্পষ্ট করে বলেছেন, কাশ্মীরে আসলে ভারতীয় বাহিনীর আগ্রাসন চলছে। অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে কাশ্মীরীদের। কাশ্মীর সমস্যার একমাত্র সমাধান স্বাধীনতা।
স্বাধীনতার পথ থেকে কাশ্মীরীদের আর ফেরানো যাবে বলে মনে হয় না। হত্যা-নির্যাতন দমন-দলন অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। ভারতীয় নেতাদের এই সত্য ও বাস্তবতা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। সমস্যার একমাত্র সমাধান কাশ্মীরের ভাগ্য কাশ্মীরী জনগণের হাতে ছেড়ে দেয়া। জাতিসংঘের প্রস্তাব মেনে নিয়ে গণভোটের ব্যবস্থা করা। এ ছাড়া ভিন্ন কোনো পথে কাশ্মীর সমস্যার মীমাংসা সম্ভব নয়। একথা বলাই বাহুল্য, কাশ্মীর সমস্যার শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি হয়ে গেলে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে ইতিবাচক ধারা সৃষ্টি হবে। এ অঞ্চলের শান্তি, নিরাপত্তা, উন্নয়ন, সমৃদ্ধির নয়া দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।